‘প্রজাপতি প্রজাপতি, কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা’! প্রজাপতির মতোই মন চঞ্চল হয়ে গেলো আমার। শৈশবের প্রথম রঙিন ভাবনা, পাখা মেললো দূর আকাশে। তারপর তোলা হলো ‘শুকনো পাতার নূপুর পায়ে’ গানটা। অল্প অল্প বুঝতে পারছি, কিছুটা পারছি না। কিন্তু সুরটা বেশ গেঁথে গেলো মনে। কেমন অদ্ভুত সুন্দর কথা, সুর, তাল। নদীর জলের মতো টলটলে। এ সুর ও তালের সাথে আমাকে প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, আমার গানের শিক্ষক শ্রদ্ধেয় প্রদীপ দাশ। তিনি ছিলেন একজন অন্ধলোক। চোখে দেখতেন না কিন্তু কী অসাধারণ প্রতিভা তার! একদিন তিনি আমায় শেখাতে বসলেন, ‘আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়, দেখে যা আলোর নাচন’ শ্যামার সেকি রূপ! মহাকাল তাঁর পায়ের তলায় বুক পেতে দেন। আমার ছোট্টো শিশুমন ভক্তিরসে সিক্ত হলো। তারই ধারাবাহিকতায় আরেকটি গজল, ‘তোরা দেখে যা আমেনা মায়ের কোলে, মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদ দোলে’। আমার শিশুমন পরিচিত হলো আরেকটি ধর্মীয় পরিমণ্ডলের সাথে। তার ইতিহাস, ঐতিহ্য, আবেগ, ভালোবাসার নব দিগন্ত উন্মোচিত হলো আমার সামনে। সেদিন আমায় তিনি চেনালেন একজন কাজী নজরুল ইসলামকে। আমি তাঁকে চিনলাম রণ সংগীতে।
‘চল চল চল——চলরে চলরে চল’!
তাঁকে আবিষ্কার করলাম বিদ্রোহী কবি হিসেবে।
তিনি যখন উদাত্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, বিদ্রোহের সেই চিরন্তন বাণী–
“বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া।
উঠিয়াছি চির – বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর”!
এ তাঁর আরেক রূপ! রণ তূর্য হাতে বিদ্রোহী রণসাজে সজ্জিত এক মহাবীর! তারপরই যখন প্রেমে আবেগে মাখামাখি হয়ে ভাসিয়ে দিলেন সুরের তরী, তখন তিনি বাঁশরী হাতে স্বয়ং প্রেমময় শ্রীকৃষ্ণ! তিনি গাইলেন–
‘আজো মধুর বাঁশরী বাজে–
গোধূলি লগনে বুকের মাঝে’।
অথবা, প্রেমিক পুরুষরূপে যখন গেয়ে উঠলেন–
‘আলগা করোগো খোঁপার বাঁধন’
তখন সে তাঁর ভিন্ন রূপ!
নজরুলের কীর্তন বাংলা সাহিত্যের আরেকটি বিশেষ দিক। তাঁর রচিত ভজন আর কৃষ্ণ গানে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কৃষ্ণ প্রেমের চরম অভিব্যক্তি।
‘ওরে নীল যমুনার জল
বল রে মোরে বল,
কোথায় ঘনশ্যাম, আমার কৃষ্ণ ঘনশ্যাম।
আমি বহু আশায় বুক বেঁধে যে এলাম, এলাম ব্রজ ধাম’।
কখনো বলে উঠলেন সদানন্দ চিত্তে–
‘গাহ নাম অবিরাম, কৃষ্ণনাম কৃষ্ণনাম,
মহাকাল যে নামের করেন প্রাণায়াম’।
কখনো শ্রীহরিকে জানতে চাইলেন আকুল হয়ে
‘সখী সে হরি কেমন বল,
নাম শুনে যার এত প্রেম জাগে
চোখে আনে এত জল’।
তেমনিভাবে এখনো তাঁর গান ছাড়া বাঙালি মুসলমান ঈদের আনন্দানুভূতি প্রকাশ করতে পারে না। ঈদের চাঁদ দেখে তাঁর রচিত গানেই আমরা গেয়ে উঠি : ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’।
ঈদের আনন্দ, সৌন্দর্য ও আধ্যাত্মিক চেতনা তুলে ধরা হয়েছে এই গানে। তাই আবহমান কাল ধরে ঈদের আগমনী আমেজ তুলে ধরে নজরুলের এই গানটি। তিনি ধর্মকে জীবনের অতি আবশ্যিক অংশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে গেছেন। অন্য ধর্মের প্রতি অকুণ্ঠ ভালোবাসার কারণে ইসলাম ধর্মের প্রতি তাঁর একনিষ্ঠতা কোনো অংশে কমে যায়নি।
তিনি উদাত্ত কণ্ঠে আকুল আবেদন জানিয়ে বলেছিলেন—‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই /যেনো গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই’।
যখন লিখতে বসলেন ক্ষুধা দারিদ্র্যের করাল গ্রাসে জর্জরিত জীবনের ব্যথা বেদনার উপাখ্যান, তখন তিনি জীবনমুখী একজন কথাসাহিত্যিক। ক‘জন পেরেছে এতটা জীবনমুখী হতে? জীবনের সুখ দুঃখ হাসি কান্নার এত সুনিপুণ ব্যাখ্যা, তিনিই করতে পারেন। কারণ তাঁর জীবনে অপরিহার্য অংশ ছিলো এই ক্ষুধা!
তিনি প্রতি পদে পদে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছিলেন। আবার অকুতোভয় হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জীবনের জয়গান গেয়ে গেলেন সর্বত্র। তিনি এমনই বৈচিত্র্যময় সত্তাকে লালন করে গেলেন স্বযত্নে। তাঁর জীবনের নানা দিক নানান অনুষঙ্গে পরিপূর্ণ। তবে সবচে আলোচিত দিক হলো একজন খাঁটি মুসলিম হয়ে তাঁর শ্যামসংগীত রচনার বিষয়টি। বাঙালি হিন্দু ধর্মাবলম্বী কেউ যেখানে সাহস করে না, সেখানে তিনি এত তত্ত্ব, এত সুনিপুণ বিশ্লেষণ কীভাবে করতে পারেন? তিনি একাধারে হামদ, নাত, গজল এ সব সৃষ্টিতে নিঃসন্দেহে সফল হয়ে রইলেন। সুরের এত বৈচিত্র্য তাঁর হাত ধরেই তো এলো সুরাঙ্গনে। এত এত বৈচিত্র্যময় প্রেমের গান, বিরহের গান, ভজন, গজল আর কে পেরেছে সৃষ্টি করতে!
একজন আপাদমস্তক ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ নজরুল ইসলাম। প্রত্যেক ধর্মের প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা তাঁকে একজন দেবদূত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে সাহায্য করেছে। বাংলা কবিতায় সামপ্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ কাজী নজরুল ইসলাম। মানবতার জন্য তাঁর জোরালোতম উচ্চারণ–
‘গাহি সাম্যের গান–
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান’।
‘গাহি সাম্যের গান–
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা–ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু–বৌদ্ধ–মুসলিম–ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান’!
কাজী নজরুল ইসলাম তৎকালীন অন্ধকার, গোঁড়া সমাজব্যবস্থায় জন্ম নেয়া এক আগাগোড়া অসামপ্রদায়িক মানুষ।
তিনি যেমন নিজ ধর্মে অনুরাগী, বিশ্বাসী–তেমনটা অন্য ধর্মের প্রতিও তাঁর অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা তাঁকে গড়ে তুলেছেন এক মহামানবরূপে।
তাঁর এই উদার অসামপ্রদায়িক চেতনাবোধ বর্তমান সমাজব্যবস্থার জন্য এক অনিবার্য শিক্ষা। প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীগণ তাঁর এই চেতনাবোধকে শিক্ষা হিসেবে নিতে পারলে সমাজে সামপ্রদায়িক হানাহানি, অরাজকতা বিরাজ করতে পারতো না। সমাজকে নির্মল, সুন্দর করে গড়ে তোলার জন্য তাঁর এই চেতনাবোধকে ছড়িয়ে দেবার কোনো বিকল্প নেই। রবীন্দ্রবলয়ের বাইরে এসে নিজ স্বকীয়তায় নিজেকে তুলে ধরার যে সাহস দেখিয়েছেন কয়েকজন কবি সাহিত্যিক, নিঃসন্দেহে নজরুল ইসলাম তাঁর মধ্যে অন্যতম।
জীবনের প্রতি পদে পদে তিনি আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়েছেন, আর সেসবের নির্যাস তুলে ধরেছেন তাঁর বিভিন্ন লেখায়, আর সৃষ্টি করেছেন দুঃখের মর্মভেদী এক–একটা অনবদ্য সাহিত্য। বারবার তাঁর সাহিত্য সৃষ্টি বাধাগ্রস্ত হয়েছে বিভিন্নরকম ভাবে। কখনও চরম আর্থিক অনটন, কখনো প্রিয়বিয়োগের ব্যথায়, কখনো শারীরিক অসুস্থতায়। দীর্ঘ একটা সময় ধরে শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা তাঁকে তাঁর সাহিত্যসৃষ্টি থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করেছে রীতিমতো। তাতে বাংলা সাহিত্যে বিশাল একটা শূন্যস্থান তৈরী হলো। স্বয়ং কবিগুরু উচ্ছ্বসিত ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এমন এক উদীয়মান কবির আবির্ভাবে। তাঁর সাহিত্যকর্মের প্রতি পরতে পরতে যে বৈচিত্র্যময়তা, তাতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় পাঠকহৃদয় সিক্ত।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সংস্কৃতিকর্মী।