নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধানে সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন

| সোমবার , ২২ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৫:৫৮ পূর্বাহ্ণ

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিদেশে জনশক্তি রপ্তানিতে বড় বাধা দালাল ও প্রতারক বলে মন্তব্য করেছেন। গত ১৭ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস এবং জাতীয় প্রবাসী দিবস২০২৫ উপলক্ষে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এ মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘বিদেশে যেতে দালাল ও প্রতারণা সাংঘাতিক রকমভাবে যুক্ত। এর মধ্য থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত প্রবাসী খাতে কিছু করেছি বলে মনে করা যায় না। যে কাজ হয়েছে তা উপরে উপরে। ভেতরে ঢোকা যাচ্ছে না।’ প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর পুরো জগতটাই হলো দালালবেষ্টিত জগত। কে কার কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে তা বোঝা যায়না। সরকার অনেক দূরে এর থেকে। এর ভেতরে ঢোকার ক্ষমতা সরকারের নাই। আশা করি একসময় সেই ক্ষমতা হবে।’

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য জনশক্তি রপ্তানি অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু বেসরকারি জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সীমাহীন দুর্নীতি এবং অনিয়মের কারণে জনশক্তি রপ্তানি আজ হুমকির মুখে। আর এজন্যই দরকার জনশক্তি রপ্তানিতে সরকারের একক নিয়ন্ত্রণ।

বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, বিদেশ যেতে বাংলাদেশি কর্মীদেরই সবচেয়ে বেশি টাকা খরচ হয়। দুর্নীতিবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) তথ্য, ফিলিপাইনের কর্মীরা মধ্যপ্রাচ্যে বিনা খরচে কাজের অনুমতি বা ওয়ার্ক পারমিট পান। সে একই অনুমতিপত্র পেতে বাংলাদেশি কর্মীদের মাথাপিছু খরচ হয় ২ থেকে ৩ লাখ টাকা। এভাবে জনশক্তি রপ্তানিতে বিদেশ থেকে চাহিদাপত্র, যা ‘ভিসা কেনা’ নামে পরিচিত, সংগ্রহ করে দেশে তা প্রক্রিয়াকরণে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার অনিয়ম হয়। বিদেশে কাজের জন্য যাওয়া কর্মীদের কাছ থেকে মধ্যস্বত্বভোগী ও রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো যথেচ্ছ টাকা আদায় করছে। এর জন্য ভিসা কেনাবেচাকে দায়ী করেছেন জনশক্তি খাত সংশ্লিষ্টরা।

টিআইবির তথ্যানুযায়ী, বিদেশগামী ৯০ ভাগ পুরুষ কর্মী দুর্নীতির শিকার হন। ‘ভিসা কেনা’ বাবদ প্রতি বছর ১৫ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যায়। এ টাকার একটি অংশ পায় প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেট। সরকার নির্ধারিত ব্যয়ের চেয়ে ২ থেকে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত বেশি আদায় করে এজেন্সিগুলো। এ বাড়তি টাকা চাহিদাপত্র কিনতে যায় বলে এজেন্সিগুলো দাবি করে। প্রায় প্রতিটি চাহিদাপত্র কিনে আনেন জনশক্তি রপ্তানিকারকরা। তা দেশে এনে কর্মীদের কাছে বিক্রি করেন। গন্তব্য দেশ ও বাংলাদেশ দুই দেশের দালালরা এ কেনাবেচায় জড়িত। এতে বিদেশ যাওয়ার খরচ (অভিবাসন ব্যয়) সরকার নির্ধারিত সীমার চেয়ে তিন গুণ পর্যন্ত বেশি হয়। বিদেশ থেকে কর্মীর চাহিদাপত্র সংগ্রহ করে রিক্রুটিং এজেন্সি। এর বিপরীতে কর্মীরা ভিসা পান। ভিসা প্রক্রিয়াকরণে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি), ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে ছাড়পত্র সংগ্রহ, ফিঙ্গার প্রিন্ট দেওয়া, দূতাবাস থেকে ভিসা সত্যায়ন করতে হয়। এগুলো এজেন্সির মাধ্যমে করতে হয় এবং এর প্রতিটি ধাপে অনিয়ম হয় বলে অনুসন্ধানে দেখা যায়। অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, সব দেশে জনশক্তি রপ্তানি সরাসরি সরকারের মাধ্যমে হলেই কেবল এ ধরনের দুর্নীতি এবং অনিয়ম বন্ধ হতে পারে। একজন অভিবাসনপ্রত্যাশী যে দেশেই যেতে চান না কেন, তাকে সরাসরি সরকারের মাধ্যমেই যেতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বড় প্রত্যাশা ছিল বৈশ্বিক শ্রমবাজারে দক্ষ শ্রমিক প্রেরণ, বন্ধ শ্রমবাজার চালু করা এবং নতুন শ্রমবাজারের সন্ধান। বাস্তবে সেই প্রত্যাশার প্রতিফলন খুব একটা দেখা যায়নি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মী যাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শ্রমবাজার সৌদি আরবকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। বন্ধ অনেক শ্রমবাজার উন্মুক্ত হয়নি। মালয়েশিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ বাজার খুলে দেয়ার ব্যাপারে অনেকেই আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, এসব উদ্যোগ ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। মালয়েশিয়া থেকে একদেড় লাখ কর্মী নেয়ার আশ্বাস দেয়া হলেও চলতি বছরে সেখানে কর্মী গেছেন মাত্র কয়েক হাজার। একইভাবে সংযুক্ত আরব আমিরাতেও কর্মী যাওয়ার সংখ্যা কমেছে। ফলে বাংলাদেশের শ্রমবাজার কার্যত সৌদি আরবকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে বড় ঝুঁকি তৈরি করছে।

তাই কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করে বন্ধ শ্রমবাজার পুনরায় চালু করা, নতুন বাজার অনুসন্ধান, দক্ষতা উন্নয়ন ও শ্রমিক সুরক্ষা নিশ্চিতে সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে