পাহাড় সংরক্ষণ ও পরিচর্যার অভাবে চট্টগ্রামের অপরূপ সৌন্দর্য্য হারিয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের প্রতীক পাহাড়ি এলাকাসমূহ। প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টের অন্যতম কারণ হচ্ছে নির্বিচারে পাহাড় কাটা। সম্প্রতি তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ একটি অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, নগরায়নের নামে নির্বিচারে গাছ ও পাহাড় কাটা যাবে না। পাহাড় কেটে শহর বৃদ্ধি করতে হবে-এ রকম চিন্তা পরিহার করতে হবে। চট্টগ্রামের উন্নয়নে রাস্তা করতে গিয়ে পাহাড় কেটে সমান করে ফেলা হয়েছে। রাতের অন্ধকারেও পাহাড় কাটা হয়। নগর উন্নয়নের সাথে যুক্ত বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানও এ বিষয়টি অনেক সময় খেয়াল রাখেনি। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে চেষ্টা করা হয়, কিন্তু অনেকসময় রক্ষা করা যায় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে শর্ষের মধ্যে ভূত আছে। উন্নয়নের ক্ষেত্রে বৃক্ষকর্তন ও পাহাড় না কাটার ওপর যদি গুরুত্ব দেয়া না হয় নগরের সৌন্দর্য্য গত পঞ্চাশ-ষাট বছরে যেটুকু কমেছে আগামী পঞ্চাশ বছর পর চট্টগ্রাম শহর আর এরকম থাকবে না।
ড. হাছান মাহমুদ এমপি বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য নগর উন্নয়নের ক্ষেত্রে গাছ কাটা ও পাহাড় কাটার বিষয়টা খেয়াল রাখা হয় না। চট্টগ্রাম অপরূপ সৌন্দর্য্যের নগর, কিন্তু চট্টগ্রামে উন্নয়নের নামে নির্বিচারে গাছ কেটে, পাহাড় কেটে সৌন্দর্যহানি ঘটানো হয়েছে। চট্টগ্রামকে শ্রীহীন করা হয়েছে। যেদিকে চট্টগ্রাম শহর বৃদ্ধি পাচ্ছে সেখানে নির্বিচারে পাহাড় কাটা হচ্ছে, এটি বন্ধ করতে হবে।
আসলে জরিমানা করেও থামানো যাচ্ছে না পাহাড় কাটা। নির্বিচারে পাহাড় কাটার ফলে চট্টগ্রামের প্রকৃতি ও পরিবেশ ঝুঁকির মুখে পড়ছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, পাহাড়ি এলাকা খাস জমি হলেও, বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো পাহাড় দখল করে ভারি শিল্প কারখানা গড়ে তোলে। পাহাড় দখলকারীদেরকে সাধারণত জরিমানার চাইতে বেশি শাস্তি পেতে দেখা যায় না। পরিবেশ আইনে জরিমানা ছাড়াও দুটি পৃথক শাস্তির বিধান আছে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অনুমতি সাপেক্ষে ভ্রাম্যমাণ আদালত নিয়ে অভিযান পরিচালনা এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পরিবেশ আদালতে মামলা করা। পাহাড় কাটার অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ সময় দেখা যায় অভিযোগ প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করতে পারে না পরিবেশ অধিদপ্তর। তখন অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিকভাবেই অভিযোগ অস্বীকার করে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রভাব-প্রতিপত্তির একটা দাপট তো আছেই।
অভিযোগে প্রকাশ, বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের উচ্চ পর্যায়ে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে। এতে করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া অনেকক্ষেত্রে কঠিন হয়ে পড়ে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের ভূভাগের মাত্র ১২ শতাংশ জুড়ে আছে পাহাড়। পরিবেশের জন্য পাহাড় অনেক গুরুত্বপূর্ণ। জীববৈচিত্র্যের শতকরা ৮০ ভাগ বেঁচে থাকে পাহাড়ের উপর নির্ভর করে। নির্বিচারে পাহাড় কেটে চললে পরিবেশগত ভারসাম্য আর কোনভাবেই বজায় থাকবে না। দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় ভারী শিল্প-কারখানা স্থাপনের ফলে পাহাড়ের অনেক স্থানে পানির প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। এতে করে সেখানকার আদিবাসীরা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পতিত হচ্ছে।
অভিযোগে আরো প্রকাশ, চট্টগ্রামে একের পর এক পাহাড় কেটে ও বন উজাড় করে গড়ে তোলা হচ্ছে ইটভাটা ও বসতি। পাহাড়ের ঢালু অংশে বেড়া দিয়ে ঘর তুলে নিম্ন আয়ের মানুষদের ভাড়া দেয়া হচ্ছে। ফলে বৃষ্টি নামলেই পাহাড় ধসে মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। পাহাড়খেকো রাঘববোয়ালরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় থাকছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাহাড় কাটা বেড়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধসের মাত্রাও ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। তাঁরা আরও বলেন, আমাদের দেশের পাহাড়গুলো অধিকাংশই বেলেমাটির। পাহাড় কাটার ফলে সেখানে বৃষ্টির পানি প্রবাহে বাধা পড়ে। তার ফলে চট্টগ্রাম শহরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশ আমাদের জরুরি। আমাদের সবার মঙ্গলের কথা চিন্তা করে সকলের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। নগর উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক পরিবেশের কথা মাথায় রাখতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।