শিক্ষার্থীদের একটা রক্তাক্ত সফল অভ্যুত্থানের ফলাফল আজকের নিপীড়নমুক্ত বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ভার্ষন২। স্বাধীনতার পর বেহাত হওয়া সুযোগ আবার দুয়ারে নাড়া দিচ্ছে যেমনটি আমরা চাই তেমন দেশ গড়ার। শিক্ষার্থীরা অদম্য সাহসে বুকের রক্ত দিয়েছে। এতে দেশ নতুন এক সম্ভাবনার প্রান্তে এসেছে অনেক আশার আলো নিয়ে। জনকল্যাণময় জীবনের হাতছানিতে ভরপুর হয়ে। সব অন্যায় অবিচার মুক্ত সাম্য মৈত্রীর বিকাশে। কতগুলি মারাত্মক সমস্যা দেশের পরতে পরতে অনুপ্রবেশ করে জমাটবদ্ধ হয়ে মন ও মানসিকতাকে পুরো পরিবর্তন করে দিয়েছে। বিশেষ করে জননীতিধারী, প্রশাসন ও সরকারী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িতদের। তবে আশার আলো হলো, এই অভ্যুত্থানের সূচনাকারী ও সফলতার প্রান্তে যারা নিয়ে গেছে তারা সবাই কলুষিত হয়নি। এরা সবাই তরুণ এবং মানুষের ও দেশ জাতির কল্যাণে উজ্জীবিত শিক্ষার্থীগণ। নতুন ভার্সনের বাংলাদেশ গড়তে গেলে পুরোনো কিছু কাসুন্দি ঝেড়ে ফেলতে হবে। নতুনভাবে সাজাতে হবে। কিছু বিষয় যার দ্রুত সংস্কার প্রয়োজন।
১. রক্তে ভেজা সংবিধানের চার মূলনীতি যথাযথভাবে ফিরিয়ে আনতে হবে। কখনও ভুলে গেলে চলবে না এ দেশটা শুধুমাত্র মুসলিমদের না, এটা অনেক বিশ্বাসীদের জন্মভূমি। শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের সুযোগ নিয়ে অন্যের উপর স্বীয় বিশ্বাসের আচার চাপানো হলো জুলুম। আমাদের সবার একাট মাত্র পরিচয় আমরা বাংলাদেশী।
২. বাংলাদেশে আরবী মুসলমানদের, সংস্কৃত সনাতনীদের, পালি বুদ্ধদের বা ইংরাজী খৃষ্টানদের মাতৃভাষা নয়। বরং বিশ্বাস সংশ্লিষ্ট আচারের ভাষা। বাংলা হলো ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা, কিছু আদিবাসী ছাড়া। অতএব আরবীকে সবার উপরে চাপানো যাবে না। সাথে সাথে আদিবাসীদের মাতৃভাষাগুলোকেও সমন্বয় করতে হবে। যেমনি করে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে স্পেনিশ ভাষার প্রাধান্য দেয়া হয়।
৩. সংবিধানের শুরুর ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’ কে সবার গ্রহণযোগ্য করে কথার পুনঃবিন্যাস করা যায়। তাছাড়া রাষ্ট্রের কোন ধর্ম কি করে থাকে। এরশাদ এটা মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিকে সুড়সুড়ি দিয়ে তার ক্ষমতা সংহত করার জন্য করেছিল। বুঝেও আমাদের গোড়ামির জন্য আমরা সহ্য করছি।
৪. অর্ডিনেন্সের মাধ্যমে বা সুপ্রীম কোর্টের রিভিউর মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আবার চালু করা। যুক্তরাষ্ট্রে অন্যরকম তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিদ্যমান। তা হলো সিনেট জয়েন্ট কমিটি দেশে নির্বাচন ও নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনা করে।
৫. কথা বলার, আন্দোলন করার, প্রতিবাদ ও সমালোচনাসহ সব মৌলিক মানবাধিকার যা সংবিধানে আছে তা কোনোভাবে বিঘ্নিত করা যাবে না।
৬. যত ধরনের সব কালা কানুন বাতিল করতে হবে। উপনিবেশ আমল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত।
৭. সরকারকে দানব বানাবার উৎস সংবিধানের ৭০ ধারা বাতিল করতে হবে। এধারা নির্বাচিত জন প্রতিনিধিদের দলীয় ক্রীড়নকে পরিণত করে। এক ব্যক্তি তথা প্রধানমন্ত্রীকে নিরংকুশ ক্ষমতা প্রদান করে।
৮. সংবিধান অনুযায়ী ন্যায়পাল নিয়োগের ব্যাবস্থা করতে হবে ও প্রশাসনের সর্বস্তর জনগণের নির্রাচিত প্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত হতে হবে। যা সংবিধানে আছে।
৯. সব ধরনের রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমগুলোকে স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে ও প্রেস সেন্সরশীপ বাতিল করতে হবে।
১০.রাষ্ট্রীয় আমলা ও কামলাদের যথাযথ আইনানুগ ও সংবিধান সম্মতভাবে কর্ম সম্পাদন নিশ্চিত করতে হবে। এবং সকল সরকারী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের কম্যুনিটি পরীবিক্ষণের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এবং জনগণের অর্থে বিলাসিতা বর্জন করতে হবে।
১১. কৃত্য পেশা ও সমতা ভিত্তিক বেসামরিক প্রশাসন বিন্যাস করতে হবে। কোন ক্যাডার অন্য ক্যাডারের কাজের পৌরহিত্য করতে পারবে না। সিনিয়র পলিসি পুলের পদ গুলিতে সব ক্যাডারের মেধাভিত্তিক অধিগমন নিশ্চিত করে এক ক্যাডারের আধিপত্য রহিত করতে হবে। ক্যাডার সার্ভিস শুরুর মূল নীতিগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।
১২. বিচার বিভাগের পুরোপুরি স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণসহ সংবিধান রক্ষার অভিভাবক করতে হবে। বিচারক নিয়োগ ইত্যাদির জন্য জাতীয় জুডিসিয়াল কমিশন সুচারুভাবে কার্যকরী করতে হবে। বিচারকদের জন্য কোড অব কনডাক্ট ও এথিক্স যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
১৩. পেশাজীবী ও অন্যান্যদের দলীয় অঙ্গসংগঠন এবং শিক্ষার্থীদের জন্যও তা নিষিদ্ধ করতে হবে।
১৪. সরকারী চাকুরীজীবীদের সব সময় চাকুরী বিধিমালা অনুযায়ী চলতে হবে যা হবে দল বা স্বার্থ নিরপেক্ষ। এবং কখনও জননীতিধারীদের মত কথা বলবে না যা হবে অসদাচরণ।
১৫. দেশের সব রাজনৈতিক দল গুলোকে পুরোপুরি গণতন্ত্রায়ণ করতে হবে। সদস্য সব নিবন্ধিত হতে হবে। নেতা প্রাথমিক থেকে স্তরে স্তরে নির্বাচনের মাধ্যমে হবে। প্রতিটি দলকে এক একটি ইনস্টিটিউট হতে হবে। যেখানে একাডেমিক ও গবেষণার কার্যক্রম চলবে রাষ্ট্র পরিচালনা সংশ্লিষ্ট সব ক্ষেত্রে। শো ডাউন আর মাস্তানী ও নির্মূল সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
১৬. দেশের সব আইনগুলোকে উপনিবেশিক নিগঢ় থেকে বের করে স্বাধীন দেশের যুগোপযোগী করতে হবে। সেগুলোকে অসচ্ছতাগুলো নির্মূল করতে হবে যা হলো দুুর্নীতির সোপান। বিশেষ করে দৈনন্দিন জীবন সংশ্লিষ্ট আইন সমূহ। যেমন ট্রাফিক আইন।
১৭. বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও বিদ্যাপীঠগুলোকে রাজনীতির থাবা মুক্ত করতে হবে এবং আন্তর্জাতিকমানের অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। তিন স্তরের কারিকুলাম পরিমার্জন ও হালনাগাদ করতে হবে। তথ্য ও তত্ত্ব ভিত্তিক এবং আন্তর্জাতিক মানের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ করে করতে হবে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অনুযায়ী। প্রাথমিক শিক্ষা হবে পারঙ্গম সুনাগরিক বানানো, মাধ্যমিক হবে সুনাগরিককে কর্ম দক্ষ এবং স্নাতক ও স্নাতকোত্তর হবে পন্ডিত করার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়কে সত্যিকার অর্থে বিশ্বায়ন করার জন্য বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষক আনতে হবে। যেমন করেছে থাইলেন্ডের মাহিদল বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শুধুমাত্র জ্ঞান দান করা নয়। তার সাথে সাথে জ্ঞানের বিকাশ করা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বানাতে হবে বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানদণ্ড।
১৮. বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে আরও গণমুখী করতে হবে এবং এর সব প্রতিষ্ঠানগুলোকে সকল প্রায়োগিক ক্ষেত্রের জাতীয় মানদণ্ডে পরিণত করতে হবে। তাছাড়া সশস্ত্র বাহিনীর আরেক জাতীয় দায়িত্ব হবে শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া। জাতিকে সুশৃংখল দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরের এই বিশাল কর্মযজ্ঞ বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর পিছে জাতীয় অর্থ ব্যয় যথার্থ করবে।
১৯. কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেষ্ট বা স্বার্থের দ্বন্দ্ব সম্পর্কে আমরা অজ্ঞ বা উপেক্ষা করি। সবচেয়ে বড় কনফ্লিক্ট হলো দেশের আইন প্রণেতাগণ ক্ষেত্র বিশেষে আর্থিক ও নির্বাহী কর্মকাণ্ড করেন। যা সংবিধান ভায়োলেশন।
২০. রাষ্ট্রের দস্যুতা ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীর মত সংশোধনী আনতে হবে।
২১. আরও অনেক ক্ষেত্র বা বিষয় আছে যা মতামত গ্রহণ ও ফোকাস গ্রুপ আলোচনার মাধ্যমে সংগ্রহ ও বিতর্কে নির্ধারণ করা যেতে পারে।
এই কাজগুলো যদি আমরা যদি পর্যায়ক্রমে করতে পারি তবে এই গণঅভ্যুত্থানের লক্ষ্য পূরন করে আমাদের দেশকে কল্যাণময় সুখী করতে পারবো যা আমাদের পূর্বপুরুষগণ মানসচক্ষে দেখে ছিলেন। ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, ও যে সকল দেশের রাণী আমার জন্মভূমি’।
লেখক : ইন্টারনিস্ট ও নেফ্রোলজীস্ট এবং গবেষক; প্রাক্তন অধ্যক্ষ,
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও খণ্ডকালীন শিক্ষক, চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়