ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ চট্টগ্রামে বহুতল ভবন নির্মাণে পর্যাপ্ত সতর্কতা নেই। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে পরিবেশের ছাড়পত্রও নেই। এতে করে দিনে দিনে চট্টগ্রামে ঝুঁকি বাড়ছে। শহরটি বেলেমাটির হওয়ায় এই ঝুঁকি অনেকটা বেড়ে গেছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। বার্মা সাব–প্লেটের সংযোগস্থলে চট্টগ্রামের অবস্থান হওয়ায় ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে চট্টগ্রাম। এ অবস্থায় পরিবেশ এবং বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করে ভবন নির্মাণ শহরটিকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) হিসাবে, নগরীতে ভবনের সংখ্যা ৪ লাখ ১ হাজার ৭২১টি। এর মধ্যে এক থেকে ৬ তলা উচ্চতার ভবন রয়েছে ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৭৫৭টি। ৭ তলা থেকে ১০ তলা উচ্চতার ভবন রয়েছে ১৩ হাজার ৪৮০টি। ১১ তলা থেকে ১৫ তলা উচ্চতার ভবন রয়েছে ৪১৫টি। ১৬ থেকে ২০ তলা উচ্চতার ভবন রয়েছে ৫০টি এবং ২০ তলার বেশি উচ্চতার ভবনের সংখ্যা ৯টি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, চট্টগ্রামের ৪ লাখ ভবনের মধ্যে অন্তত এক লাখের বেশি ভবনের উচ্চতা ৪ তলা থেকে ২০ তলার বেশি। এসব ভবনের বেশিরভাগ বিল্ডিং নির্মাণ কোড অনুসরণ করেনি। সিডিএ থেকে অনুমোদিত নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়েছে প্রায় সবগুলো ভবন। ৭ তলা থেকে ২০ তলার বেশি উচ্চতার ভবনগুলো নির্মাণেও নানা অনিয়ম ঘটেছে। অপেক্ষাকৃত পুরাতন ভবনগুলোও বড় ধরনের হুমকির মধ্যে রয়েছে। বেশি উচ্চতার ভবন নির্মাণে শুধু সিডিএর নয়, পরিবেশ অধিদপ্তর, সিভিল এভিয়েশন এবং ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র নিতে হয়। বিশেষ করে ৫ হাজার বর্গমিটারের বেশি আয়তনের অবকাঠামো নির্মাণে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক। কিন্তু চট্টগ্রামে অনেক ভবনই রয়েছে যেগুলোর পরিবেশ এবং ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র নেই।
সিডিএর উপ–প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আবু ঈসা আনসারী জানান, চট্টগ্রামে ৪ লাখের বেশি ভবন রয়েছে। সিডিএ প্রতি বছর প্রায় আড়াই হাজার ভবনের অনুমোদন দেয়। এসব ভবনের অনুমোদন দেওয়ার সময় ভূমির শ্রেণী এবং ড্যাপ যাচাই বাছাই করা হয়।
কিন্তু সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, সিডিএ থেকে অনুমোদন নেওয়ার পর নির্মাণের সময় বিল্ডিং কোড অনুসরণ করা হচ্ছে কিনা সেটা তদারকি করা হয় না। এতে করে শহরের হাজার হাজার ভবন নিয়ম না মেনে নির্মাণ সম্পন্ন করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে অনুমোদিত ফ্লোরের চেয়ে বেশি নির্মাণ করে ফ্ল্যাট বিক্রি করা হয়। এতে করে ওই ভবনের লোড ক্যাপাসিটিও ঠিকভাবে হিসেব করা হয় না। এতে করে ভবনগুলো নির্মাণের পর থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের এডি মোক্তাদির হাসান বলেন, সব ভবনের নির্মাণে পরিবেশ ছাড়পত্র লাগে না। শুধু ৫ হাজার বর্গমিটারের বেশি আয়তনের ভবন নির্মাণে পরিবেশ ছাড়পত্র নিতে হয়। আমরা এ ব্যাপারে সজাগ থাকি।
চট্টগ্রামে পাহাড় কেটে নির্মাণ করা হয়েছে অনেক ভবন। জলাশয় ভরাটের ঘটনা অসংখ্য। এসব ভবন নির্মাণের মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতি করা ছাড়াও ভবনগুলোও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে রয়েছে। বহুতল ভবন তৈরিতে পরিবেশগত সুরক্ষার জন্য এত সব বিধিমালা থাকলেও তা অনুসরণ করা হচ্ছে না উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, ভবন নির্মাণ একজন মানুষের সারাজীবনের বিনিয়োগ। এটা নিয়ে ছেলেখেলা উচিত নয়। একটি ভবন শুধু একটি ভবন নয়, এটি মানুষের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন যাতে জীবনহানির কারণ হয়ে না ওঠে, সেদিকে সকলের সতর্ক থাকা উচিত।
সিডিএর উপ–প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আবু ঈসা আনসারী বলেন, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী ১০ তলার অধিক উচ্চতার ভবনগুলো বহুতল ভবন হিসেবে বিবেচিত। নিয়ম অনুযায়ী, একটি ভবনের অনুমোদনের জন্য ১২টি সংস্থার অনুমোদন যাচাইয়ের বিষয় রয়েছে। তবে ভবন অনুমোদনের ক্ষেত্রে আমরা শুধু সিভিল এভিয়েশনের অনাপত্তির বিষয়টি বিবেচনা করি। আমাদের কাছ থেকে অনুমোদনের পর পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে ছাড়পত্র নেওয়ার বিধান রয়েছে। কেউ যদি ছাড়পত্র না নেয় তাকে জরিমানা করা যেতে পারে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, চলতি বছরের শুরুতে নগরীতে অভিযান চালিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না থাকায় ১৪টি ভবনকে ৩৬ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি আশিক ইমরান বলেন, ভূমিকম্পের জন্য আমরা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছি। শহরে অনেক পুরাতন ভবন রয়েছে। এসব ভবন নির্মাণে কোনো কোড অনুসরণ করা হয়নি। ভূমিকম্পের কথা খুব বেশি বিবেচনা করা হয়নি। তাই এসব ভবন শহরকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। নতুন অনেক ভবনের ক্ষেত্রে অনিয়ম দৃশ্যমান। তাই ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড অনুসরণ জরুরি এবং মনিটরিং সিস্টেম উন্নত করতে হবে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. জাহাঙ্গীর আলম আজাদীকে বলেন, আমি বহুদিন ধরে বলে আসছি চট্টগ্রাম অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত শহরে ভবনের সংখ্যা আমরা হিসেব করেছিলাম ২ লাখ ৬২ হাজার। এখন সেটি ৪ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। আগের ভবনগুলো নির্মাণের সময় বিল্ডিং কোড মানা হয়নি। হলেও ১৯৯৩ সালের বিল্ডিং কোড মানা হয়েছিল। অথচ ওই কোড এখন পুরোপুরি অচল। ওই কোডের ভূমিকম্প ফ্যাক্টর পয়েন্ট ওয়ান ফাইভকে ২০২০ সালের বিল্ডিং কোডে পয়েন্ট ২৮ অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। এই কোড অনুসরণ না করলে বিপদ কেউ ঠেকাতে পারবে না।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর দেশের হৃদপিণ্ড। যে–কোনো মাত্রার ভূমিকম্পে যেন বন্দর সচল থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের হাসপাতাল, পাওয়ার সাপ্লাই চেইন যেন ইনটেক থাকে তা–ও নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু পুরনো অবকাঠামো দিয়ে তা সম্ভব নয়। তাই আমাদেরকে সব পুরনো ভবনের শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। একটি মনিটরিং সেল করে এই শক্তি বৃদ্ধির কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সরকারি স্থাপনা সরকারি খরচে শক্তি বৃদ্ধি করবে, ব্যক্তি মালিকানাধীন স্থাপনাগুলো ব্যক্তির নিজস্ব উদ্যোগে শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। এক্ষেত্রে বড় অংকের টাকা খরচের বিষয় রয়েছে। ৫/১০ লাখ টাকা খরচের কথা শুনলে কেউ আর করতে চাইবে না। এক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সুদমুক্ত ঋণের মাধ্যমে ভবনের শক্তি বৃদ্ধিতে অর্থায়ন করতে হবে। ভূমিকম্পের ব্যাপারে একটি ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে না নিলে যে–কোনো ধরনের পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। বিষয়গুলো প্রধান উপদেষ্টার দফতরে বলে এসেছেন বলে জানান তিনি।












