নজরুলের ইসলামী গান : জনপ্রিয় এবং অনন্য

এস ডি সুব্রত | শুক্রবার , ৩০ মে, ২০২৫ at ৭:১৪ পূর্বাহ্ণ

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম মুসলিম ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের সাথে কুরআন ও হাদিসের আলোকে লিখেছেন সাড়া জাগানো কালজয়ী ইসলামী গানগজল, হামদ ও নাত।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম একাধারে বিশ শতকের একজন খ্যাতিমান কবি, সাহিত্যিক, সমালোচক, সম্পাদক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চলচ্চিত্র পরিচালক ও অভিনেতা। ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কবিকে স্বাধীন বাংলাদেশে এনে জাতীয় কবির মর্যাদা দেয়া হয়। মাত্র ২০ বছরের সাহিত্য জীবনে কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন তাঁর অসাধারণ প্রতিভা দিয়ে। কবি হিসেবে সর্বাধিক পরিচিতি লাভ করলেও বাংলা সংগীত ভূবনে অসাধ্য সাধন করেছেন তিনি। তার রচিত গানের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার! তাঁর লেখা গানেই ইসলামী সঙ্গীত জগত হয়ে উঠেছে সমৃদ্ধ ও জনপ্রিয়। তাঁর লেখা সঙ্গীত ছাড়া ইসলামী সঙ্গীত ে যেন অপূর্ণ থেকে যায়। তাঁর সমসাময়িককালে কবি গোলাম মোস্তফা ও অন্যান্য দু’একজন কবি ইসলামী সঙ্গীত রচনায় নিমগ্ন থাকলেও কাজী নজরুলই ইসলামী সঙ্গীতের ভান্ডারকে কানায় কানায় পূর্ণ করেছেন এবং জনপ্রিয় করেছেন । বাংলা সংগীত জগতের কোনো গীতিকার এখনো নজরুলের সংগীত রচনার রেকর্ড ভাঙতে পারেননি। নজরুল নিজেই বলেছিলেন, আমার জীবনে প্রথম সুন্দর আসে ছোটগল্প হয়ে, তারপর কবিতা, নাটক, উপন্যাস হয়ে বহুবার ধরা দিয়েছে। অবশেষে সংগীত হয়ে আমার মাঝে বিরাজ করেছে সেই সুন্দর । নজরুল ইসলামের হাত ধরেই বাংলা সংগীতে প্রথম গজল, শ্যামা সংগীত, ইসলামী সংগীতের সৃষ্টি। এছাড়াও বাংলা সংগীতে ২০ টিরও বেশি রাগের জন্ম নজরুলের হাতে। মধ্যপ্রাচ্যের সুর ও আবহ তৈরি করে বাংলা সংগীতকে তিনি রক্ষণশীল মুসলিম সমাজের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। তবে নজরুলের সৃষ্ট সংগীতের মধ্যে গজল আর ইসলামিক গান দুটি কিন্তু ভিন্ন। ইসলামি গানে শুধুই আল্লাহ, রসুল, তাওহিদ, ইসলামের সংস্কৃতির কথা বলা হয়। যেমন নজরুলের জনপ্রিয় একটি ইসলামি সংগীতের বাণীতে রয়েছে

কলমা শাহাদতে আছে খোদার জ্যোতি।

ঝিনুকের বুকে লুকিয়ে থাকে যেমন মোতি।।

ঐ কলমা জপে যে ঘুমের আগে

ঐ কলমা জপিয়া যে প্রভাতে জাগে,

দুঃখের সংসার যার সুখময় হয়, তা’র

তার মুসিবত আসে না কো, হয় না ক্ষতি।।”

বাংলা গান রচনায় সংখ্যার দিক থেকে রবীন্দ্রনাথকেও কাজী নজরুল ইসলাম ছাড়িয়ে গেছেন । একসময় নজরুল রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতেন ও শুনতেন। তিনি এত পরিমাণ রবীন্দ্র সঙ্গীত মুখস্ত গাইতে পারতেন যে, তৎকালীন সময়ের গুণী শিল্পীরাও হার মানতেন। তিনি আধুনিক গান, প্রেমের গান, শ্যামা সঙ্গীত, ইসলামী গান লিখেছেন। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট নজরুল গবেষক শাহাবুদ্দীন আহমদ তার নজরুল সাহিত্য বিচার গ্রন্থে ‘নজরুলের গান এবং তার বৈশিষ্ট্য প্রবন্ধে লিখেছেননজরুল ইসলাম নানা রকম গান লিখেছেন। আধুনিক গান, গজল, ইসলামী, কীর্তন, রামপ্রসাদী, শ্যামা সঙ্গীত ও বিভিন্ন রকম সঙ্গীত। তিনি একা অজস্র ইসলামী গান লিখেছেন বলে এবং বাংলা ভাষায় তাঁর ইসলামী গান সবিশেষ পরিচিত বলে আমরা ইসলামী গান শুনলেই মনে করি সেটা নজরুলের। নজরুলের গানের ভেতরে আছে উন্নত উপমা, চিত্রকল্প, দর্শন । সেই সাথে সুরে সুরে আছে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের খেয়াল, ঠুংরি ও টপ্পার সংমিশ্রণ। নজরুলের আগে বাংলায় কেউ গজল গান লেখেননি। তিনিই প্রথমে বাংলা গানে গজল রচনা করেছেন। তাঁর গজল সৃষ্টিরসে অতুলনীয়। তাঁর গজলে অবশ্য ইরানি মহাকবি হাফিজের প্রভাব লক্ষণীয়। সেই সাথে ওমর খৈয়ামেরও। তাঁর অসংখ্য গজল গান হৃদয়কে বিমোহিত করে। তাঁর একটি গজল

বাগিচায় বুলবুলি তুই

ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল।

অথবা দেখি

আমারে চোখ ইশারায় / ডাক দিলে হায়

কেগো দরদী।”

কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৩০ পরবর্তী সালে গ্রামোফোন কোম্পানির সাহচর্যে আসার পর থেকে লোকগীতি সম্রাট আব্বাস উদ্দীন আহমদের তাগিদে ইসলামী গান রচনায় মনোনিবেশ করেন। গ্রামোফোন রেকর্ডের জন্য তিনি লিখলেন-“ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ”, “ইসলামের ঐ সওদা নিয়ে এলো নবীন সওদাগর।” আব্বাস উদ্দীনের কণ্ঠে গান দুটি গ্রামোফোন কোম্পানি বের করলে তা জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম মুসলমান জনগোষ্ঠীর চোখের মণি হয়ে ওঠেন। এই গান এখনো আমাদের রোজার শেষে ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখার সাথে সাথে হৃদয়কে সুরের ভুবনে ডুবিয়ে দেয়। এই গান ছাড়া ঈদ আমাদের অসম্পূর্ণ থেকে যায় যেন । ইসলামী গান একের পর এক রচনা করতে থাকেন। আমাদের প্রিয় আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ সা.এর দুনিয়াতে তাশরিফ আনার মুহূর্তটিকে তার কল্পনায় মাধুরী মিশিয়ে লিখলেন অপূর্ব একটি গান

তোরা দেখে যা আমিনা / মায়ের কোলে

যেন ঊষার কোলে / রাঙা রবি দোলে।

কাজী নজরুল ইসলামের ইসলামী গানের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলোবাংলা শব্দ অলঙ্কারের পাশাপাশি আরবি, ফার্সি শব্দের সংযোজন, যা তাঁর গানের বাণীর ব্যঞ্জনাকে সমৃদ্ধতর করে গভীর হৃদয়ে দাগ কেটে যায়। তিনি ছিলেন যুক্তিবাদী কবি, তাই তাঁর লেখা ইসলামী গানেও আমরা সেই যুক্তিপূর্ণ গানের পরিচয় পাই। গজল প্রেমিকপ্রেমিকার গান হলেও এ গান এমন একটি শৈলী যাতে প্রেম ও ভক্তির অপূর্ব মিলন ঘটেছে। পার্থিব প্রেমের পাশাপাশি গজল গানে আছে অপার্থিব প্রেম, যে প্রেমে স্রষ্টার প্রতি আত্মার আকুতি নিবেদিত।

কবি আল্লাহর ঘোষণাকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন। তাই তিনি হাশরের মাঠে ভয়ে ভীত না হয়ে বরং আল্লাহর সাক্ষাতে খুশি হয়ে উঠবেন। তাঁর একটি ইসলামী গানে তিনি সেই কথাই বর্ণনা করেছেন…!

‘‘ যেদিন রোজ হাশরে করতে বিচার তুমি হবে কাজী

সেদিন তোমার দিদার আমি পাবো কি আল্লাজি।

সেদিন নাকি তোমার ভীষণ কাহহার রূপ দেখে

পীর পয়গম্বর কাঁদবে ভয়ে ইয়া নফি্‌স ডেকে

আমি তোমায় দেখে হাজারবার দোজখ যেতে রাজি।”

পূর্ববর্তী নিবন্ধঋষিণ দস্তিদার
পরবর্তী নিবন্ধপ্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটিতে মেন্টাল হেলথ বিষয়ক সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম