নতুন প্রজন্মকে শেকড়ের কাছে ফিরিয়ে আনার তাগিদে গতকাল দ্বিতীয় বছরের মতো ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে আয়োজন করা হয়েছিল ব্যতিক্রমী ‘চাটগাঁইয়া ঈদ আনন্দ উৎসব’। প্রথমবারের মতো এবছরও এই উৎসব চট্টগ্রামের মেয়র, সংসদ সদস্য, রাজনীতিবিদ, সংবাদব্যক্তিত্ব, সংস্কৃতিজনসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়। উৎসবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। বেলুন উড়িয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী সম্পাদক, একুশে পদকপ্রাপ্ত এম এ মালেক। উৎসবের শুরুতেই রোভার স্কাউটের সদস্যরা নিজেদের সাজ–পোশাকে গ্রামবাংলার আবহমান ঐতিহ্য ফুটিয়ে তুলে অতিথিদের সামনে হাজির হন। কেউ শাড়ি ও ধুতি–পাঞ্জাবি পড়ে সেজেছেন, কেউ লাঠিয়াল, বাউল, দইওয়ালা, জেলে, বউ–জামাই, আবার কেউ সাপুড়ে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, অনেক ইতিহাসের জন্মদাতা এই লালদীঘি। চট্টগ্রাম পথ দেখায়। এই চট্টগ্রামে অনেক বীরের জন্ম হয়েছে। আমরা আমাদের সন্তানদের চাটগাঁইয়া ভাষায় কথা বলতে দিতে চাই না। আগে এই প্রবণতা শহরে সীমাবদ্ধ থাকলেও সেটা এখন শহর ছাড়িয়ে গ্রামেও পৌঁছে গেছে। আমরা বড়রা বাড়িতে চাটগাঁইয়া ভাষায় কথা বললেও ছোটদের সাথে যখন কথা বলি তখন চাটগাঁইয়া ভাষা আর ব্যবহার করি না। এতে করে নতুন প্রজন্ম ধীরে ধীরে সঠিক চাটগাঁইয়া ভাষা হতে বিমুখ হয়ে যাচ্ছে। এই ভুল থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। দেশের চলমান উন্নয়নযজ্ঞ ঠেকাতে সক্রিয় অপশক্তি স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির ওপর আঘাত করলে চট্টলাবাসী প্রতিহত করবে। মেয়র বলেন, এই আনন্দমেলার শুরু হয়েছে, এটা বন্ধ হবে না। এই আনন্দমেলা চলবে। মেয়র দৈনিক আজাদী প্রসঙ্গে বলেন, আজাদী চট্টগ্রামের মাটি ও মানুষের পত্রিকা। একাত্তরের ১৭ ডিসেম্বর যে মানুষটি পত্রিকার শিরোনাম দিয়েছিলেন, ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’, তিনি বর্তমান সম্পাদক এম এ মালেক– আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের পুত্র। আমাদের এ আয়োজনে উপস্থিত থেকে তিনি আলোকিত করেছেন উৎসবকে।
উদ্বোধনী পর্বে আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, বঙ্গবন্ধু এই লালদীঘির মঞ্চে দাঁড়িয়ে ছয় দফা ঘোষণা করেছিলেন। আজ সেই স্থানে নির্মিত মঞ্চে চাটগাঁইয়া উৎসবের উদ্বোধন করতে গিয়ে মনে পড়ে গেছে সেই দিন ছবি তুলতে গিয়ে আমি গ্রেপ্তার হয়েছিলাম। তিনি বলেন, চট্টগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নতুন প্রজন্মকে জানতে হবে। জানতে হবে, আমরা কতটা সমৃদ্ধ, আমাদের সংস্কৃতি কতটা বর্ণিল। আমাদের বলী খেলা, বৈশাখী মেলা, মেজবান উৎসব আজ বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। এ ধরনের উৎসব যত বেশি হবে, ততটাই আমাদের উত্তরসূরীরা উপকৃত হবে, নিজের শেকড় সম্পর্কে জানবে।
সংসদ সদস্য ওয়াসিকা আয়েশা খান বলেন, উৎসবমুখর পরিবেশে ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি নির্বিশেষে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে আমরা লালদীঘি চত্বরে সমবেত হয়েছি। ঈদের আনন্দ সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সমবেত হয়েছি।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন বলেন, বাঙালি সংস্কৃতিকে কেউ কেউ ধর্মের বিরুদ্ধে নিয়ে যেতে চায়। সংস্কৃতি হচ্ছে একটি জাতির শেকড়। শেকড় ছাড়া যেমন গাছ বাঁচতে পারে না, তেমন সংস্কৃতি ছাড়াও কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না।
চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম বলেন, আমাদের প্রথম পরিচয় আমরা চাটগাঁইয়া। আমরা সবকিছুই সবার আগে করে দেখাই। চাটগাঁইয়াবাসীর সেই একতা আজ লালদীঘির মাঠেও দৃশ্যমান। এভাবেই ঐক্যবদ্ধভাবে চট্টগ্রাম তথা এদেশকে এগিয়ে নিতে হবে।
চাটগাঁইয়া ঈদ আনন্দ উৎসব উদযাপন পরিষদের সভাপতি কাউন্সিলর জহরলাল হাজারীর সভাপতিত্বে ও আবৃত্তিশিল্পী দিলরুবা খানমের সঞ্চালনায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন, রাজনীতিবিদ খোরশেদ আলম সুজন, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সিনিয়র সহ–সভাপতি চৌধুরী ফরিদ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা দেবাশীষ পাল দেবু, যুবলীগ নেতা আরশেদুল আলম বাচ্চু, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা নুরুল আজম রনি, ছাত্রলীগ নেতা জাকারিয়া দস্তগীর প্রমুখ।
এরপর বর্ণাঢ্য র্যালি নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এরপর স্কুল অব ওরিয়েন্টাল ডান্সের শিল্পীদের নৃত্যের মধ্য দিয়ে শুরু হয় উৎসবের সাংস্কৃতিক পর্ব। এ পর্ব পরিচালনায় ছিলেন চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সাংস্কৃতিক সম্পাদক নাসির উদ্দিন হায়দার। অনুষ্ঠানে চাঁটগাইয়া নাচ, কবিতা, গান, নাটিকার পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী ঘুড়ি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। শেষে ঈদের সেমাই দিয়ে আপ্যায়ন করা হয় উপস্থিত সকলকে।