মানবীয় চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয় চিকিৎসা এর সাথে শিক্ষা যুক্ত হয়ে আছে অধিকার নামক শব্দে। মানব সমাজে শিক্ষা, এই বিশ্বায়নের যুগে চমকপ্রদ অস্তিত্ব নিয়ে বিরাজিত। তাইতো বাংলাদেশ সরকার কীভাবে শিক্ষাকে সহজতর উপায়ে আয়ত্তে আনতে পারে তার প্রচেষ্টায় রত। তারই তাগিদে বর্তমান সরকার নতুন করে শিক্ষাক্রম তৈরি করেছে। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর ব্যাখ্যায় উঠে এসেছে যে, এই নতুন শিক্ষাক্রম জীবনমুখী শিক্ষা নিশ্চিত করবে বলে মনে করা হচ্ছে। বিদ্যমান পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা যে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেয়েছে, তা ছিল সৃজনশীল শিক্ষা। গবেষণায় উঠে এসেছে, সৃজনশীল শিখন প্রক্রিয়ার মূল সীমাবদ্ধতা ছিল, সৃজনশীল শিক্ষক তৈরির প্রক্রিয়ার সীমাবদ্ধতা। অর্থাৎ শিক্ষক প্রশিক্ষণের সীমাবদ্ধতা। তাই ধরে নিতে হবে, শিক্ষক প্রশিক্ষণের মান বাড়ানোর উপড় নির্ভর করে নতুন শিক্ষাক্রম তথা জীবনমুখী শিক্ষার বাস্তবায়ন।
সম্প্রতি ইউনেস্কোর ‘এশিয়া প্যাসিফিক রিজিওনাল ব্যুরো ফর এডুকেশন’ এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের অভাবেই বাংলাদেশে শিক্ষার গুণমান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। সাথে সাথে শিক্ষকের স্বল্পতা কাটানোও একটি বৈশ্বিক দাবী তো রয়েছেই। ১৯৯৪ সাল থেকেই ইউনেস্কোর উদ্যোগে ৫ অক্টোবরকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে সারা পৃথিবীতে। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নের মাধ্যমে শিক্ষকদের কাছ থেকে মানসম্মত শিক্ষার আশা করা, কেননা মান সম্মত শিক্ষা প্রদানে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা, পেশাগত অসমতা, ব্যবস্থাপনা কমিটির দৌরাত্ম্য এবং তার সাথে যুক্ত আছে শিক্ষার্থীদের অমনোযোগিতা, অসদাচারণ, অনিয়মিত উপস্থিতি এবং সর্বোপরি শিক্ষার্থীদের মোবাইল আসক্তি। বিশেষ করে কোভিড পরবর্তী শিক্ষার অবস্থা একটা শোচনীয় পর্যায়ে উপস্থিত হয়ে শিক্ষকতা পেশাটাই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে অসহনীয় অবস্থায় পরিণত হয়েছে এবং ক্রমাগতভাবে শিক্ষার গুণগত মানের অবনতি হয়ে চলেছে।
গত ৬ অক্টোবর ২০২৩ এর প্রথম আলোতে উপস্থাপিত বিশিষ্ট কলাম লেখক আনিসুল হক এর কলাম এর তথ্য মতে ‘গবেষণায় উঠে এসেছে যে, শিক্ষার মানের ক্রমাগত অবনতি হওয়ার কারণের মধ্যে, স্কুল থেকে শিক্ষার্থীরা ঝরে যায়, আবার প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করা শিক্ষার্থীরা অনেকে ঠিকভাবে পড়তে পারে না, অঙ্ক কষতে জানে না। শিক্ষা অধিদপ্তর ও ইউনিসেফের ‘ন্যাশনাল স্টুডেন্ট এসেসমেন্ট ২০২২’–এর প্রতিবেদন মতে, তৃতীয় শ্রেণির প্রায় ৬১ শতাংশ ও পঞ্চম শ্রেণির ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিত দক্ষতায় দুর্বল। এমনকি তাদের গণিতের দক্ষতা তৃতীয় শ্রেণির উপযোগীও নয়। তৃতীয় শ্রেণির ৫১ শতাংশ ও পঞ্চম শ্রেণির ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলায়ও দুর্বল এবং তাদের মানও তৃতীয় শ্রেণির উপযোগী নয়’। এইসব নিম্নমুখী শিক্ষার মান মূলত কোভিড সময়ের শিক্ষা ক্ষতিই মূল কারণ বলে মনে হয়। তাই বাস্তবতা নিরীক্ষণ করে মহামারিজনিত শিক্ষা ক্ষতি কাটিয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর জন্য অধিকতর উদ্যম প্রয়োজন। আশা করা যায়, নতুন শিক্ষাক্রম প্রাকপ্রাথমিক ও প্রাথমিক, মাধ্যমিক, এবং উচ্চ মাধ্যমিকের সব শ্রেণিতে চালু করা গেলে এসব সীমাবদ্ধতা ধীরে ধীরে কমে আসবে।
নতুন শিক্ষাক্রমকে জীবনমুখী শিক্ষা বলা হচ্ছে। মানে যে শিক্ষাকে জীবনের চলার পথে চলতে গিয়ে কাজে লাগানো যায়। সাধারণত কর্মমুখী শিক্ষাকেই বোঝায়, অথবা কোনো কাজ করতে করতে কোনো কিছু শেখাকে বোঝায়। এই দুই ক্ষেত্রে শিক্ষাকে জীবনের সঙ্গে মেলানোর একটা চেষ্টা থাকে, শিক্ষাক্ষেত্রে এই দুটিই প্রয়োজনীয় বিষয়। জীবনের সাথে সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা ভিত্তিক কাজগুলোর ধারাবাহিক ভাবে মূল্যায়নের আওতায় থাকবে এই শিক্ষাক্রমে। শিক্ষার্থীদেরকে সারা বছর শিখন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হবে, যার ফলে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত থাকার একটা তাগাদা অনুভব করবে, তাই অনুপস্থিতির হার কমে আসবে বলে ধারণা করা যায়। উদাহারণ স্বরূপ উল্লেখ করা যায় ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে নিজের কাজে ভাত রান্না, ডিম ভাজি, আলু ভর্তা এরকম ১০ টি অভিজ্ঞতা, অর্জন করা, ৭ম শ্রেণিতে সব্জি, ডাল, মাছ রান্না এরকম ১০টি অভিজ্ঞতা অর্জন করা, এভাবে শিক্ষার্থীরা অভিভাবকের সাহায্য নিয়ে বাড়িতে অভ্যাস করে শ্রেণি শিক্ষকের কাছে তা শেয়ার করে অভিজ্ঞতা অর্জন করবে। শ্রেণি শিক্ষককেও এসব বিষয় প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রস্তুত হওয়া প্রয়োজন। তবে সরকার ইতিমধ্যে শিক্ষক প্রশিক্ষণের কাজ তড়িৎ গতিতে শুরু করেছে। এই শিক্ষাক্রমে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো শিক্ষার্থীরা যে পরীক্ষার ভারে ভারাক্রান্ত ছিল তা থেকে মুক্তি মিলবে অর্থাৎ পরীক্ষা কমানোর চেষ্টা রয়েছে।
নতুন শিক্ষাক্রম গত জানুয়ারি থেকে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে শুরু হয়েছে। আগামী বছর দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে শুরু হবে। এরপর ২০২৫ সালে চতুর্থ, পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে চালু হবে। ২০২৬ সালে একাদশ এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে চালু করা হবে বলে মাউশির ওয়েবসাইটে বর্ণিত রয়েছে।
নতুন শিক্ষাক্রম শুরুর কয়েক মাস পর মাউশি, সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশ্যে বিস্তারিত করণীয় উল্লেখ করে একটি নির্দেশনা জারী করেছে। উক্ত নির্দেশনা পত্রে শিক্ষার্থীদের জন্য, শিক্ষকদের জন্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের জন্য এবং অভিভাবকের জন্যও নির্দেশনা রয়েছে। শিক্ষার্থীদের নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে নিয়মিত বিদ্যালয়ে যাওয়া, শ্রেণিকার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা, সরকার কর্তৃক প্রদত্ত শিখন সামগ্রী ঠিকমতো যথাসময়ে সংগ্রহ করা, এনসিটিবি প্রণীত পাঠ্য পুস্তক ও সম্পুরক পঠন সামগ্রী পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা, নতুনকে গ্রহণ করার উপযুক্ত মানসিকতা বজায় রাখার চেষ্টা করা, শ্রেণি শিক্ষকের সাথে স্কুল সম্পর্কিত সমস্যা নিয়ে আলাপ করা, অবসর সময়ে সৃজনশীল বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা, শিক্ষক ও অভিভাবকের সাথে সমস্যা সমাধান জনিত আলাপের মেলবন্ধন নিয়ে চলা, নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে শিখনের সর্বক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করা, স্কুলে গঠিত ক্লাবগুলোর মধ্যে অন্তত দুটি ক্লাবে সম্পৃক্ততা থাকা।
শ্রেণি শিক্ষকদের নির্দেশনায় রয়েছে–গতানুগতিক শিক্ষককেন্দ্রিক পদ্ধতির বদলে শিক্ষার্থীদের সহায়তার ভূমিকা পালন করা, ‘হোম ভিজিট’ ‘উঠান বৈঠক করা’ এবং বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা, পাঠ সংশ্লিষ্ট উপকরণ সহ শিখন শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা করা, অনুসন্ধানমূলক কাজে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, ডায়রি ব্যবহারে উৎসাহিত করা, মূল্যায়নের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা, সততা ও নৈতিকতা বজায় রাখা, একীভূত ও অন্তর্ভূক্তিমূলক শিখন পরিবেশ নিশ্চিত করা, যাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিখনের উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়, প্রতি সপ্তাহের সমস্যা সমূহ নিয়ে প্রতিষ্ঠান প্রধানের সাথে আলোচনা করা এবং কৌশল নির্ধারণ করা, শিক্ষক নিজেকে শিক্ষার্থীদের ফেসিলিটেটর বা সহায়কের ভূমিকায় রাখা, ধারাবাহিক মূল্যায়নের নীতি অনুযায়ী মূল্যায়ন করা ও মূল্যায়নের রেকর্ড সংরক্ষণ করা, স্লো লার্নার ও এডভান্সড লার্নার চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী শিখন কার্যক্রম পরিচালনা করা।
প্রতিষ্ঠান প্রধানদের করণীয় নির্দেশনায় রয়েছে এনসিটিবির দেওয়া রুটিন বা গাইড লাইন অনুযায়ী প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষকদের মাধ্যমে শ্রেণিকার্যক্রম নিশ্চিত করা, শিক্ষকদের কাছে প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করা, শিক্ষকদের সংগে নিয়মিত বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করা, শিক্ষার্থীদের হাতে তৈরি উপকরণ নিয়ে অভিভাবক, শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে শিখনকালীন ও সামষ্টিক মূল্যায়ন শেষে শিক্ষা উপকরণ মেলার আয়োজন করা, বছরে তিনটি অভিভাবক সমাবেশ নিশ্চিত করা, অভিভাবকদের নিয়ে গ্রুপ করে শ্রেণি কার্যক্রম দেখার ব্যবস্থা করা, যেসব শিক্ষকদের লেখার অভ্যাস আছে তাদের লেখনীতে নতুন কারিকুলামের ইতিবাচকতা তুলে ধরার জন্য উৎসাহিত করা, প্রতি তিন মাসে কমপক্ষে একবার শিক্ষকদের জন্য ইন–হাউজ প্রশিক্ষণ এর ব্যবস্থা করা, কারিকুলাম বাস্তবায়নের স্লোগান প্রচার করার ব্যবস্থা করা সহ সামগ্রিক তদারকি ও সমন্বয় করা। শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ে বিভিন্ন ক্লাব গঠন ও ক্লাব সক্রিয় রাখায় উৎসাহিত করা।
অভিভাবকদের জন্য নির্দেশনায় আছে, সন্তানদেরকে সময় দেওয়া, বাড়িতে সন্তানদের নিজেদের ছোট ছোট কাজ করানোতে উৎসাহ দেওয়া, সন্তানদের স্কুল উপস্থিতি নিশ্চিত করা, প্রাইভেট বা কোচিংয়ে নিরুৎসাহিত করা, সন্তানদের মূল্যায়নের বিষয়ে নিরপেক্ষতা, সততা এবং নৈতিকতা বজায় রাখা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আয়োজিত মতবিনিময় সভায় উপস্থিত থাকা এবং সন্তানদের গতিবিধি লক্ষ্য রাখা, কারিকুলাম বাস্তবায়নে অভিভাবকের যে দায়িত্ব তা সঠিকভাবে পালন করা।
এসব নির্দেশনা যদি প্রত্যেকের স্ব স্ব অবস্থান থেকে সঠিকভাবে পালিত হয় তবে শিক্ষার মান এর উত্তরণ ঘটবে বলে প্রতীয়মান হয়। এসডিজি তথা ‘টেকসই উন্ন্য়ন পরিকল্পনা’ এর চার নম্বর লক্ষ্য হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য মান সম্মত শিক্ষার ব্যবস্থা করা, সেক্ষেত্রে নতুন শিক্ষাক্রমকে গুরুত্ব দিয়ে হারানো শিক্ষার মানকে উন্নত করা প্রয়োজন।
ইউনেস্কোর রিপোর্ট অনুযায়ী ‘মান সম্পন্ন শিক্ষার’ সংজ্ঞা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সত্তার উন্নয়ন, তাদের মেধা, মানসিক ও শারীরিক সামর্থ্যের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন, ওরা জ্ঞান লাভ করবে, মানবিক মূল্যবোধ সমৃদ্ধ হবে, দক্ষতা অর্জন করবে, সৃজনশীল হবে, সামাজিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ করবে এবং শিক্ষার্থীদের ভেতরে জীবনব্যাপি নিরন্তর শেখার আগ্রহ তৈরি হবে। নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়নে শিক্ষার্থীরা সেভাবেই গড়ে উঠবে এ প্রত্যাশা বর্তমান শিক্ষা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ বর্তমান সরকারের। তাই ‘নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন’ সময়ের চাহিদার দাবিদার।
লেখক: প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ