নতুন বছরে উৎকন্ঠা ছড়ানো করোনার নতুন প্রকরণ অমিক্রন। কোভিড-১৯ অতিমারিতে বিপর্যস্ত পৃথিবীবাসী ইংরেজি নববর্ষ ঘিরে মুক্তির আনন্দ-স্বাদ উদ্যাপন করতে চেয়েছিল। করোনার এই নতুন ঢেউ তা বিস্বাদে পরিণত করে শংকার নতুন বাতাবরণ তৈরি করল। ২০২১ সালের নভেম্বর মাসের ১১ তারিখে দক্ষিণাাঞ্চলীয় আফ্রিকা বতসোয়ানা রাষ্ট্রে সর্বপ্রথম শনাক্ত হয় করোনার এই নতুন স্ট্রেন। ২৬ নভেম্বর ২০২১, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (হু), সার্স-কোভিড-২ এর নতুন এই রুপান্তর বি-১.১.৫২৯, করোনার একটি উদ্বেগজনক প্রকারণ হিসেবে চিহ্নিত করে, গ্রিক বর্ণ ‘অমিক্রনের ’ নামে এর প্যাঙ্গো বংশ নামকরণ স্থির করেছেন।
হু’ এর এই টেকনিকেল এডভাইসারি গ্রুপ অন্ ভাইরাস ইভোলিউশন (টি.এ.জি-ভি.ই) বিশ্বের নানা দেশে দ্রুততার সাথে চালাতে থাকে এর জেনোম, সংবহন যোগ্যতা, শরীরের অনাক্রমতন্ত্রকে এড়ানোর ক্ষমতা, ও টিকার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিষয়ে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণাদি। ডিসেম্বর ২০১৯ এ চিনের উহান থেকে উদ্ভুত করোনা অণুজীবানু ইতোমধ্যে অনেক রুপান্তর ঘটিয়ে দেশে দেশে প্রলয় বিষাণ বাজিয়েছে। যার সর্বশেষ ভয়ংকর সংস্করণ ছিল ‘ডেলটা ভেরিয়েন্ট’। বলা বাহুল্য কোভিড-সার্স-২ এর প্রতিটা রুপান্তর নতুন বৈশিষ্ট্য নিয়ে আবির্ভূত হয়, পরাক্রমশালী হয়ে উঠে। যেমন আগের প্রকরণগুলোর তুলনায় ‘ডেলটা’ ছিল অধিক সংক্রামক ও প্রাণঘাতী।
কতটা ভয়ংকর
অমিক্রন নিয়ে সকল গবেষণা তথ্য এখনো মেলেনি। তবুও কয়েকটি বড় মাপের গবেষণাপত্রে প্রমাণ মিলেছে-অমিক্রন এর পূর্বসুরীদের তুলনায় অধিক সংক্রমণ ক্ষমতাসম্পন্ন। বেলজিয়ামের ক্যাথিড্রাল যুনির্ভাসিটির অধ্যাপক টম ওয়াসারলাসের মতে এটি অত্যন্ত ক্ষিপ্র। যুক্তরাস্ট্রে এই প্রকারণ প্রতি ২ দিনে আক্রান্ত রোগীর সংখ্য দ্বিগুন করে চলেছে। ক্লিনিক্যাল ডাটা দেখাচ্ছে- এ হতে আক্রান্ত ব্যক্তির হাসপাতালে ভর্তিহার ৩০ শতাংশ কম। যদিও এতে ৪০ ঊর্ধ্ব বয়সী ও ডায়বেটিস, হৃদরোগ, কিডনি বিকল প্রভৃতি নানা রকম দীর্ঘ মেয়াদি রোগ আক্রান্ত ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের উপর অমিক্রনের থাবা কতটা বিস্তৃত, তা পরীক্ষীত হয়নি।
অমিক্রনের আঘাত এমন সময়ে দেখা দিল, যখন বিশ্বব্যাপী ‘করোনা প্রতিষেধক টিকাকরণ’ কর্মসূচি অনেক দেশ সফলভাবে সম্পন্ন করে চলেছে। বিশেষত উন্নত বিশ্বের দেশগুলো। তবুও আশ্চর্য বিষয় এই, কোভিড-১৯ এর এই নতুন ধরন এসব দেশে প্রবল বেগে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। আফ্র্রিকার বেশিরভাগ জনগোষ্টী পূর্বে করোনা আক্রান্ত হয়েছে, প্রায় অর্ধেক জনগোষ্টীর টিকাকরণ সম্পন্ন হয়েছে, তবুয়ো সেখানে অমিক্রনের সূত্রপাত ও বিস্তার হল। তার মানে এই, করোনার নতুন নতুন রুপান্তর টিকার রোগ-প্রতিরোধী শক্তির বাইরে গিয়েও বেঁচে থাকতে এবং সংক্রমণ শানাতে সক্ষম।
অমিক্রনের লক্ষনাদি ও চিকিৎসা
প্রাথমিক তথ্যে অমিক্রনের রোগ চিহ্ন ‘কমন কোল্ড’ বা সাধারণ সর্দি-কাশ অসুখের মতো। সর্দি-কাশ, শির:পীড়া, ক্লান্তি এইসব হলো এর মুখ্য লক্ষণসমূহ। অমিক্রনে ব্রনকাইটিস রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন রোগীরা, তুলনামূলকভাবে নিউমোনিয়া আক্রান্তের সংখা কম। অমিক্রন থেকে মৃত্যুহার কম থাকার হয়তো সেই প্রধান কারণ। এই রোগ নির্ণয় করা হয় র্যাপিড এন্টিজেন ও আর-টি-পিসিআর এর মাধ্যমে।
অমিক্রন থেকে মারাত্মক আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম হলেও প্রাণনাশ কিন্তু থেমে নেই। বিশেষত অনান্য অসুখে ভোগা ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের ক্ষেত্রে। তথ্যে এও দেখা যায়-যারা পূর্বে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন তারা অমিক্রন আক্রান্ত হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন। পূর্বে করোনা রোগীদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত কতিপয় ওষুধ যেমন করটিকোস্টেরয়েড ও আই.এল.৬ কার্যকর বলে প্রমান মিলেছে , তবে করোনা চিকিৎসার আগে ব্যবহৃত অন্যান্য অনেক ওষুধ তেমন কাজে আসছে না।
জন হপকিন্স য়ুনির্ভাসিটির গবেষণায় জানা যায়- অমিক্রনের জীবাণু শরীরে প্রবেশের ৩ দিনের মাথায় রোগ তৈরিতে সক্ষম, যেখানে আগের প্রকারণগুলোর এই ইনকুবেশন পিরিয়ড ছিল প্রায় ১ সপ্তাহের মতো। সে কারণে অমিক্রন এতো দ্রুত গতিতে সংক্রমন ছড়াচ্ছে। তাতে করে একই সঙ্গে বিপুল সংখ্যক রোগী ভর্তি হচ্ছে হাসপাতালে। তাতে করে মানসম্পন্ন চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সংকুলান করা যেকোনো দেশের স্বাস্থ্য চিকিৎসা পরিসেবা কাঠামোর জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
জনস্বাস্থ্যমূলক পদক্ষেপ-আমাদের করণীয়
মার্কিন যুক্তরাষ্টের প্রখ্যাত রোগতত্ত্ববীদ অধ্যাপক ডা. ফাউচি নতুন বছরে নতুন করে সবাইকে করোনা স্বাস্থ্যবিধি পালন ও টিকাকরণ বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। যুক্তরাজ্যে অমিক্রন থেকে প্রথম যে ব্যক্তি মারা যান, তিনি করোনা টিকাপ্রাপ্ত ছিলেন না। গবেষণায় দেখা যায়, টিকাপ্রাপ্তি অমিক্রন আক্রমনের দুর্বার রুপ রুখে দেয়, রোগের মাত্রা মৃদু প্রকৃতির করে আনে ও আক্রান্ত ব্যক্তির মারাত্নক অসুস্থ হওয়া বা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করে।
সুতরাং অমিক্রন এর সামগ্রিক বিপদ মোকাবিলা করে সুরক্ষা নিশ্চিতে নতুন বছরেও বিশ্ব-স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত সকল স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আশু প্রয়োজন রয়েছে। যেগুলো হলো- ১. সামাজিক দূরত্ব-ন্যূনতম এক মিটার, ২. যথাযথ নিয়মে নাক, মুখ ঢেকে মাস্ক পরিধান, ৩. ভিড় বা জমায়েত এড়িয়ে চলা-বিশেষত বায়ু নিরোধক ঠাসাঠাসি এলাকায়, বিশেষ করে বিশ্ববাসী যখন বড়দিন ও ইংরেজি নতুন বছর ঘিরে উৎসব পালনে উন্মুখ, ৪. ঘরে বিশুদ্ধ বায়ু চলাচল এর জন্য জানালা খোলা রাখার মতো ব্যবসা্থাদি অবলম্বন ৫. হ্যান্ডহাইজিন-৬০% এলকোহল বা সাবান জলে বিধিমত নিয়মিত হাত ধোয়া, ৬. সন্দেহ দেখা দিলে টেস্ট করিয়ে করোনা আক্রান্ত কিনা নিশ্চিত হওয়া, করোনা আক্রান্তদের কমপক্ষে ১০ দিনের আইসোলেশন ও সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ, ৭. এবং যখনই সুযোগ আসবে তাৎক্ষণিকভাবে করোনা টিকাকরণে শামিল হওয়া।
সহসা অমিক্রন মেঘ কেটে গিয়ে আড়ালের সূর্য-হাসি ছটার দেখা পাক্ ‘অমৃতস্য পুত্র’ সকল মানবসত্তা। করোনা অতিমারি মুক্ত বিশ্বে নতুন ভোরে নতুন বছরের আঙিনায় শান্তি-স্বস্তি- আনন্দের দুয়ার খুলে দাঁড়াক্ সকল মর্ত্যবাসী। ২০২২ সালে সকলের মিলিত কন্ঠে ধ্বনিত হোক্ মানব সভ্যতার জয়গান।
লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।