শ্রেষ্ঠ নজরুল স্বরলিপি, হরফ প্রকাশনী, এ–১২৬, ১২৭ কলেজ স্ট্রিট মার্কেট, কলকাতা এর সম্পাদক আব্দুল আজিজ আল আমান গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, ‘নজরুল সঙ্গীত নিয়ে আজ পর্যন্ত যতগুলি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এবং যত আলোচনা চোখে পড়ে, এমনকি তাঁর সমসাময়িক অন্তরঙ্গ সুধীজনও যে সব মন্তব্য করেছেন সবের সার সংক্ষেপ করলে কবির সুর শিক্ষার চিত্রটি মোটামুটি এই রকম দাঁড়ায় :
ক) নজরুল কোনদিন সুরের দীক্ষা গ্রহণ করেননি। খ) যখন যে অবস্থায় থেকেছেন সেখান থেকেই সুর গ্রহণ করেছেন। যেমন বিভিন্ন পল্লীতে থাকাকালীন সংগ্রহ করেছেন বিভিন্ন লোকসংগীতের সুর। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সন্দ্বীপে বেড়াতে গিয়ে নিয়ে এলেন সাম্পানের গান ও ভাটিয়ালির বাঁশী, বৈষ্ণব বাবাজীদের আখড়ায় গিয়ে কীর্তনের পুঁজি বাড়ালেন, সাঁওতাল পল্লী থেকে ঝুমুর ইত্যাদি। গ) গজলের সুর নিয়েছেন উর্দু গজল থেকে। ঘ) পথচারী হিন্দুস্তানীদের কণ্ঠ থেকে, নাচের ছন্দ থেকে, রাখালের বাঁশী থেকে, ভিখারিদের আকুতি থেকে তাঁর সুর ভাণ্ডার সম্বৃদ্ধ করেছেন। ঙ) জমিরুদ্দিন খানের কাছে তিনি নম নম করে কিছুদিন সুরের তালিম নিয়েছেন মাত্র ।
কেবলমাত্র এই পুঁজি নিয়েই কি নজরুল বাংলা সংগীতের জগতে নতুন সুর সৃষ্টি ও সুর সংযোজনায় নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে গেলেন! আমাদের সংগীত– ইতিহাসে তো বটেই, এমন কি পৃথিবীর ইতিহাসেও সর্বাধিক সংগীত রচয়িতার শিরোপাসহ সুর – যোজনার এবং নতুন সুর– সৃষ্টিতে তিনি যে অসামান্য অবদান রাখলেন বাংলা সংগীতে তার কোন দ্বিতীয় নজির নেই। রবীন্দ্রনাথের কথা স্মরণ রেখেও আমরা নির্দ্বিধায় একথা উচ্চারণ করছি। রাগ–রাগিনী একান্তভাবে করায়ত্ত না হলে কোন গীতিকার ও সুরকারের পক্ষে এরূপ অসাধ্য সাধন সম্ভব নয়। অল্প পুঁজি বা ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে নজরুলের পক্ষেও এটি করা সম্ভব হয়নি। সুতরাং কবির সুরজ্ঞান ও রাগ অভিজ্ঞতার ব্যাপারটি আমাদের অন্যত্র অনুসন্ধান করতে হবে।
রাগ রাগিনী সম্পর্কে নজরুলের অসামান্য ঐতিহাসিক সৃষ্টি ‘স্বর ও শ্রুতি’ গ্রন্থটি পাঠ করলে রাগ– রাগিনী সম্পর্কে নজরুলের পঠন–পাঠন ও অভিজ্ঞতা যে কত গভীর তা কিছুটা উপলব্ধি করা যায় এবং তিনি যে কেবল সুর চর্চা করেননি – অসামান্য প্রতিভা বলে হয়ে উঠেছিলেন ওস্তাদের ওস্তাদ।
এই মহাসুরজ্ঞানী, সংগীতজ্ঞ, কবি, সাহিত্যের সব শাখায় সংগীতের মতো অবাধে বিচরণ করেছেন, সৃষ্টি করেছেন যুগোপযোগী অবিস্মরণীয় সব কবিতা, কাব্য। তাঁর বিশাল গানের সমুদ্রে রয়েছে সংগীতের অমূল্য সব সম্পদ। সংগীতের ভাষা, শব্দ, সুর, তাল, রাগ প্রভৃতি তাঁকে পৌছে দিয়েছে অনন্য মাত্রায়।
আমরা যেমন বিস্ময় ভরা চোখে দেখি কাজী নজরুল ইসলাম এর গান ব্যতীত ঈদ আনন্দ হয় ফিকে ও ম্লান, আবার ঠিক তেমনি তাঁর গান ছাড়া বর্ষার রূপ, বর্ণনা ও প্রেম বন্দনাও হয় অনুজ্জল।
ষড়ঋতু নিয়ে আমরা যেমন দেখি তার অনন্যসাধারণ বিখ্যাত সব রচনা, আবার সেখানে বর্ষার মর্ম নির্ভর সংগীত পাই অধিক।
বর্ষার রূপে মুগ্ধ কবির প্রদত্ত কিছু বিশেষণ, উপমা এখানে উল্লেখ করার মতো যেমন, অঝোর ধারার জল, ঘনদেয়া, দমকে দামিনী চমকে, ঝমকায় ঝাঝর, রুমঝুম ঝমকে, মরাল মরালী, বাদলের বারি, রিম ঝিম ঝিম, মেঘ ঘন কুন্তল, কালো বরষা, জলের ঘাগরি, এলায়ে মেঘবেণী, কালফণী প্রভৃতি শব্দের উপস্থিতি ও প্রয়োগ, যেমন আছে তেমনি কালিদাসের মেঘদূত, রাধাকৃষ্ণের কাজুরী কিম্বা ঝুলনের আঙ্গিকও রয়েছে সমানভাবে। সেই সাথে প্রেম ফুটে উঠেছে বার বার। যেখানে বর্ষা এবং প্রেম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে মূর্ত হয়েছে সুন্দর, কখনো বিরহ কখনো আর্তি নিয়ে সমভাবে বা কখনো বর্ষাকে ছাপিয়ে গেছে প্রেম বিরহ।
যেমন,
যাও মেঘদূত দিও প্রিয়ার হাতে / আমার বিরহলিপি লেখা কেয়াপাতে। কিম্বা, শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এলনা। বা
কাজরীয় কাজল মেঘ পথ পেল খুঁজিয়া, কিম্বা, বাঁধলে বাঁধলো ঝুলনিয়া। বা, পরদেশী মেঘ যাওরে ফিরে /বলিও আমার পরদেশী রে।
অধিকন্তু নিপূণভাবে প্রিয়ার বর্ণনা দেখি নজরুলের অনেক কবিতায়ও।
যেমন, আমার প্রিয়ার দীর্ঘ নিঃশ্বাসে
থির হয়ে আছে মেঘ যে দেশের আকাশে।
বর্ষা নিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত গান
যেটি চলচ্চিত্রে, বিরহে, প্রেমে অনন্য হয়ে আছে, যেটি গেয়ে বহু শিল্পী বিখ্যাত হয়েছেন সেটি হল,
‘শাওন রাতে যদি / স্মরণে আসে মোরে / বাহিরে ঝড়ো বহে / নয়নে বারি ঝরে’।
নজরুলের গানে বর্ষা ও প্রেমের সাথে বিরহ মিশে আছে সমানভাবে যেমন,
‘ঝুরিবে পূবালী বায় গহন দূর বনে / রহিবে চাহি তুমি একলা বাতায়নে / বিরহী কুহুকেকা গাহিবে নিপ শাখে /যমুনা নদী পারে শুনিব কে যেন ডাকে’।
গহন বন, একেলা বাতায়ন, কুহুকেকা, নীপ শাখ। প্রেম প্রিয়ার বিরহ সকল কিছু বর্ষার সংগে মিলে তৈরি করেছে এক গভীর ব্যঞ্জনা।
আবার
বাঁধলো বাঁধলো ঝুলনিয়া / নামিল মেঘলা মোর ভাদরিয়া/ চল তমাল একে সারি কাজরীয়া/ চললো গৌরী শ্যামলিয়া।
বর্ষা, প্রিয়া আর বিরহের দৃশ্য অনেক গানে এঁকেছেন কবি যেমন,
অথৈ জলে মাঠ ঘাট থৈথৈ / আমার প্রিয়ার আগুন নিভিল কৈ?
অন্যখানে,
কেমনে রাখি আঁখি বারি / এ ভরা ভাদর তোমার মায়া নদী / উথলি উথলি উঠছে নিরবধি।
গ্রীষ্ম, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত ছাপিয়ে কবি লিখেছেন– বর্ষা ঋতু (আষাঢ় ও শ্রাবণ) নিয়ে শতাধিক গান।
তৎমধ্যে কাজরী, কাব্যগীতি, রাগ প্রধান, খেয়াল, ঠুমরি আধুনিক, ঝুলন, চৈতি উল্লেখযোগ্য।
কেবল শ্রাবণ, বিরহ, প্রেম নিয়ে কবি লিখেছেন ৬০টি গান। এ সকল গানে মিশেছে মায়া, ভালোবাসা, তালের বৈচিত্র্য ও প্রাঞ্জল শব্দের বুনন। তাতেই তাঁর সাহিত্য, সংগীত সৃষ্টি অনবদ্য।
বর্ষা আসলেই মনে পড়ে কবি কাজী নজরুল ইসলামের গান,
বরষা ঐ এল বরষা / অঝোর ধারার জল / ঝরঝরি অবিরল/ ধূসর নীরস ধরা হল সরসা।
ঘন দেয়া দমকে দামিনী চমকে / মনে পড়ে সুদূর মোর প্রিয়তমকে মরাল মরালী হেরি সহসা।
নজরুলের অনেক গানেই ধরা দিয়েছে বর্ষা অপরূপ রূপে। বর্ষার রূপ আর কবির আবেগ মিলে মিশে একাকার হয়েছে এসব গানে ও সুরে। তিনি বর্ষাকে বলেছেন, ‘বাদলের পরী’। লিখেছেন, ‘রিম ঝিম রিমঝিম ঝিম ঘন দেয়া বরষে/ কাজরী নাচিয়া চল পুরনারী হরষে’। নজরুলের গানের কথা ও সুর দারুন। এক মহা ঘোরের ভেতর বশী করে রাখে শ্রোতাদের।
প্রকৃতি বদলে যায়। বদলে যায় মানুষের মন। কিন্তু নজরুলের গান, সুর, প্রেম, বিরহ থাকে চিরন্তন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, গবেষক, সংগীতশিল্পী।