নতুন বছর হোক প্রত্যাশা পূরণের

আবুল কালাম বেলাল | শুক্রবার , ১ জানুয়ারি, ২০২১ at ৬:২৭ পূর্বাহ্ণ

করোনার মরণ থাবায় বিশ্ব এখন অস্থির। তার দ্বিতীয় ঢেউ শঙ্কিত করেছে মানববিশ্বকে। এমন ভয়ংকর সময়ে প্রত্যাশার আলো ছড়িয়ে পুবাকাশে আজ উদিত হয়েছে নবসূর্য। এসেছে নতুন বছর ২০২১। অনেক আশা আর স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে নতুন বছর। আজ প্রথম দিন। এদিনে নতুন প্রতীতি-পরিকল্পনা-নবজাগরণ থাকাটাই স্বাভাবিক। স্বাভাবিক এ প্রত্যাশা নিয়ে চলছে সময়-ক্ষণ। বিদায়ী বছরকে সামনে রেখে নতুন বছরকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা, সমস্ত দুর্যোগ পদদলিত করে নতুন করে বাঁচার প্রত্যয়, নতুন আঙ্গিকে দিনাতিপাত করার ব্রত নিয়ে বরণ করা হচ্ছে নববর্ষকে। এতসব আশা জাগানিয়া সংকল্পের মূলে থাকে দিনবদলের আর সত্য, সুন্দর ও মহৎ অঙ্গীকার পূরণের স্বপ্ন। পুরাতন বছরের গ্লানি, হতাশা, দুঃখ-বেদনা ছাপিয়ে নতুনত্বকে বরণ করাই লক্ষ্য সকলের। থাকে অবারিত স্বপ্নকে আলিঙ্গন করার প্রত্যয়। নববর্ষের নবচেতনা, নব উদ্দীপণায় ভরে তোলার বাসনা থাকে সবার। থাকে আনন্দ, থাকে উচ্ছ্বাস। নতুন বছরের পথচলার পাথেয় ভিত্তি হয় বিদায়ী বছর। পুরোনো বছরের ভুলকে শুধরিয়ে স্বপ্নময় আগামী দিনে এগিয়ে যাওয়ার শপথ।
কিন্তু আদপে সত্য, সুন্দর ও প্রত্যয়কে আলিঙ্গন করার সুযোগ আছে? বিদায়ী বছরের দুঃখগুলো কি মুছে ফেলা যাবে? ফেলে আসা দিনের হতাশা, দুঃখ-গ্লানি কি তাড়া করবে? কঠিন দুর্যোগ থামিয়ে নতুন পরিবেশ কি সৃজন করা যাবে? রূঢ় সময়, সমকালীন বাস্তবতা কী বলে? নাকি অতীতের গ্লানি, দুঃখ-বেদনা শনি হবে নতুন বছরেও। হয়তো হবে, নয়তো না। তারপরও মানুষ আশাবাদী। আশা-নিরাশার সমীকরণে উদ্বুদ্ধ হয়ে নবপরিকল্পনায় ইতিবাচক ধারায় এগিয়ে যায়। এগিয়ে যেতে হয়। বেঁেচ থাকার তাগিদে আশা জাগানিয়া স্বপ্ন দেখতে হয়। উন্নত জীবনের লক্ষ্যে পরিবেশ-প্রতিবেশ উজ্জীবিত করতে হয়।
নতুন বছরের সূচনালগ্নে স্বপ্ন দেখার নানা অনুষঙ্গ আছে আমাদের সামনে। প্রথম অনুষঙ্গই হলো বিশ্বকে এ মুহূর্তে করোনামুক্ত করা। এরপর আসে উন্নয়নযজ্ঞের প্রসঙ্গ। সন্দেহ নেই, দেশে এখন নানাক্ষেত্রে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। পদ্মাসেতুর মতো মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে একে একে পূরণ হচ্ছে সোনালি স্বপ্ন। আমাদের চট্টগ্রামেও তার আলো টিকরে পড়েছে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণ হচ্ছে দেশের প্রথম এবং দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় বঙ্গবন্ধু টানেল। এটির দৈর্ঘ্য ৩ হাজার ৪০০ মিটার। ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে দুটি টিউবের একটির খনন কাজ। বাকিটার কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। কোভিড পরিস্থিতির কারণে কাজ করতে কিছুটা সমস্যা হলেও অগ্রগতি থেমে নেই। বর্তমানে প্রকল্পের ৬০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ‘ডুয়েল টু লেন’ টাইপের ‘শিল্ড ড্রাইভেন মেথড’ পদ্ধতিতে নির্মাণাধীন টানেলটির কাজ নির্ধারিত মেয়াদকাল ২০২২ সালেই শেষ হবে। টানেলের প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর এই টানেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অর্থনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্বসম্পন্ন এই টানেল বাস্তবায়ন হলে পাল্টে যাবে চট্টগ্রামের চেহারা। চীনের সাংহাই সিটির আদলে গড়ে উঠবে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন।’
কর্ণফুলী নদীর উপর নির্মাণ হতে যাচ্ছে কালুরঘাট সেতু। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতু বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন। সড়ক ও রেল একই সেতুতে হবে এবং সেভাবেই নকশা চূড়ান্ত করা হচ্ছে। এ সেতুতে দুই লেনের সড়ক এবং ডুয়েল গেজ রেল লাইন বসবে।
এদিকে মিরসরাইয়ে নির্মাণ হচ্ছে দেশের বৃহত্তম ইকনোমিক জোন। মিরসরাই থেকে ফেনীর সোনাগাজী পর্যন্ত বিস্তৃত এ অঞ্চল গড়ে উঠছে ৩০ হাজার একর ভূমির ওপর, যেখানে ২৫টি আলাদা জোন নির্মাণের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন চলছে। অর্থনৈতিক এ মহাযজ্ঞে ইতোমধ্যে ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ নিশ্চিত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে প্রকল্পটির মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে ১৫ লাখ থেকে ২০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। অগ্রাধিকারমূলক মেগাপ্রকল্প হিসেবে বিবেচনা করে সরকার এই ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর’ প্রতিষ্ঠায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। একই সাথে আনোয়ারায় হচ্ছে পৃথক আরো দুটি চায়না ইকনোমিক জোন।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে কঙবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়িতেই হচ্ছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ‘মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ নামে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকা। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
অন্যদিকে বিদ্যমান বন্দরের প্রায় ছয় গুণ বেশি ভূমি নিয়ে সাগরপাড়ে গড়ে উঠছে বে টার্মিনাল। এটি নির্মাণ হলে যেকোনো দৈর্ঘ্য ও প্রায় ১২ মিটার ড্রাফটের জাহাজ এখানে ভিড়তে পারবে। এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান চিটাগাং ড্রাইডক লিমিটেডের সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তির নতুন ডক নির্মাণেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ১ হাজার কোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে নতুন ডক নির্মাণের ফলে ৬৯০ ফুট দীর্ঘ ও ১১৫ ফুট প্রস্থের জাহাজ ডকিং করে মেরামত ও নির্মাণ করা যাবে।
এছাড়া বাঁশখালীতে হচ্ছে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। মহেশখালীতে হয়েছে এলএনজি স্টেশন।
একইভাবে সমান্তরাল গতিতে এগিয়ে চলছে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের কাজও। বর্তমানে চট্টগ্রামেও চলছে প্রযুক্তিকেন্দ্রিক নানা প্রকল্প। এর মধ্যে আছে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক মার্কেটের ‘সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট) ‘শেখ কামাল আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর স্থাপন’, চুয়েটে ‘রোবোটিকস্‌ ল্যাব’, ‘মোবাইল গেইম এন্ড এ্যাপস ডেভেলপমেন্ট সেন্টার’, জেলা প্রশাসনের আইসিটি বিভাগের আইডিয়া প্রকল্প, ‘সোস্যাল মিডিয়া প্যারেড’, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) প্রস্তাবিত ‘হাইটেক পার্ক’, চবি’র ‘মোবাইল গেইম এন্ড এ্যাপস ডেভেলপমেন্ট টেস্টিং ল্যাব’, চট্টগ্রাম জেলার ‘শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব ও ‘ভাষা প্রশিক্ষণ ল্যাবের মনিটরিং শীর্ষক প্রকল্প। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি। প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতার স্বপ্ন দেখছে দেশ। বিকাশমান প্রযুক্তির এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে এটিই সবার কামনা। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে নতুন রূপ পাবে চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামে তথ্যপ্রযুক্তিতে সম্ভাবনার দ্বার খুলবে।
অন্যদিকে, উপমহাদেশের অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদী নিয়ে আশার আলো দেখা দিয়েছে। প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত হালদা নদীকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। মুজিববর্ষের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২১ ডিসেম্বর এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। সন্দেহ নেই, এ ঘোষণা হালদা নদীকে সুরক্ষা দেবে। কারণ এটি দেশের অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ।
ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে বুলেট ট্রেন চালু নিয়ে সমীক্ষা চলছে। তা বাস্তবায়ন করা গেলে ৫৫ মিনিটে ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াত করা যাবে। আর দোহাজারি হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন চালু হলে বুলেট ট্রেন চলে যাবে কক্সবাজার পর্যন্ত।
কিন্তু এতসব আশার আলোর মধ্যে হতাশার আঁধারও উঁিক দেয়। প্রথমেই বলা যায়, কর্ণফুলী নদীর কথা। আদালতের নির্দেশে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কর্ণফুলী নদীর তীরে দুই হাজার ২৮৯টি অবৈধ স্থাপনার একটি তালিকা প্রকাশ করে। গত ২০১৯ সালের ৪ থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসন টানা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে ২৩০টি স্থাপনা উচ্ছেদ, আলোর মুখ দেখে পাঁচটি খালের মুখ এবং উদ্ধার করা হয় দখলে থাকা প্রায় ১০ একর ভূমি। কিন্তু এরপর থেকে উচ্ছেদ বন্ধ হয়ে যায়। এখনও উচ্ছেদ অভিযান চালু করা যায়নি। কর্ণফুলী কেবল একটি নদী নয়, এটি দেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড চট্টগ্রাম বন্দরের প্রাণ। দেশের প্রাকৃতিক এবং ভৌগোলিক ঐতিহ্য। অথচ এটিই আজ চরম অবহেলার শিকার।
আজ ২০২১ সালের প্রথম সকাল। ভোরে নবীন সূর্য রক্তিম আভা ছড়িয়ে উদিত হয়েছে। নতুন আলোয় রাঙিয়ে দিচ্ছে পৃথিবীবাসীকে। নব আলোর ঝলকানিতে পুরোনো দুঃখ, বেদনা, শোক, হতাশা, যাতনা সবগুলোই মিশে যাক ধুলোয়। শুরু হোক নব সৃষ্টিশীলতার চেতনা। মননশীলতার চর্চা। এখন সময় এসেছে অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি নৈতিকতাকে জাগিয়ে তোলার, অসামপ্রদায়িক মানবিক চেতনার বীজ রোপণ করার। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের। আমাদের সবার কাম্য হোক সৎ, সত্য ও সুন্দরের আলোয় আলোকিত প্রতিটি সময়, ক্ষণ। বিদূরিত হোক সকল বাধা-বিপত্তি। মানসিকতা তৈরি হোক নবউদ্যম আর কর্মচাঞ্চল্যের। স্বপ্ন দেখা আর বাস্তবায়নের সমীকরণ যেন হাতের মুঠোয় থাকে। দিন বদলের প্রত্যয় যেন সোনার হরিণ না হয়। সত্য, সুন্দর আর ইতিবাচক ধারার মানসিকতায় সবার সম্মিলিত প্রয়াসই পারে নান্দনিক আগামীর পৃথিবী গড়ে তুলতে। সবাইকে খ্রিষ্টীয় নববর্ষের শুভেচ্ছা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধস্বপন বিজয় বড়ুয়া