দ্বিতীয় পর্ব
অবশেষে একদিন হল পুত্রলাভ। বংশধারা বাঁচিয়ে রাখার জন্য পুত্র চেয়েছিলেন লেখক, তা কিন্তু নয়। একাকী কন্যাটির একজন সঙ্গী প্রয়োজন, একান্ত আপনার জন। ভীষণ মন খারাপ হলে, মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে ভূগোলকের অন্য গোলার্ধে বাস করলেও যাকে ডেকে সাড়া পাওয়া যায়, মন খুলে কথা বলা যায়, তেমনই আপন। পুত্রের বয়স যখন দশ তখন সময় হয় মায়ের ওর জন্যও কিছু লিখে রাখার। রচিত হয় ‘অমৃতের পুত্র’। ‘আমার মেয়েকে বলি’তে প্রাপকের কোন ভাষা থাকে না, মতামত থাকে না, কারণ তখনও বোল ফোটেনি মেয়ের। কিন্তু দশ বছর বয়সী পুত্রের ভাবনা, কল্পনা, ও স্বপ্নের ছোট্ট ছোট্ট দৃশ্যকল্প বলে দেয় মায়ের আশা হয়তো জলে যায়নি। পুত্রের জন্য রচিত গ্রন্থ তাই আরও পরিণত, জীবনের অনেক জটিল বিষয় অকপটে তুলে ধরেন লেখক পুত্রের কাছে। আজ সবকিছু সে বুঝতে না পারলেও একদিন ঠিকই বুঝবে। সেদিন হয়তো মা আর থাকবে না পাশে, দেখবে না কত্ত বড়টি হয়ে গেছে তাঁর পুত্রধন। বড় পৃথিবীতে স্থান করে নেওয়া পুত্রটি নিশ্চয় মায়ের জয়গান গাইবে সেদিন।
আধুনিকতার পাঠ নিতে গিয়ে প্রতিনিয়তই আমরা পুরনো দিনের স্মৃতিময় সবকিছুকে মাটিচাপা দিয়ে ফেলি। অথচ এত পড়ালেখা করে, লক্ষ তরুণের স্বপ্নের দেশ পরিভ্রমণ শেষ করে এসে, নানান ঘাটে নানান জাতের, নানান ভাষার মানুষের সঙ্গে কাজ করেও দাদী নানীর বলা কথাগুলোকে বাতিলের ঝুড়িতে ফেলে দিতে পারেন না লেখক শারমিনী আব্বাসী। জীবনে যারা প্রতিদিন জিততে চায়, তাদের দলে নন তিনি। ছেলেকে লেখক ধর্মের কথা বলেন, মানবিকতার কথা বলেন, বিনয়ী হতে বলেন। তবে ভাবগম্ভীর গুরুজনের মতো করে নয়। পুত্রকে বলছেন তিনি- কেউ ক্ষতি করতে চাইলে আমরা কি প্রতিশোধের শপথ নেব? প্রতিহিংসার আগুন দিয়ে সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেব? তা কিন্তু নয়। প্রতিবন্ধকতা আমাদেরকে নিঃস্ব করে না বরং শক্তি যোগায়, পরিণত করে আলোর যোদ্ধায়। প্রতিভা নয় আমাদের প্রার্থনা হোক শুদ্ধতার। জাত-পাত-বিত্ত আর ক্ষমতার লড়াইয়ে মত্ত মানবসন্তানদের কাছে এসব অমৃতবাণীর কোন মূল্য হয়তো নেই। কিন্তু আমাদের সন্তানেরা, অমিত শক্তি ও সম্ভাবনার আধার আগামী প্রজন্ম স্বতন্ত্র সত্তা হয়ে আলো ছড়াবে জগতময়। ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি’ এই আপ্তবাক্যটি প্রাণে ধরে নিজেকে খুঁজে নিতে হবে। খুঁজে নিতে হবে নিজের চলার পথ নিজেকেই। নিজের স্বপ্ন নিজেকেই দেখতে হবে। কারও ছায়ায় বেঁচে থাকায় গৌরব নেই- ‘তুমি শুধু তুমি হও’- এই কামনা তাঁর পুত্রের কাছে।
পৃথিবীর সাত বিলিয়ন মানুষের প্রত্যেকের জন্য পৃথক অবয়ব, পৃথক সত্তা, তাদের প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন গল্প, সুখ দুঃখ ভিন্ন, স্বপ্নও আলাদা। এমন মহাকর্মযজ্ঞ যিনি সামাল দেন তিনিই তো সর্বশক্তিমান। আমরা তাঁকে দেখতে পাই কি না পাই, প্রকৃতি ও পরিবেশ জানান দেয় তাঁর অস্তিত্ব। তিনি আমাদের দেখেন, তিনিই আমাদের দেখে রাখেন। মায়ের ছেলে এই শিক্ষা দশ বছরে বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই গ্রহণ করেছে। এখানেই মায়ের সার্থকতা। এরপরও পুত্রকে লেখক তাঁর কৃষ্ণবর্ণ ক্বাবা পরিভ্রমণের গল্প শোনান, জাগতিক সাফল্যের পারদ ওঠানামার কার্যকারণ বিব্রত করেন, সমাজে মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ ও বৈষম্যের দিকেও আঙুল তোলেন।
আজকাল আমাদের সাহিত্য, সংগীত ও নাগরিক জীবনপ্রণালীতে চালচুলোবিহীন হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর কথা কেউ বলে না। শিক্ষা, অর্থ নানান সূচকে এগিয়ে চলেছি আমরা তরতর করে। এ-কেমন শিক্ষা আমাদের! লেখকের ভাষায় “ভোগবাদী জীবন চর্চা বড় যাতনার”। কাম, ক্রোধ, লোভের হাত ধরে হেঁটে চলেছি আমরা। কেন এলাম এই পৃথিবীতে- ভেবে কি দেখেছি? আমরা ভুলেই যাই একদিন সাঙ্গ হবে সকল খেলা, ফিরে যেতে হবে শেষবিচারের মাঠে।
সমাজে চলমান বৈষম্যের কদর্যতা, ‘অর্থকড়ি যশ আর ইটকাঠের দিকে চোখ রেখে জীবন পার করে দেওয়া’ অজ্ঞানতার মূলে আছে ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে যাবার সিঁড়ি ‘রাজনীতি’। শারমিনী’র কলমে ঝড় ওঠে- “বনবর্গি, জলবর্গি, ভূমিবর্গি, রাজবর্গি পরিবেষ্টিত ভ্রষ্ট নষ্ট রাজনীতির ইতিহাস আমাদের”। আমরা সত্য বলার সাহস রাখিনা, শিরদাঁড়া সোজা রাখতে বড় ভয় আমাদের, স্বকীয়তাকে কবর দিয়ে কূপমণ্ডূকের মতো নিজেকে সঁপে দেই আমরা যুগের হাওয়ায়। এই বিপন্ন সময়ে আমদের সন্তানদের শুদ্ধতার কথা কে শোনাবে? মা বাবাই তো। আমাদের সন্তানরা সকালবেলার পাখি হবে। রূপকথার সেই রাজপুত্রের মতো করে যাদুর কাঠির ছোঁয়ায় ঘুমন্ত অধিবাসীদের জাগিয়ে তুলবে, ফুলে-ফলে আলোয় ভরিয়ে দেবে গোটা পৃথিবী- শারমিনী’র মতো এমন স্বপ্নচারী মা-বাবা চাই শত সহস্র লক্ষ কোটি।
কন্যার মতো পুত্রকেও লেখক ক্রমাগত ধর্মের কথা বলে গেছেন। তবে সাবধান করে দিয়েছেন এই বলে- ‘নিজেকে ধার্মিক দেখানোর চেষ্টার মতো হীনতা আর কিছুতে নেই’। সৃষ্টিকর্তাকে পেতে হলে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। মানুষের দুর্দশা, দীর্ঘশ্বাস, ক্ষুধা, তৃষ্ণা আমাদের স্পর্শ না করলে সকল জপতপই অর্থহীন। প্রত্যক্ষভাবে দারিদ্র্যের কষ্ট না পেলেও দরিদ্র অসহায়দের জন্য প্রাণ কাঁদে তাঁর। ঘেমো মানুষদের জীবন থেকে নেওয়া শিক্ষা সন্তানদের মাঝে বিলিয়ে দেন তিনি। মানবিকতার সঞ্চার করে পবিত্র থেকে পবিত্রতর হওয়ার দীক্ষা দিতে চান তিনি পুত্র কন্যাদেরকে। ওদেরকে নিয়ে প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে যেতে মন চায় তাঁর।
মাতৃজাতির প্রতি সম্মানবোধ জাগিয়ে তোলার জন্য শিশুকাল থেকেই ছেলেকে প্রশিক্ষণ দেন লেখক। শুধু তাই নয়- কেমন জীবনসঙ্গী হবে, তার সঙ্গে আচরণই বা কেমন হবে- এসব নিয়েও অবলীলায় কথা বলেছেন অমল ধবল শিশুপুত্রের সঙ্গে। ‘যে মাটিতে একটি মেয়ের জীবন গাঁথা, তা সমূলে তুলে অন্য মাটিতে পোতার নাম বিবাহ’-পরের বাড়ির সেই মেয়েটিকে মমতা ও সম্মান দিতে হবে। সহধর্মিণীর প্রতি আচরণই বলে দেবে মা’ টি তোমার কেমন ছিল, ‘রানী না ঘুঁটেকুড়ানি’ ? কি অপূর্ব অভিব্যক্তি! আমাদের সব মায়েরা পুত্রদের এই শিক্ষাটা দিলে দুর্নীতি আর দূষণের মতো নারী নির্যাতনেও বিশ্বে আমাদের অবস্থান প্রথম সারিতে থাকতো না।
কথায়-কথায় উঠে আসে বাংলাদেশের জন্মকথা। কত রক্ত, কত ত্যাগ আর কতনা পথ পেরিয়ে পাওয়া হয় ভাষা, মানচিত্র, পতাকা আর আত্মপরিচয়। ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’। তাই তো মার্কিন মুলুকে থিতু হওয়ার সুযোগকে বর্জন করতে পারাকেই ‘জীবনের পরম অর্জন’ বলে মনে করেন লেখক। তবে দুর্জনে আজ ভরে গেছে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি। হানাদারের স্থান নিয়ে নিয়েছি আমরাই। এখন আমরাই আমাদের শোষণ করি। “শক্তের আবর্তে অশক্তরা দিন-দিন মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে”। তবু তিনি স্বপ্ন দেখেন, দিন বদলের। তার জন্য ভালোবাসাই শেষ কথা। বিত্তবৈভব কিংবা ক্ষমতা প্রতিপত্তি নয়, ভালোবাসাই একমাত্র শক্তি যা মানুষকে অমর করে পৃথিবীর বুকে।
শারমিনি আব্বাসী’র রচনার বিশেষত্ব এই যে প্রতিটি বাক্যই তাঁর উদ্ধৃতিযোগ্য। কলম দিয়ে প্রিয় উক্তি চিহ্নিত করার অভ্যাস আছে যে পাঠকের, তার বইয়ের দাগানো পাতাগুলো বলে দেয়, প্রাণের কত গভীরে চলে গেছে বইয়ের কথাগুলো। আমাদের সমাজে কিছু ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত যুগ যুগ ধরে; যেমন- যে পরিবারে শিল্প সাহিত্য কিংবা গান বাজনার চর্চা হয়, সে পরিবারে নামাজ দোয়া থাকে না; আবার যে পরিবারে নামাজদোয়া থাকে সে পরিবারে উদারতা থাকে না। বিশেষ করে ইসলামি মূল্যবোধ ও প্রগতিকে সাংঘর্ষিক বলে ধরে নেওয়া হয়। ভাবা যায় লেখকের পিতা, একজন মুক্তমনা সুরের সাধককেও আমাদের সমাজ ‘ মৌলবাদী’ বানিয়ে ছেড়েছে! আমরা প্রতিনিয়ত ধার্মিকতা ও রক্ষণশীলতাকে গুলিয়ে ফেলি, আবার প্রগতি আর ধর্মহীনতাকে এক কাতারে ফেলে দেই। ফলে আমাদের জনগোষ্ঠী স্পষ্টই কতগুলো আলাদা-আলাদা বাক্সে বন্দী হয়ে যায়। প্রতিটি বাক্স একে অন্যের প্রতিপক্ষ হিসেবে অবস্থান নেয়। দেশ জাতির চরম দুঃসময়েও বাক্সবন্দী মানুষগুলো একবিন্দুতে মিশে যেতে পারে না। শারমিনী দেখিয়ে দিয়ে দিয়েছেন কেমন করে সুর, কর্ম ও ধর্মকে আঁকড়ে ধরে উদারতা ও মানবিকতার জয়গান গাওয়া যায়। নতুন দিনের আলোর পাখিদের সকাল আনার সংগ্রামে পাথেয় হতে পারে শারমিনী’র রচনা। তবে কেবলমাত্র সন্তানদের জন্যই নয়, প্রতিটি বাবা-মা, এমনকি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের জন্য পাঠ্য হতে আলোচ্য গ্রন্থ দুটি।