(প্রথম পর্ব)
আমাদের ছেলে-মেয়েরা কোথা থেকে আসে? কোন সে অমৃতলোক হতে? কেন আসে আমাদের কাছে? ওদের কাছে কি চাই আমাদের? ওদেরই বা কি চাওয়ার আছে আমাদের কাছে? আমরা কি ওদের মালিক? নাকি পথ প্রদর্শক? নাকি অবধায়ক মাত্র? ওরা কি কেবলই আমাদের? আমাদের সম্পদ ও মর্যাদা দেখভাল ও বৃদ্ধি করে যাওয়ার যন্ত্রমাত্র? আমাদের অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণ করার দায় নিয়েই কি এই পৃথিবীতে আসে ওরা? সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবীরও কি কিছু চাইবার নেই ওদের কাছে? আমরা যারা পিতা-মাতা, আমাদের ভাবনায় এই প্রশ্নগুলো কি উঁকি দেয় কখনও? শারমিনী আব্বাসী’র পুত্র ও কন্যার উদ্দেশ্য করে রচিত দু’টি গ্রন্থ ‘আমার মেয়েকে বলি’ এবং ‘অমৃতের পুত্র’ আমাদের ভাবনার ঘরে নাড়া দেবে, সন্দেহ নেই।
লেখকের নামের শেষাংশই সাক্ষ্য দেয় তিনি এক গর্বিত উত্তরাধিকার বহন করছেন। পল্লীগানের সম্রাট আব্বাসউদ্দিনের পৌত্রী শারমিনী। শুধু এইটুকুতেই তাঁর শৈশব ও কৈশোরের সোনালী সংগীতময় দিনগুলোর একটা ছায়াছবি কল্পনা করে নেওয়া যায়। তবে এখানেই শেষ নয়। মায়ের দিক থেকে তিনি লাভ করেছেন সাহিত্যের উত্তরাধিকারও। তাঁর মা রম্যসাহিত্যসম্রাট সৈয়দ মুজতবা আলী’র ভগ্নিকন্যা। শারমিনীতো লেখক হতেই পারেন। বাবা মোস্তফা জামান আব্বাসীর সুর ও কলমের সঙ্গে যাদের পরিচয় আছে তাঁরা মনে করতে পারেন- বাপকা বেটিই বটে। যেমন মা তেমনি মেয়ে- বললেও ভুল বলা হয়না শারমিনী’র বেলায়, কারণ শিক্ষক, সংগঠক ও লেখক আসমা আব্বাসী তাঁর মা। আশীর্বাদ ও মমতায় ভরা ধন্য এক জীবন তাঁর। তবে তিনি বেড়ে উঠেছেন আপন প্রতিভায়, অনন্য হয়েছেন আপন শক্তিতে।
মূল্যবোধের শক্তি, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আর গভীর দেশাত্মবোধের সঙ্গে সততা ও ধর্মনিষ্ঠার অপূর্ব এক মেলবন্ধন শারমিনি আব্বাসি ও তাঁর রচনাসম্ভার। খুবই সাধারণ ভঙ্গিতে কন্যা ও পুত্রের সঙ্গে কথার মালা গেঁথে গিয়েছেন লেখক। প্রথম বই ‘আমার মেয়েকে বলি’ দেড় বছর বছর বয়সী কন্যার সঙ্গে কথোপকথনের স্মারক। ২০০২ সালে প্রকাশিত হয় প্রথমা প্রকাশনী হতে। পুত্রের জন্য লেখেন ‘অমৃতের পুত্র’। প্রকাশিত হয় ২০১৬ তে। প্রকাশক মাওলা ব্রাদার্স। কন্যা ও পুত্রের সঙ্গে একান্ত কথোপকথন বই দুটির মূল উপজীব্য হলেও পাঠক মাত্রই মনে হবে এ-যে আমারই কথা, আমার কন্যা ও পুত্রকে আমিতো একথাগুলোই বলতে চাই, কিন্তু বলা হয় না।
লেখকের ছেলেবেলা থেকে বড়বেলার টুকরো-টুকরো ছবি ছায়াছবির মতো ভেসে ওঠে পাঠকের সামনে। গেল শতকের আশির দশক যেন জীবন্ত হয়ে ধরা দেয় পাঠকের সামনে। পল্টনের বুকে প্রপিতামহির নামে নির্মিত ‘হীরামন মঞ্জিল’ এর একান্নবর্তী পরিবারে কেটেছে শৈশব ও কৈশোরের পুরোটা সময়। দুই পিতামহের উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে চলেন লেখক কণ্ঠে ও কলমে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ হতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতকোত্তর। যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিয়ে আসেন দ্বিতীয় দফা স্নাতকোত্তরের সনদ। এরপর বহুজাতিক কোম্পানির উচ্চপদে চাকরিরত অবস্থায় কন্যালাভ। কণ্ঠ সাধনায় ছেদ পড়লেও কলম কিন্তু বিরতিতে যায়নি। কাজের ফাঁকে সদ্যজাত মেয়ের গোলাপি মুখখানা তাড়িয়ে বেড়ায় তাঁকে। কত কথা আছে ওকে বলার! ঝোড়ো হাওয়ার বেগে বয়ে চলা দিনপঞ্জিতে তার কি ফুরসৎ মিলবে মেয়েকে দুদণ্ড সময় দেবার, জীবনের গল্প শোনাবার কিংবা ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ অশান্ত পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য রসদ যোগাবার, ঠিক যেমনটা করেছিলেন তাঁর বাবা-মা? মেয়েরও কি সময় হবে মায়ের কোলের কাছে বসে গল্প শোনার? একালের মেয়ে বলে কথা। তাইতো বই লেখা।
দেড় বছরের মেয়েকে যে গল্প শুনিয়েছেন তিনি, আমাদের ছেলেমেয়েরা তা প্রাণে ধরে এগিয়ে যেতে পারলে এক জীবনে রাশি-রাশি উপদেশ বর্ষণের প্রয়োজন পড়ে না। আমাদের মতো বাবা-মা, যারা উঠতি বয়সী সন্তান নিয়ে গভীর দুর্ভাবনায়, ডিজিটাল দুনিয়ার হাতছানি ক্রমাগত সন্তানদের দূরে বহুদুরে সরিয়ে অসহায় করে তুলছে যাদের, তাদের জন্য আলোর জানালা খুলে দেয় শারমিনীর লেখা। আমরা কি কেবল অন্তর্জাল আর সন্তানদেরই দোষ দিয়ে যাব? আমাদের কি কোন দায় নেই? প্রজন্মের সংঘাত জগত জুড়ে, দেশ কালের মাঝে পুরোমাত্রায় বর্তমান । এরই মাঝে চলতে থাকে জীবনধারা। সাফল্য কিংবা অগ্রগতিই জীবনের একমাত্র মোক্ষ হতে পারেনা। অথচ আমরা কেবল ছুটছি সেই সোনার হরিণের নেশায়। জগতটাকে ভাল করে চেনা, জানা বা শেখার আগেই আমরা ছুঁয়ে ফেলতে চাই আকাশ। বড্ড তাড়াহুড়ো আমাদের। নিরন্তর ছোটাছুটিতে অনেককিছু হয়তো পাওয়া হয়ে যায়, তবে হারিয়ে যায় ভালোবাসা, মায়া-মমতা, মানবিকতা।
সন্তান ভালোবাসা ও মানবিকতার প্রশিক্ষণ পায় কিন্তু বাবা-মায়ের কাছেই; কি বঙ্গদেশে, কি ভিনদেশে। শারমিনী’র লেখায় ঘুরে ফিরে ভালোবাসা ও মানবিকতার কথাই ফুটে ওঠে। ভালোবাসা মানুষের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি, ঐতিহ্যের প্রতি, দেশ-মাতৃকার প্রতি, সর্বোপরি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতি। এমন ভালোবাসা কিন্তু মোটেই অপার্থিব কিছু নয়। রক্তমাংসের প্রতিটি হৃদয়বান মানুষ এই ভালোবাসা ধারণ করতে পারেন। ধর্ম, বর্ণ, জাতীয়তা কিংবা সামাজিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদা কখনও এর মাপকাঠি হতে পারে না। ‘নতুন আলোর দিনের মেয়ে’র এই মা কিন্তু সন্তানের গুরুজন নন, বন্ধু হতে চান। কন্যাকে অলৌকিক আনন্দের সন্ধান দিয়েছেন শারমিনি, যার উৎস বই, শত শত বই। তিনি চান তাঁর সন্তান হবে অনেক বড়- ক্ষমায়, সৌন্দর্যে ও ভালোবাসায়। তবে এই সৌন্দর্যের সঙ্গে গাত্রবর্ণ, টিকলো নাক কিংবা ডাগর ডাগর চোখের কোন সম্পর্ক নেই। তিনি মনে করেন, “একবিংশ শতাব্দীর মেয়েরা আর রূপের সৌন্দর্যে গৌরবান্বিত হবেনা। গুন, মেধা ও হৃদয়ের যে ঐশ্বর্য সেটাই হবে সব”। রাপা প্লাজা কিংবা বিউটি পার্লারে ধর্না না দিয়ে বইয়ের জগত কিংবা চিত্রকলার ভুবনে ডুব দিতে বলেছেন তিনি মেয়েকে। তাঁর ভাষায়, “তুমি হাত ধরো সুন্দরের, তুমি হাঁটো আলোর মিছিলে”।
ক্ষণে-ক্ষণে ছেলেমেয়েদের লেখক ফিরিয়ে নিয়ে যান তাঁর স্বর্ণালী শৈশবে। পিতৃপুরুষ ও আদিমাতাদের কাছে তাঁর আজন্ম ঋণের কথা মনে করিয়ে দেন ওদের। নগর জীবনে একান্নবর্তী পরিবার প্রথা আজ নেই বললেই চলে। আমাদের সন্তানদের কাছে এসব গল্প তাই রূপকথা বলে মনে হতে পারে। ‘পবিত্র ভোরের সকাল হওয়া’ তাই দেখা হয়না আমাদের। সেকালের সকাল দুপুর সন্ধ্যা রাত্রিগুলো পাঠকের চোখে অন্যরকম মনে হয়, যদিও একটাই সূর্য, একটাই চাঁদ আজও উঠছে, ডুবছে পালা করে। ঋতু বদলের খেলা, ভোজন-উৎসব, পাড়ার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে এক্কাদোক্কা, ছিবুড়ি খেলা, চড়ুইভাতি ও নাটক করা, মায়া-মমতায় জড়াজড়ি করা অলস সময়গুলো হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। লেখক তাঁর সন্তানদের স্মৃতিতে বাঁচিয়ে রাখতে চান সেই সোনালী সময়।
পারিবারিক আবহে ধর্ম হয়ে উঠেছে লেখকের প্রধান আশ্রয়। নিজের ভুল কিংবা পাপের জন্য ভোরের আলোয় নামাজের পাটিতে বসে নিরাকার খোদার কাছে দু’হাত তোলেন; পাপ স্খলনের জন্য নয়, শান্তির জন্য; পরলোক নয়, ইহলোকের জন্যও। হালের প্রগতিশীল ও মৌলবাদের দ্বৈরথে ধর্মান্ধতা ও ধর্মহীনতা দুটোকেই ঘৃণা করেন লেখক। মেয়েকে তিনি মনে করিয়ে দেন, মানুষের কথা ভাবাই বড় ধর্ম- ‘অভুক্ত মানুষের কাছে যা জল, তা-ই পানি’।
‘সব পেয়েছির দেশ’ থেকে সগৌরবে ফিরে আসার গল্প শুনিয়েছেন তিনি মেয়েকে। কিন্তু ফিরে এসে কি দেখছেন ? “ধুলোমাখা পথ-ঝুরঝুর করা রাস্তা। মৃত নদীর মস্ত যেন এ- শহর। যেন কোন গতি নেই- আর এগুবেনা এ-নদী। শহরবাসীরা লক্ষ করেননি ওর ঠোঁটে সদ্য সকালের ঘুমভাঙা অভিমান? ‘ঢাকা’ শহর ঢাকা পড়েছে বড়ো বিচিত্র অবহেলায়”। আমাদের ভুলে, আমাদেরই লোভে ধুলিমাখা, গর্তভরা ঢাকাশহর, সবুজ হারিয়ে যাওয়া প্রকৃতি, বিষাক্ত সীসায় পরিপূর্ণ ও নীল হারিয়ে যাওয়া আকাশের এই বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ তরুণ পড়ার নামে দেশ ছাড়ে প্রতিদিন। ওরা আর ফিরে আসবে না এই বাংলায়। লেখক তবু স্বপ্ন দেখেন, একদিন সারিয়ে তোলা হবে সকল গর্ত, আবারও টলটলে বুড়িগঙ্গার ছেঁড়া পালের ফাঁক দিয়ে দেখা যাবে বিশুদ্ধ আকাশ।
নজরুল তাঁর প্রাণের কবি। রবীন্দ্রনাথ পথ দেখান চলতে-ফিরতে। জীবনানন্দের জন্য জমা আছে এক বুক বেদনা। দিজেন্দ্রলাল রায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, গ্যাটেদের কাছ থেকে হাত পেতে নেন কথামালা। এঁরা সবাই তাঁকে শক্তি যোগায়। তবে সবার ওপরে প্রিয় ব্যক্তিত্ব মহানবী (সা:)। মনিষীদের কাছে আজন্ম ঋণের কথা তাই মনে করিয়ে দেন সন্তানদেরও।