নতুন প্রজাতির মথ আবিষ্কার করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক দুই শিক্ষার্থী। মথটির নামকরণ করা হয়েছে ‘প্যারাক্সিনোয়াক্রিয়া স্পিনোসা’ (Paraxenoacria)। ছয় মাস গবেষণার পর তাদের এ সাফল্য আসে। মথ আর প্রজাপতি দেখতে অনেকটা একই রকম হলেও দুইটি আলাদা পতঙ্গ। প্রজাপতি উজ্জ্বল রংয়ের আর মথ হালকা রংয়ের। মথ রাতে বের হয় আর প্রজাপতি দিনে ঘুরে বেড়ায়।
২০১৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন মো. জহির রায়হান ও সায়েমা জাহান। সায়েমার বাড়ি চাঁদপুর, আর জহিরের বাড়ি পিরোজপুর। ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতির প্রতি অন্যরকম কৌতুহল ও আগ্রহ ছিল রায়হানের। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণিবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর সেই আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। বিভিন্ন জায়গায় মথ দেখলে সেটি ছবি তুলে রাখতেন রায়হান। সেটি পোস্ট করে সেটার নাম জানতেন বা অন্যদের জানাতেন। এভাবে আস্তে আস্তে এর প্রতি আগ্রহ আরও বাড়তে থাকে। ২০১৮ সাল থেকেই রায়হান মথ নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা শুরু করেন। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর থেকে সায়েমারও মথ নিয়ে আগ্রহ জন্মায়। তিনি ২০১৯ সালের দিকে মথ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তাদের ফ্রেন্ডদের নিয়ে ‘এনটমোলজিক্যাল সোসাইটি অব চিটাগং ইউনিভার্সিটি’ নামে একটি ফেসবুক প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। সেখানে তারা বিভিন্ন প্রজাতির কীট–পতঙ্গের ছবি শেয়ার করেন এবং সেটির পরিচয় বর্ণনা দেন। এতে নতুন নতুন প্রজাতি সম্পর্কে অবগত হন। এরপর তাদের মনে হলো এটা নিয়ে আরও বিশদভাবে গবেষণা দরকার। সেই থেকে তারা নতুন মথ নিয়ে কাজ শুরু করেন। দুইজন সহপাঠী হিসেবে কাজ শুরু করেন, মাস খানেক আগে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এর মধ্যে রায়হান বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে গবেষণায় যুক্ত হয়েছেন।
তারা জানান, মথের নামকরণের জন্য জহির–সায়েমা দম্পতি নিউজিল্যান্ড থেকে প্রকাশিত ‘জুট্যাক্সা’ সাময়িকীতে আবেদন জমা দেন।
সেখানে এই মথটি যে নতুন প্রজাতি এবং এর মতো দেখতে অন্য মথগুলোর তুলনামূলক দৈহিক/জিন পার্থক্য বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা (বারকোডিং) তুলে ধরেন। তাদের সেই নিবন্ধটি পর্যালোচনা শেষে চলতি অক্টোবর মাসে ‘অ্যা নিউজ জেনাস অ্যান্ড স্পেসিস অব পেলিওপোডিডি হজেস, ১৯৭৪ (ইনসেকটা : লেপিডোপটেরা) ফ্রম সাউথ–এশিয়া’ শিরোনামের নিবন্ধটি সাময়িকীটিতে প্রকাশিত হয়। এর আগে তারা আরও দুইটি মথ আবিষ্কার করেছেন। এগুলো হলো, ‘Phragmatataecia Ishuqii’ ও Schistophleps kendricki ‘। মথ নিয়ে তারাই দেশে প্রথম কাজ শুরু করেন এবং কয়েকটি নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করেন বলে জানা গেছে। রায়হান ও সায়েমা তাদের আবিষ্কার সম্পর্কে আজাদীকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বিস্তারিত তুলে ধরেন।
রায়হান বলেন, আমরা খুবই আনন্দিত গবেষণাটি করতে পেরে। কারণ বাংলাদেশে এর আগে মথের গবেষণা তেমন একটা হয়নি। আমরাই প্রথম মথের কয়েকটা নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করলাম। আসলে নানারকম কর্মকাণ্ডের কারণে আমাদের পরিবেশ হুমকির মুখে। কিন্তু এর মধ্যেও আমাদের যে জীববৈচিত্র্য টিকে আছে সেটি যে ইউনিক এটা বিশ্বকে দেখানোর জন্য আমাদের এই গবেষণা। তিনি বলেন, আমাদের দুইজনেরই ইচ্ছা আছে মথ নিয়ে সামনে আরও বৃহৎ পরিসরে গবেষণা করার।
গবেষণার শুরুর কথা বলতে গিয়ে সায়েমা বলেন, রায়হান হলে থাকতো, সেখান থেকেই মথ দেখলে ছবি তুলে রাখত এবং পরে সেটার নাম জানার চেষ্টা করত সে। এভাবে আস্তে আস্তে শুরু হয়। এরপর মনে হলো আমাদের বৈজ্ঞানিকভাবে আগাতে হবে, শুধু ছবি তুললেও হবে না। পড়াশোনা শুরু করলাম দুইজনে। এভাবে দুই–তিন বছর গেল। এরপর নতুন প্রজাতি খোঁজার নেশা দুইজনের মধ্যে চেপে বসলো। আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে টার্গেট করলাম। কারণ এটা জীববৈচিত্র্যের জন্য উত্তম জায়গা। এর মধ্যে টের পেলাম এখানে নতুন প্রজাতি আছে। কিন্তু আমাদের সেটা গবেষণাপত্রের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে যে এটা নতুন প্রজাতি। এর জন্য আমাদের মথের বারকোডিং করতে হবে। এটা হচ্ছে মথের জিনগত বিশ্লেষণ বা জীবনবৃত্তান্ত। এটা করার জন্য আমরা চবি বায়োকেমিস্ট্রি ল্যাবের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার অনুমোদন নিলাম। কিন্তু সেখানে আমাদের কাজটি সফলতা পেল না। সায়েমা বলেন, এরপর থেমে না থেকে আমরা কাজ চলমান রাখলাম। এরপর ২০২৩ সালের জুলাই মাসে আমাদের একটা ‘মথ উইক’ কর্মসূচির উদ্যোগ নিই। এতে সবাই নতুন নতুন মথের ছবি তুলে ওয়েবসাইটে আপলোড করি এবং সেগুলোর পরিচয় দেয় বা অন্যদের থেকে জেনে নেয়। সেই কর্মসূচিতে আমরা নতুন একটা মথ পেয়ে যায়।
এই কাজে কারো সহযোগিতা পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে সায়েমা বলেন, আমরা যে গবেষণা করেছি এতে তেমন একটা কারো সহযোগিতা পাইনি। আমরা যেসব জিনিস লাগে সেগুলো আমরা নিজেরাই কিনে বাসায় এই কাজগুলো করেছি। আর বাংলাদেশে এমন কোনো ল্যাব নেই যেখানে আমরা কাজগুলো করবো। তিনি বলেন, সর্বশেষ আমরা যে মথটি পেয়েছি সেটি পাওয়া গেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এটা প্রায়ই ক্যাম্পাসে দেখা মিলে। এটার মতোই আরেকটি প্রজাতি রয়েছে এ্যাক্সিয়া। এ্যাক্সিয়ার মধ্যে দুইটা দানা আছে এবং ফোর উইংয়ে একটা বাঁকের মতো আছে। আর নতুন প্রজাতিটার মধ্যে হাইন্ড উইংয়ে একটা বাঁকের মতো আছে যেটাকে এক্সিকিবিশন বলা হয়। এটা হচ্ছে এ্যাক্সিয়ার সাথে প্যারাক্সেনেক্রিয়ার মৌলিক পার্থক্য। সায়েমা বলেন, বিশ্বের যে কেউ যখন এই মথটি নিয়ে গবেষণা করবেন, তখন এর নামের পাশে ‘রায়হান এন্ড জাহান’ লেখা দেখবেন।
সায়েমা জানান, নামকরণ চূড়ান্ত হওয়ার আগে বিভিন্ন তথ্য–প্রমাণের ভিত্তিতে নিবন্ধ লিখে জমা দেওয়া, রিভিউ হওয়া, আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ হওয়া, জু ব্যাংক থেকে নিবন্ধন করাসহ অনেকগুলো ধাপ পার হতে হয়। তারা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশ থেকে লার্ভা ও পূর্ণবয়স্ক মথ সংগ্রহ করেন। নিজেদের ছোট ল্যাবে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে তা যাচাইবাছাই করেন। ‘প্যালিওপোডিডি’ পরিবারের অন্যান্য জেনাসগুলোর সঙ্গে তুলনা করে তারা নিশ্চিত হন, এই মথটি অন্যগুলোর চেয়ে আলাদা। এরপর তারা সেটা ‘জুট্যাক্সা’ সাময়িকীতে পাঠান। সেখানে দুজন বিজ্ঞানী তাদের নিবন্ধটি পর্যালোচনা করে সাময়িকীতে প্রকাশ করেন। তাদের দেওয়া নামটিই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
সায়েমা জানান, ‘আইন্যাচারালিস্ট’ নামে ওয়েবসাইটে ব্যবহারকারীরা মথ, পাখি, প্রজাপতিসহ অন্যান্য পোকামাকড়ের ছবি শেয়ার করেন। গবেষকেরা এই ছবিগুলোর মাধ্যমে প্রজাতিগুলোর অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পান।
জহির জানান, নামকরণের পর মথের নমুনাটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরে সংরক্ষণ করার জন্য জমা দিয়েছেন, যাতে অন্যরা এটি নিয়ে গবেষণা করতে পারেন। বাংলাদেশ থেকে আরও অনেক নতুন গণ–প্রজাতির মথ আবিষ্কার করতে চান জহির। এই অধ্যয়নটি কেবল কীটতত্ত্ব বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় যোগ করবে না, বরং পেলিওপোডিডির মধ্যে রূপবিদ্যা, আচরণ এবং পরিবেশগত অভিযোজনের মধ্যে জটিল আন্তঃসম্পর্ক সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান এবং বোঝা সমৃদ্ধ করবে বলে জানান তিনি।