ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হওয়ার বারতা নিয়ে এসেছে নতুন বছর। অমিত সম্ভাবনার আশা জাগানিয়া নতুন বছরকে নগরবাসী বরণ করেছে গভীর আবেগে আর মমতায়। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানকে পাথেয় করে ভবিষ্যতের সোনালি রোদ্দুর দেখার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে–এটাই প্রত্যাশা ছিল উৎসব পাগল মানুষের। গত শুক্রবার পহেলা বৈশাখকে বরণে উৎসবের রঙ লেগেছিল চট্টগ্রাম নগরজুড়ে। ছন্দ–আনন্দের দোলায় নতুন বছরে শুরুতে পরস্পর মিলেছে শুভেচ্ছার আলিঙ্গনে। মঙ্গলের আবাহনে বের হওয়া বর্ণিল শোভাযাত্রায়ও ঘটেছে আপামর মানুষের সম্মিলন। সকাল থেকে সামাজিক–সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ গানে বরণ করে নেন বাংলা নববর্ষকে। তবে রমজান মাস হওয়ায় এবার বসেনি মেলা, ছিল না ভুভুজেলার উৎপাতও। গ্রহণ করা হয়েছিল বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বিভিন্ন এলাকা সিসিটিভির আওতায় ছিল। পুলিশ, র্যাবের পাশাপাশি সাদা পোশাকে নিয়োজিত ছিলেন নিরাপত্তা কর্মীরা। নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল যান চলাচল। বর্ষবরণ উৎসবের সকল আয়োজন সংক্ষিপ্ত করা হয়। প্রতি বছরের মতো এবারও চট্টগ্রামে বর্ষবরণের বড় দুটি আসর বসেছিল সিআরবির শিরীষতলা ও ডিসি হিলে। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শিল্পকলা একাডেমিতে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ক্যাম্পাসের সবুজ চত্বরেও ছিল প্রাণের মেলা। অন্যদিকে, নগরীতে চবির চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী, চারুশিল্পী সমন্বয় পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করেছে।
সিআরবির শিরীষতলায় সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল বৈশাখের প্রথম দিনে। এসেছেন নানা বয়সীরা। তবে এবার সেখানে বলীখেলা হয়নি। ভায়োলিনিস্ট চিটাগংয়ের শিল্পীরা সমবেতভাবে বেহালার মূর্ছনায় রাঙিয়ে দেন নববর্ষের সকালটা। ‘এসো হে বৈশাখ’ গানের সুরে সুরে শুরু হয় বাংলা নববর্ষ আবাহন।
শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টায় সিআরবির শিরীষতলায় ভায়োলিনিস্ট চিটাগংয়ের বেহালা বাদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বর্ষবরণের পঞ্চদশ আয়োজন। নববর্ষ উদযাপন পরিষদ চট্টগ্রামের উদ্যোগে এই আয়োজনে নববর্ষ উদযাপন পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক একুশে পদকপ্রাপ্ত ড. মনিরুজ্জামানকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে বর্ষবরণের মঞ্চে। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে বিকেল ৪টায় অনুষ্ঠান শেষ হয়।
বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে সিএমপির পক্ষ থেকে শিরীষতলার অন্তত এক কিলোমিটার দূরে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আঞ্চলিক কেন্দ্রের সামনে প্রতিবন্ধক দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। সিআরবিতে প্রবেশের তিন দিকেও গাড়ি প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর ফলে শিরীষতলায় যেতে লোকজনকে গরমের মধ্যে হেঁটে অনেক পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। এ নিয়ে মানুষের মধ্যে ভোগান্তিও ছিল। বিশেষ করে যেসব শিল্পী মঞ্চে অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন তাদেরও হেঁটে যেতে হয়েছে। রমজানের জন্য আয়োজন সংক্ষিপ্ত হওয়ায় এবার সাহাবুদ্দীনের বলি খেলা হয়নি।
নগরীর ডিসি হিলের মুক্তমঞ্চে সম্মিলিত পহেলা বৈশাখ উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে শুক্রবার সকাল ৭টায় জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বর্ষবরণের আয়োজন। ৩২টি সংগঠনের শিল্পীরা সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশ নেন। বেলা ১২টায় অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানেন আয়োজকরা। ‘পহেলা বৈশাখ বাঙালির, সবার যোগে জয়যুক্ত হোক’ স্লোগানে ডিসি হিলে সকাল থেকে শুরু হয় বর্ষবরণ। নাচে–গানে জমজমাট পুরো এলাকা। প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে ছুটে এসেছেন সবাই। বাঙালি নারীর ঐতিহ্য শাড়ি, পুরুষরা পাঞ্জাবি পরে এসেছিলেন অনুষ্ঠানস্থলে। শিশুরা মুখে বা হাতে রং–তুলি দিয়ে আঁকিয়ে নেয় ‘শুভ নববর্ষ’।
পহেলা বৈশাখের সবচেয়ে পুরনো আয়োজনটি হয়ে থাকে ডিসি হিল এলাকায়। ডিসি হিলে প্রবেশের আশপাশের সড়কগুলোতে ভোর থেকে যান চলাচল বন্ধ করে দেয় সিএমপি। ডিসি হিল, চেরাগী পাহাড়, বোস ব্রাদার্সের সামনে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে যেতে হয়েছে মুক্তমঞ্চের দিকে। পুলিশের কড়াকড়িতে গরমের মধ্যে ভোগান্তিতে পড়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন অনেকে।
চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমি থেকেও বর্ষবরণ উপলক্ষে সকালে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়। শিল্পকলার অনিরুদ্ধ মুক্তমঞ্চে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। শিশু একাডেমি, ফুলকিসহ নগরীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও বর্ষবরণের অনুষ্ঠান হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও সংস্কার কাজের জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট এবার নগরীতে মঙ্গল শোভাযাত্রা ও বর্ষবরণের অনুষ্ঠান বাতিল করে। তবে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের বাইরে নিজ উদ্যোগে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করে। সেই শোভাযাত্রার ব্যানার ও শিক্ষার্থীদের বানানো প্রতিকৃতিগুলো ছিল সাদা–কালো। ঢোল–বাদ্যের তালে তালে এগিয়ে যাওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রা নগরীর বাদশা মিয়া সড়ক থেকে চট্টেশ্বরী রোড হয়ে কাজির দেউড়ি ঘুরে চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে এসে শেষ হয়।
একই স্থান থেকে চারুকলার সাবেক শিক্ষার্থীদের সংগঠন চট্টগ্রাম চারুশিল্পী সম্মিলন মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করে নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এ সময় চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের সাথে সাবেক শিক্ষার্থীদের কথা কাটাকাটি এবং মৃদু হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এদিকে উদীচীর পক্ষ থেকে নগরীর আন্দরকিল্লা থেকে বের হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রা ডিসি হিলে গিয়ে শেষ হয়।