নতুন অঙ্গীকারের দেশ মূল লেখা : বারাক ওবামা

অনুবাদ : ফারহানা আনন্দময়ী | বৃহস্পতিবার , ২৬ নভেম্বর, ২০২০ at ১০:৩০ পূর্বাহ্ণ


[ভূমিকা : ক্রাউন পাবলিশিং থেকে গত সপ্তাহে প্রকাশিত হয়েছে আমেরিকার সাবেক রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার লেখা স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ A Promised Land. এই গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়টি অনূদিত হলো। হোয়াইট হাউজে ওবামার দিন শুরু হতো কীভাবে, সকালবেলাটা তিনি নিজেকে কীভাবে প্রস্তুত করে নিতেন সারাদিনের কর্মব্যস্ততার জন্য, দিনশেষে কী অনুভূতি হতো… এ সমস্ত বিষয়েই তিনি লিখেছেন এই অধ্যায়ে।]
যে সমস্ত ঘর, বারান্দা আর স্থাপনা দিয়ে হোয়াইট হাউজ সাজানো, এদের মধ্যে পশ্চিমের বারান্দাটাই ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয়। যার খোলা-পাশটায় সারবেঁধে সাদারঙা স্তম্ভগুলো স্থির দাঁড়ানো। প্রতিদিন সকালে এই বারান্দাটা ধরে আমি হেঁটে যেতাম অফিসে, ফিরেছিও এই পথে। বেশিক্ষণ সময় নিতো না পার হতে, বড়জোর এক মিনিট। এই সময়ের মধ্যে একটা খোলা হাওয়া আমাকে ছুঁয়ে যেত আর এতেই সারাদিনের কাজের শক্তি আমি পেয়ে যেতাম। প্রতি সকালেই, হয় কনকনে শীতের হাওয়ার একটা ধাক্কা, নয়তো গ্রীষ্মের তপ্ত বাতাস আমাকে প্রথম সম্ভাষণ জানাতো। ওইটুকু পথ হাঁটতে হাঁটতে আমি নিজেকে প্রস্তুত করে নিতাম সারাদিনের সভা-সমাবেশ, কংগ্রেসের সদস্যদের জোরালো যুক্তিতর্কে অংশ নিতে, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগ্রহণ কিংবা ক্রমাগত পাক-খেতে-থাকা সমস্যা আর তার সমাধানের জন্য।
হোয়াইট হাউজের ইতিহাসে প্রথমদিকে নির্বাহীদের অফিস আর রাষ্ট্রপতির বাসভবন ছিল এই দালানের একই ছাদের নিচে। পশ্চিমের এই বারান্দাটা তখন ছিল কেবলই ঘোড়ার আস্তাবলে যাবার পথ। কিন্তু টেডি রুজভেল্ট প্রেসিডেন্ট হয়ে হোয়াইট হাউজে আসার পরে, তিনি দেখলেন, এতজন কর্মকর্তা-কর্মচারী, ছয়জন বাচ্চার হল্লা আর নিজের নির্জনতা…এদের একত্রে বসবাস কঠিন। তাঁর পরিকল্পনাতেই হোয়াইট হাউজ দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল- ওভাল অফিস আর পশ্চিম-শাখায়। আর দশকের পর দশক ধরে এই পশ্চিমের বারান্দাটা হয়ে উঠলো এই দুই অংশের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ পথ। বারান্দার উত্তর-পশ্চিম দিকটা বেঁধে দেয়া হলো গোলাপবাগান দিয়ে। উত্তরদিকে পুরু দেয়াল আর অর্ধেক-চাঁদের আকারের বড় বড় জানালা; এবং পশ্চিমদিকে মোটা মোটা সাদা স্তম্ভ সারি বেঁধে দাঁড়ানো… এই পথটুকু যেতে মনে হতো এই স্তম্ভগুলো আমাদেরকে গার্ড-অফ-অনার দিচ্ছে! যেন নিরাপত্তাপ্রহরী তারা।
এমনিতে আমি ধীরে হাঁটা মানুষ- ‘অ্যা হাওয়াইয়ান ওয়াক’ এই চালে হাঁটি। মিশেল অবশ্য এটা নিয়ে মাঝেমধ্যে অধৈর্য্য হতেন। তবে পশ্চিমের এই বারান্দাটা দিয়ে যখন হাঁটতাম, হাঁটার ধরণ বদলে যেত আমার। ওই সময়টুকু পেছনের ইতিহাস, এখানের পরম্পরা, যাঁরা এই পথ দিয়ে হেঁটে গেছেন আমার আগে… এই সমস্ত ভাবনা কাজ করতো আমার চেতনে, অবচেতনে। পদক্ষেপগুলো দীর্ঘ হতো, অপেক্ষাকৃত দ্রুত আর সশব্দ হতো আমার পদধ্বনি। কয়েক গজ পেছনে হেঁটে আসা আমার নিরাপত্তা-কর্মকর্তাদের পদধ্বনির সাথে মিলে যেত। বারান্দার শেষ প্রান্তে পৌঁছে একটা র‌্যাম্প ছিল। আমি স্পষ্ট দেখতে পেতাম সেই র‌্যাম্পে একটা হুইল চেয়ার। আর প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট সেখানে বসে আছেন, স্মিতমুখে, ঋজু চাহনি, দু’ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট চেপে ধরেছেন শক্ত করে আর হুইলচেয়ারটাতে বসে এগোচ্ছেন। কাচের দেয়ালের ওপাশে যে প্রহরীরা দাঁড়িয়ে থাকতেন, আমি প্রতিদিনই হাত নেড়ে কুশল বিনিময় করতাম। প্রায়ই দেখেছি, কিছু উৎসুক দর্শনার্থীকে ওরা সামলে রাখার চেষ্টা করছেন। কখনো যদি সুযোগ হতো, ওদের সাথে করমর্দন করতাম। দু’একটা কথা বিনিময় হতো, কোথা থেকে এসেছেন, এসব আর কী! এরপরেই আমাকে বামদিকে ঘুরে কেবিনেট রুমের পাশ দিয়ে ঢুকে যেতে হতো ওভাল অফিসে। সামনে বসা কর্মচারীদের সাথে কুশল বিনিময় করে, গরম চায়ের মগটা হাতে নিয়ে আমি দিনের কাজে ঢুকে যেতাম।
সপ্তাহের মধ্যে বেশ কয়েকবার করে আমি হঠাৎ করে বেরিয়ে আসতাম বারান্দাটায়। সামনের গোলাপ বাগানে যারা কাজ করতেন, ওরা সকলেই ছিলেন ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিসের কর্মচারী। বেশিরভাগই বয়স্ক মানুষ, গাঢ় সবুজ রঙা খাকি পোশাক পরে থাকতেন তারা, সাথে সবুজ বড় টুপি আর শীতের ঠাণ্ডা এড়াতে মোটাসোটা কোট গায়ে। যেদিন আমার খুব একটা তাড়া থাকতো না কাজের, এগিয়ে গিয়ে ওদের সাথে কথা বলতাম। কোন্‌গাছটা নতুন লাগানো হলো, গতরাতের ঝড়ে কোন্‌ফুলগাছটা নুয়ে পড়লো, এধরণের গাছগাছালি আলাপ। তারা একটু মাথা দুলিয়ে বা ধরাবাঁধা নিয়মের মধ্যে থেকেই প্রশ্নের উত্তর দিত, তবে খুব সংক্ষিপ্ত।
এদের মধ্যে এড থমাস নামের একজন দীর্ঘদেহী কৃষ্ণাঙ্গ ছিলেন, বয়সের চাপে থুতনির কাছটায় ভেঙেচুরে গেছে, গত চল্লিশ বছর ধরে এই সার্ভিসে নিযুক্ত আছেন। প্রথমবার যেদিন তাকে দেখেছিলাম, আমার মনে আছে, প্যান্টের পেছনের পকেট থেকে একটা কাপড় বের করে হাতটা মুছে তবেই আমার হাতে হাত মিলিয়েছিলেন। জিজ্ঞেস করেছিলাম, অবসরে যাবার আগে আপনি কতদিন আরো কাজ করতে ইচ্ছুক এখানে? থমাস উত্তর দিয়েছিলেন, “আমি ঠিক জানি না, মিস্টার প্রেসিডেন্ট। আমার হাড়ের জয়েন্টে কিছু সমস্যা আছে। তবুও আমি কাজ করতে চাই, যতদিন এখানে আপনি থাকবেন। আমি চাই বাগানটা ততদিন এমন সুন্দর রাখতে”।
বাগানটা সত্যিই খুব সুন্দর ছিল দেখতে! ম্যাগনোলিয়ার ঝাড়গুলো কী দারুণ ঝুলে থাকতো উপর থেকে। গাঢ় সবুজ রঙের ঘাসের ঝোপ চারপাশ ঘিরে আছে, ক্র্যাব আপেল গাছটা পাশেই। বেশ খানিকটা দূরে গ্রিনহাউজে শোভা পেত হরেক রঙের ফুল…লাল, হলুদ, গোলাপি, বেগুনি রঙের বন্যা বয়ে যেত সেখানে। বসন্তে টিউলিপ সূর্যের আলোতে আরো উজ্জ্বল হয়ে রঙ ছড়াতো। আর গ্রীষ্ম এলে ল্যাভেন্ডার, ক্রিসেনথিমাম, হেলিয়োট্রোপ আর নাম-না-জানা বুনো ফুলেরা ভরে উঠতো বাগান জুড়ে। তবে বারোমাসই থোকায় থোকায়, কোণায় কোণায় ফুটে থাকতো লাল, হলুদ আর সাদা গোলাপগুচ্ছ।
আমার প্রিয় সেই পশ্চিমের বারান্দা দিয়ে যখনই আমি হেঁটেছি, কিংবা ওভাল অফিসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছি; দেখতাম কিছু মানুষ সারাক্ষণ গভীর মনোযোগ দিয়ে মাঠে কাজ করছেন। অফিসের দেয়ালে আমি টাঙিয়েছিলাম নরম্যান রকওয়েল-এর ছোট একটা চিত্রকর্ম। জর্জ ওয়াশিংটনের পোট্রেট-এর পাশে আর মার্টিন লুথার কিং-এর মূর্তির উপরেই চিত্রকর্মটি টাঙানো। ডুংগারিজ পরে পাঁচরকমের গাত্রবর্ণের পাঁচটি ছোট ছোট মানুষ দড়ি বেয়ে উঠে, নীল আকাশের গায়ে হেলান দেয়া লেডি লিবার্টির ল্যাম্পটি পরিষ্কার করছে, ছবিটায় আঁকা। ছবির ওই মানুষগুলো আর বারান্দার বাইরে কাজ করা গ্রাউন্ডস্‌ম্যানেরা… মনে হতো এরাই পথপ্রদর্শক। মনে হতো, নীরবে এরাই ধাপগুলো দেখিয়ে দিচ্ছেন। নিজেকে তখন আমি বলতাম, আমাকেও ঠিক এদের মতোই কঠিন পরিশ্রমী হতে হবে নিজ দায়িত্বপালনে আর আরো অনেক যত্নবান হতে হবে নিজের কাজে।
এই বারান্দা ধরে হেঁটে যাবার সাথে আরো কিছু স্মৃতি যুক্ত আছে। বাইরে আমন্ত্রিত বিদেশি অতিথিদের সমাবেশ, মুহূর্মুহূ ক্যামেরা ফ্ল্যাশ-আলো জ্বলে ঝলকিত করছে চারপাশ, সাংবাদিক সম্মেলন… এরকম কতকিছু। এর পাশাপাশি কিছু মিষ্টি স্মৃতিও কখনো ভুলবার নয়। কোনো কোনোদিন বিকেলে মালিহা আর শাশা বাগানে চলে এসে আমাকে চমকে দিত। কখনো আসতো আমাদের পোষা কুকুর, বো আর সানি। শীতকালে ওরা এলে বরফে ওদের পায়ের থাবার ছাপ পড়ে যেত, মুখের পশমে বরফ মাখামাখি হয়ে সাদা দাড়ির মতো দেখাতো। আবার গ্রীষ্মের দিনের স্মৃতি অন্যরকম আনন্দের। ওদের সাথে যখন ফুটবল টস করতাম বাগানে; আমার সারাদিনের কাজের ক্লান্তি দূর হয়ে যেত নিমেষে।
পেছনে ফেলে আসা এই স্মৃতিগুলো এখনো নাড়া দেয় আমার মনকে। বর্তমানের হিসেবনিকেশকে গুলিয়ে দেয় কখনো। সময় বয়ে যাচ্ছে, এটা মনে করিয়ে দেয়। ইচ্ছেটাকে জাগিয়ে দেয়, ঘড়ির কাঁটা পেছনে ঘুরিয়ে নিয়ে আবার যদি নতুন করা শুরু করা যায়! এই ভাবনাগুলো সকালের সেই প্রাতঃভ্রমণে এভাবে ভাবাটা সম্ভব ছিল না। তখন দায়িত্ব আর নিয়মনীতির একটা তীর আমার দিকে তাক করা থাকতো। আমাকে কেবল ভাবতে হতো, ঠিক সামনে দাঁড়ানো সমস্যাটা নিয়ে।
সেই বারান্দায় রাতগুলো ছিল ভিন্ন রঙের। সন্ধ্যা গাঢ় হলে যখন আমি ঘরের পথে ফিরতাম, হাতে কাগজপত্তরে ভর্তি ব্রিফকেইস, হাঁটার গতি কমে যেত আমার। কখনো থেমেও থাকতাম। বাতাসে মাটির, ঘাসের আর কখনো ফুলের রেনুর ঘ্রাণ ভেসে আসতো। আমি গভীর শ্বাস নিতাম। কখনো বাতাসের শব্দ শুনতাম কান পেতে, কখনো বা বৃষ্টির শব্দ। কখনো তাকিয়ে থাকতাম সাদা স্তম্ভগুলোর গায়ে ঠিকরে পড়া সন্ধ্যার আলোর দিকে, হোয়াইট হাউজের অনিন্দ্য সৌন্দর্যের দিকে, ছাদে উড়তে-থাকা উজ্বল পতাকার দিকে। রাতের কালো আকাশের বুক চিরে দাঁড়িয়ে থাকা দূরের ওয়াশিংটন মনুমেন্ট-ও কখনো আমার দৃষ্টিকে থমকে দিত। মাঝেমাঝে রাতের আকাশের চাঁদ আর তারারাও আমার চোখকে টেনে নিত মুগ্ধতায়, যেমন নিত উড়ে যাওয়া জেট-এর মিটমিট করে জ্বলা বৈদ্যুতিক আলোর কণাটি-ও।
আমার ফেলে-আসা জীবনের কতরকমের স্মৃতি, ভাবনা, দর্শন-ই পথ দেখিয়ে এই হোয়াইট হাউজে একদিন পৌঁছে দিয়েছিল আমাকে।
ফারহানা আনন্দময়ী : কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক

পূর্ববর্তী নিবন্ধনতুন যুগের মার্কেটিং
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজকাল