চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন বলেছেন, নতুন বাংলাদেশ নির্মাণে অর্থনৈতিক বৈষম্যকে দূর করতে হবে। সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি জনগণকে ক্ষমতায়ন করতে হবে। ফলে প্রশাসনিক কার্যক্রমে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাবে। আমাদের সমাজে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক দুইভাবে দুর্র্নীতি হয়ে থাকে। অনেক অফিসার আছে যারা দুর্নীতিতে যুক্ত নয় কিন্তু প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি করে বিধায় এটার সাথে যুক্ত সবাই দুর্নীতির আওতায় চলে আসে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র–জনতার মূল প্রত্যাশা ছিল–একটি স্বচ্ছ, জবাদিহিমূলক, দুর্নীতিমুক্ত ও বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ। এ নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে আমাদের সকলকে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। এছাড়া মুদ্রাপাচার রোধে ব্যবসা ও বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার কথাও বলেন বিভাগীয় কমিশনার। গতকাল সোমবার আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী দিবস উপলক্ষে জেলা শিল্পকলা একাডেমীর অডিটরিয়ামে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। সভায় চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. তসলিম উদ্দিন বক্তব্য দেন। দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে করণীয় শীর্ষক আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন সিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হুমায়ূন কবীর, রেঞ্জ পুলিশ চট্টগ্রামের অতিরিক্ত ডিআইজি সঞ্জয় সরকার, চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার রায়হান উদ্দিন খান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ। দুর্নীতিবিরোধী ধারণাপত্র পাঠ করেন সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক)-টিআইবির প্রতিনিধি মো. মিরাজুল ইসলাম। সভায় সভাপতিত্ব করেন দুর্নীতি দমন কমিশন, চট্টগ্রামের বিভাগীয় পরিচালক মোহা. আবুল হোসেন। স্বাগত বক্তব্য দেন, দুর্নীতি দমন কমিশন, সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম–১ এর উপপরিচালক মো. নাজমুচ্ছায়াদাত।
চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. তসলিম উদ্দিন বলেন, আমাদের ছেলে–মেয়েরা যখন বলে তার ওই সহকর্মী ওই গাড়িতে করে আসছে। তারও ওরকম লাগবে। ব্রান্ডের শাড়ি পড়েছে একজন। তা দেখে আরেকজনের স্ত্রী সেটি তার হাসবেন্ডকে দেখিয়ে দিচ্ছে। আমরা এসব কী করে বন্ধ করব? টেন্ডার হলেই তদবির শুরু হয়। এটা ওকে দিতে হবে। আমাদের এসব সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। দুর্নীতি বিষয়ে পরিবারসহ সর্বস্তরে সচেতন হতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে তা যদি না হতো তাহলে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুরের চেয়ে উন্নত দেশে পরিণত হতে পারত। বিগত ১৫–১৬ বছরে খুনী হাসিনার আমলে বিপুল পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে এই দেশে। হাসিনার একজন পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। সালমান এফ রহমানকে বলা হয় দুর্নীতির গডফাদার। আমাদের বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ১২ থেকে ১৫ হাজার বিলিয়ন ডলার পাচার করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের কাজ ছিল সে দুর্নীতিগুলোকে বের করে নিয়ে আসা। কিন্তু এ দুর্নীতি দমন কমিশনই সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। এটা সত্য এবং এটা মেনে নিতে হবে। দুদককে সে জায়গা থেকে বের হয়ে এসে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সবসময় আপনাদের পাশে থাকবে। আপনাদের যদি মনে হয় কাজ করতে সমস্যা হচ্ছে, রাজনীতিবিদরা, প্রভাবশালীরা আপনাদেরকে অসহযোগিতা করছে, আপনাদের বাধা দিচ্ছে, আপনারা প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন তাদের। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য এবং সুন্দর বাংলাদেশের বিনির্মাণের জন্য ছাত্র সমাজ রক্ত দিয়েছে। আপনারা সেসব প্রভাবশালী নেতাদের সামনে নিয়ে আসেন। ছাত্রসমাজ তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবে। তিনি বলেন, এ দুর্নীতির কিছু কারণ রয়েছে। ব্যক্তি চাহিদায় দুর্নীতির জন্য আগ্রহী করে তুলে। পরিবার দুর্নীতি করতে আমাদের আগ্রহী করে তুলে। বিগত ১৫–১৬ বছরে ফ্যাসিবাদের সময় এ দুর্নীতির মাধ্যমেই বাংলাদেশকে একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এভাবেই নষ্ট হয়েছে। আমরা উঠে দাঁড়াতে পারছি না এ দুর্নীতির কারণেই। দুর্নীতি হচ্ছে ক্যান্সারের মতো উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, আমাদের শরীরে যদি ক্যান্সার ধরা পড়ে তাহলে ধরে নেওয়া যায় মৃত্যু নিশ্চিত। দুর্নীতির বিষয়টিও এ রকম। তিনি আরো বলেন, ২০২৪ সালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশকে জাগ্রত করেছে এবং এ বাংলাদেশকে ন্যায়, সাম্য, দুর্নীতিমুক্ত, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য দুই হাজার ভাই জীবন দিয়েছে। হাজার হাজার ভাই রক্ত দিয়েছে। এ বাংলাদেশ বিনির্মাণে আপনাদের সহযোগিতা করতে হবে। আপনাদের নিজেদের দায়বদ্ধতা থেকে এ কাজ করতে হবে। অতিরিক্ত জেলা জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. কামরুজ্জামান বলেন, দুর্নীতি বলতে আমরা শুধু সরকারি দপ্তরকে মিন করে দেখি। অথচ নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে দুর্নীতি সীমাবদ্ধ থাকে না। তৃণমূলের বেসরকারি পর্যায়েও দুর্নীতি রয়েছে। পারিবারিকভাবে আমাদের এ দুর্নীতি মোকাবিলা করতে হবে। চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার রায়হান উদ্দিন খান বলেন, সবার সহযোগিতা থাকতে হবে। দুদকের ভূমিকা রাখতে হবে বেশি। সিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হুমায়ূন কবির বলেন, আপন ভাইও বিশ্বাস করে না আমার কাছে টাকা নেই। আমাদেরকে আগে সেখান থেকে বের হতে হবে। ফ্যাসিবাদ যেভাবে দূর করা হয়েছে সেভাবে আমরা সকলে মিলে দুর্নীতি মোকাবেলা করব। সভাপতির বক্তব্যে দুর্নীতি দমন কমিশন, চট্টগ্রামের বিভাগীয় পরিচালক মোহা. আবুল হোসেন বলেন, সংবিধানের ৭(১) এ বলা আছে প্রজাতন্ত্রের ক্ষমতার উৎস জনগণ। এ জনগণকে সাথে নিয়েই দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে হবে। একতার প্রয়োজন এ জন্য। আমাদের একতা গড়ে তুলতে হবে। জনগণই দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবে এটাই প্রত্যাশা। দিবসটি উদযাপন উপলক্ষ্যে চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি সংলগ্ন রাস্তায় (এম এম আলী রোড) মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।












