নতুন বাগান শহরে

শরণার্থী, নারীবাদ এবং একজন নারী ভ্রমণকারীর গল্প

রূপা দত্ত | শনিবার , ৮ জানুয়ারি, ২০২২ at ৮:১৪ পূর্বাহ্ণ

নতুন স্থান, নতুন পরিবেশ, নতুন সংস্কৃতি, নতুন মানুষ… এতসব নতুন এক হলে ভ্রমণের ক্লান্তি শরীর ভুলে যায়। তা যদি না হত, সারারাতের বাসযাত্রার পরে বিশ্রাম না নিয়ে নতুন এলাকা ঘুরে বেড়ানো অসম্ভব ছিল।
নতুন বাগান শহরে আকাশছোঁয়া দালান খুব একটা নেই, দুই চারতলা বিল্ডিং বড়জোর। ভূমিকম্পনপ্রবণ এলাকা বলে হয়তো এখানে কেউ উঁচু দালান করে না। হাজার বছরের পুরানো এই শহর গত এক সহস্রাব্দে ছোটবড় কয়েকশো ভূমিকম্পের ধকল সহ্য করে আজও টিকে আছে। ঘুরতে ঘুরতে আমি আর মিকা একটি বৌদ্ধ মন্দিরের সামনে এসে হাজির হলাম। মন্দিরের বাইরে রাখা আছে প্রাচীন এই মন্দিরের ভগ্নাবশেষের ছবি। আমরা যে মন্দিরটি দেখছি সেটি পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে। মন্দিরের ভেতরে ধ্যানরত গৌতম বুদ্ধের প্রতিমা। মন্দিরের সামনে বড় একটা ঘন্টা ঝুলানো, ঝলমলে পাথরের কাজ করা মন্দিরের চূড়া। স্থানীয়রা উৎসব উপলক্ষ্যে কাগজ কেটে সাজিয়েছে মন্দির প্রাঙ্গণ। এই মন্দির থেকে বের হয়ে আমরা গেলাম পাশের আরেকটি মন্দিরে। এই মন্দিরের পুনঃনির্মাণের কাজ এখনো চলছে তাই ভেতরে ঢোকা যায়নি। এই এলাকায় ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে অনেক বড় ভূমিকম্প হয়, যে ভূমিকম্পে প্রায় ৪০০ মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘুরতে ঘুরতে ড্রাম বাজানোর শব্দ কানে এলে সেই শব্দকে লক্ষ্য করে আমরা এগিয়ে একটা প্রাচীন বট গাছের নিচে এসে থামি। রাস্তার ওপারে জঙ্গল মত টিলার উপরের মন্দির থেকে ভেসে আসছে শব্দ। আমরা সিঁড়ি ভেঙ্গে মন্দিরে উঠতে শুরু করি। পুরানো মন্দিরের ভাঙ্গা সিঁড়ি, ঝোঁপঝাড়ে ঢাকা শ্যওলা পরে কালো হয়ে যাওয়া পাথরের কয়টা পৌরাণিক মূর্তি আর বাতাসে দ্রুম দ্রুম করে ড্রামের অনিয়মিত গম্ভীর শব্দ কেমন একটা গা ছমছমে পরিবেশ তৈরি করেছে। উপরে উঠে দেখি মন্দিরের বাইরে কয়েকটি অর্ধবৃত্ত ঢোলাকৃতির কাঠ আর চামড়ার তৈরি ড্রাম রোদে দেয়া। গেরুয়া কাপড় পরা মন্দিরের একজন ভান্তে সেগুলো বাজিয়ে দেখছে ঠিক আছে কিনা। ড্রাম পরীক্ষা করে দেখার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। ভান্তে নিজের কাজ করে যাচ্ছিলেন, আমাদের দিকে নজর দিলেন না। এখানে সময় কেমন যেন স্থির হয়ে গেছে। আমরাও আগ বাড়িয়ে আর কথা বলার চেষ্টা করে ওনার কাজের ব্যাঘাত ঘটাতে চাইলাম না। পুরো মন্দির জুড়ে কেমন এক গাম্ভীর্য। পা টিপে টিপে মন্দিরের চারপাশে একটা চক্কর দিয়ে আবার ড্রামের কাছে এলাম। এবার আরেকজন কমবয়সী ভান্তেকে দেখতে পেলাম। আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। আমাদের মনের উপরের চাপটা কমে এলো। কথা বলে জানতে পারলাম বছরের শেষ দিনে মন্দির পরিষ্কার করছেন ওনারা। বিদায় নিয়ে আমরা সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করি। কয়েক সিঁড়ি নামার পরে দেখি কোথা থেকে হঠাৎ দুই তিনটা বানর এসেছে কাছাকাছি। তাকিয়ে দেখি আমাদের যেন দাঁত কেলিয়ে খিস্তি দিচ্ছে। ভয়ে আমরা দু’জন সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামতে শুরু করলাম। বানরগুলোও আমাদের সাথে সাথে নামতে লাগলো। আমি, মিকা দুজনেই দু-একবার হোঁচট খেলাম। টিলার একধার থেকে পানির ভার নিয়ে উঠে আসতে থাকা একজন স্থানীয় নারী, আমাদের অবস্থা দেখে বানরগুলোর দিকে তাকিয়ে বকা দেয়া শুরু করল। আমরা ততক্ষণ রাস্তায় চলে এসেছি। ওনার বকা খেয়ে হোক অথবা আমরা রাস্তায় নেমে যাওয়াতে হোক, বানরগুলো আর আমাদের সাথে এলো না। রাস্তার ওপাশ থেকে দোকানদার দিদি আমাদের ডাকতে লাগল। বট গাছের নিচে টেবিল পেতে খাবারের আয়োজন। দারুণ জায়গা। বেলা হয়েছে, পেটের ভেতর ক্ষিধে টের পেলাম। গরম গরম ভাত আর মুরগির মাংস দিতে বললাম। গত কয়েকবছর ধরে আমি নিরামিষ খাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু তিন চার বছর পর আর মেনে চলতে পারলাম না। না, ধর্মীয় কারণে নিরামিষ খাইনি। আবার প্রাণি হত্যা মহাপাপ সেটা ভেবেও না। আমার নিরামিষ খাওয়ার কারণ ছিল আমার ব্যক্তিগত কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানো। ব্যাক্তিগত কার্বন ফুটপ্রিন্ট মানে, আমি আমার দৈনন্দিন জীবনযাপনে কার্বন, মিথেনসহ অন্যান্য গ্রিন-হাউজ গ্যাস কতটুকু প্রকৃতিতে ছাড়ছি সেটার হিসাব। বাণিজ্যিক ফার্মগুলো শস্য উৎপাদন থেকে শুরু করে গবাদি পশু বা হাঁসমুরগি কিংবা ফুলের চাষও যে প্রক্রিয়ায় করে তাতে অনেক গ্রিনহাউজ গ্যাস উৎপাদিত হয় এবং পরিবেশে মেশে। আবার নিত্যদিন এই যে অপ্রয়োজনীয় সব জিনিস কিনছি ঘরের জন্য, নিজের জন্য; এই যে পোশাক কিনছি একের পর এক, সবকিছুর মাধম্যেই বাড়িয়ে যাচ্ছি গ্রিন-হাউজ গ্যাস নিঃসরণ। কিন্তু বান্দরবানের গভীরে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি চুলা জ্বালানো আর নিতান্ত প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া খুব বেশি গ্রিন-হাউজ গ্যাস ওরা পরিবেশে ছাড়ে না। ওরা তো আমার আমাদের মতো প্রযুক্তি নির্ভর না। তবে ওখানে নিরামিষ খেয়ে থাকা একপ্রকার অসম্ভব কেননা পাহাড়ের আদিবাসীদের রান্নার অন্যতম উপকরণ হল নাপ্পি যা চিংড়ি মাছ দিয়ে তৈরি হয়। আবার যেদিন মাংস রান্না করে সেদিন আর কিছুই রান্না করে না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। তাই কোন নিরামিষভোজী থাকলে ঘরের মানুষকে একটু বেকায়দায় পড়তে হয়। তবে ওখানে যেহেতু ফার্ম না, তাই প্রকৃতির উপর চাপ কম। বন থেকে শিকার করে আনা খাবার সকল অবস্থাতেই একদম নিষিদ্ধ। বনের পশুপাখি এমনিতেই নাই হয়ে গেছে, আমরা শহুরে মানুষ গিয়ে খাওয়া শুরু করলে তাতে প্রকৃতির উপর প্রায় শতভাগ নির্ভরশীল পাহাড়ের মানুষগুলোকে শিকারে উৎসাহী করা হবে। এদিকে থাইল্যান্ডের কাজের কারণে খাওয়াদাওয়ার ঠিক ছিল না, যখন যা পাওয়া যাচ্ছে তাই খেতে হত। আর ওরা আবার সবকিছুতেই হয় মাংস বা ডিম দেয়, যেগুলো আসে আবার ফার্ম থেকে। এ-এক বড় মুশকিল। নিরামিষ খেতে চাইলে উপায় নিশ্চয়ই আছে। তবে যারা মেনে চলে, তাদের জন্য সব জায়গায় হালাল খাবার খুঁজে পাওয়া মুশকিল। যেক্ষেত্রে অনেককে দেখেছি সাথে করে শুকনো খাবার রাখতে।
তো যাই হোক, আমাদের খাবার চলে এলো। ভাত, মুরগির সাথে দেখি আরও চার পদ বাড়তি দিয়েছে। টুকরো ফালি করে কাটা আধা-পাকা টক আম আর পেঁয়াজের সালাদ, মুগ এবং এমন কোন ডালের দুই তিন দিন বয়সি চারা (বিন স্প্রাউট) সাথে সরু করে কাটা টকজাতীয় কোন ফারমেন্টেড ফলের সালাদ, আমের টক আচার, চুকাই এর তরকারি। খাবারে টক স্বাদের প্রাধান্য বেশি। মুরগির মাংস দেখে মনে হল অনেক ঝাল হবে। মিকা খুব চিন্তায় পড়ে গেল। কিন্তু, মুখে দিয়ে দেখি একদম ঝাল নাই। ঝালবিহীন লাল মরিচ ব্যাবহার করেছে। তবে মাংসের ঝোলটা পুরোটাই তেল, মানে তেলের ঝোল। এই অঞ্চলের খাবারের সাথে চট্টগ্রামের টেকনাফের দিকের খাবারের বেশ মিল মনে হলো, কেবল ঝাল ছাড়া। পেটপুরে আরাম করে খেতে খেতে দোকানদার দিদির সাথে গল্প করলাম। দিদি জানালো এখানে মেয়েরাই বেশি ব্যবসা- দোকানপাটের সাথে যুক্ত। উনি জানালেন আমরা যদি শহরের বাইরের মূল প্রত্নতাত্ত্বিক মন্দির ঘুরতে যেতে চাই, তাহলে বাই-সাইকেল বা মটর-সাইকেল নিয়ে গেলে খরচ বাঁচবে এবং নিজের মতো করে ঘুরে দেখতে পারবো। আমাদের হোস্টেলের কাছেই নাকি ভাড়া নেয়ার দোকান আছে। আমি আবার সাইকেল চালাতে জানি না আর আমাদের কেউই মোটর সাইকেল চালাতে জানি না। কার ভাড়া করার টাকা আমাদের দুইজনের কারো কাছে নাই। ঘুরতে এসে বাহনের চিন্তায় পড়ে গেলাম। দিদি বলে দিলেন ভাল করে দেখেশুনে ভাড়া নিতে, তা নইলে অনেক সময় খারাপ গাড়ি দিয়ে পরে মিথ্যে বলে জরিমানা আদায় করে। আমরা পেটপুজো শেষ করে গাড়ি ভাড়া নেয়ার দোকানে এলাম। সেখানেও এক দিদি দোকান চালাচ্ছে। আমাদের সমস্যার কথা শুনে উনি পরামর্শ দিলেন স্কুটি ভাড়া নিতে, যেটা অটো চলে। সাইকেল চালাতে জানলেই হবে। মিকা রাজি হল একটু চালাতে পারে কিনা একটু টেস্ট করে দেখতে। আমি পেছনে ধরে রাখলাম, মিকা উঠে বসে ইঞ্জিন চালু করল। তারপর কিছুদূর গিয়ে ব্যালেন্স হারিয়ে থামিয়ে দিল। এভাবে কয়েকবার চেষ্টার পর জানালো এই জিনিস ও চালাতে পারবে। আমার আফসোস হতে লাগলো সাইকেল চালানো শিখিনি বলে। ছোটবেলায় বাবা বলেছিল সাইকেল চালাতে হবে না। বড় হবার পর দু-একবার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু কেন জানি শিখতেই পারিনি। সবাই বলে সাইকেল চালানো খুব সোজা, কিন্তু আমি এই সহজ জিনিস শিখতে ব্যর্থ হলাম আর এখন আফসোস করছি।
দোকানদার দিদি জানিয়ে রাখলো, আগামী দুইদিন দোকান বন্ধ থাকবে। আমদের দেখিয়ে দিল দোকানের বাইরে কোথায় স্কুটি এসে রাখতে হবে, কোথায় চাবি জমা দিতে হবে। স্কুটি ভাড়া করে আমরা মহা আনন্দিত। আমাদের যেন পাখা গজালো। আবার আমরা ১০৪ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রত্নভূমি নিজেদের ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়াব।
ইমেইল- rupsbd@gmail.com

পূর্ববর্তী নিবন্ধজয়নব, একজন নারী মিলিশিয়া
পরবর্তী নিবন্ধগণতন্ত্র ও ভোটাধিকার রক্ষায় সংগ্রাম গড়ে তোলার আহ্বান