চট্টগ্রাম মহানগরীতে গণপরিবহনে ভাড়া নৈরাজ্য চরমে উঠেছে। সিএনজিচালিত টেক্সির ভাড়াও অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। সরকারনির্ধারিত ভাড়া মানছেন না বাসের চালক–হেলপাররা। টেক্সিচালকেরাও নিজেদের মর্জিমাফিক ভাড়া নিচ্ছে। যাত্রীদের এক প্রকার জিম্মি করে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। নগরীতে শুধু ভাড়া নৈরাজ্যের শিকার হওয়া সাধারণ মানুষকে কোটি টাকার বেশি গচ্ছা দিতে হচ্ছে। ভাড়া নৈরাজ্য ঠেকানোর কোনো উদ্যোগই নেয়া হচ্ছে না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে যাত্রীদের পক্ষ থেকে।
সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম মহানগরীতে বাস, মিনিবাস, টেম্পো এবং হিউম্যান হলার মিলে গণপরিবহনের ৪৩টি রুট রয়েছে। এসব রুটে সাত শতাধিক বাস এবং ৪ হাজারের মতো টেম্পো ও হিউম্যান হলার চলাচল করে। এসব রুটে প্রতিদিন কয়েক লাখ লোক যাতায়ত করেন। যাদের প্রত্যেককেই ভাড়া নৈরাজ্যের শিকার হতে হচ্ছে। প্রতিদিনই কয়েক লাখ লোক থেকে কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। যাত্রীদের অঘোষিতভাবে জিম্মি করে এই টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
প্রসঙ্গক্রমে তারা বলেন, বহদ্দারহাট থেকে আগ্রাবাদ পর্যন্ত মিনিবাসে একসময় ভাড়া ছিল ৯ টাকা। এই ভাড়া এক লাফে তা ৬ টাকা বাড়ানো হয়েছিল। এরপর আরও দুই দফায় ভাড়া বাড়িয়ে বর্তমানে নেওয়া হচ্ছে ২০ টাকা বা সুযোগ বুঝে আরো বেশি নেয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির চট্টগ্রাম মহানগর শাখা জানিয়েছে, নগরীর অধিকাংশ রুটেই বাস, মিনিবাস, হিউম্যান হলার ও টেম্পো পারমিটের শর্ত লঙ্ঘন করে চলাচল করছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা পুরো পথের পরিবর্তে অর্ধেক পথ পর্যন্ত গিয়ে যাত্রী নামিয়ে দিচ্ছে, অথচ ভাড়া আদায় করছে পুরো পথের সমান। যেমন ১০ নম্বর রুটের বাস পতেঙ্গা থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত যাওয়ার কথা থাকলেও বিকালে কারখানা ছুটির সময়ে ইপিজেড থেকে আগ্রাবাদ পর্যন্ত যাত্রী নিয়ে ৪০ টাকা আদায় করে। এরপর আগ্রাবাদ থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্ত আবার ৪০ টাকা নেয় এবং বহদ্দারহাট থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত ২০ টাকা করে আদায় করে। ফলে এক রুটের ভাড়া ৫৫ টাকা হলেও যাত্রীদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে প্রায় ১০০ টাকা। এই ধরনের নৈরাজ্যের কারণে যাত্রীরা যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
নগরীর শাহ আমানত ব্রিজ থেকে মইজ্জ্যারটেক পর্যন্ত রুটেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরকার নির্ধারিত ভাড়া ১০ টাকা হলেও মাহিন্দ্রা, টেম্পো ও বাসে আদায় করা হচ্ছে ২০ টাকা।
হালিশহরের বাসিন্দা সাবেক সেনাসদস্য মোহাম্মদ শহীদ উল্ল্যাহ দৈনিক আজাদীকে ভাড়া নৈরাজ্যের ভয়াবহ বর্ণনা দিয়ে বলেন, শহরে চলাচলকারী কোন গণপরিবহনই সরকার নির্ধারিত ভাড়া নিচ্ছে না। তারা প্রত্যেকেই বাড়তি ভাড়া আদায় করছে। কোন যাত্রী বাড়তি ভাড়া দিতে না চাইলে জবরদস্তী করে আদায় করেন।
তিনি বলেন, ২০২০ সালে ডিজেল–চালিত বাসের ভাড়া বাড়ানো হলেও গ্যাসে চালিত বাসের ভাড়া বাড়ানোর কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। অথচ হালিশহরের ২, ৩ ও ৪ নম্বর রোডে চলাচলকারী গ্যাসচালিত বাসগুলোও ডিজেলচালিত গাড়ির মতো উঠানামা ভাড়া ১০ টাকা আদায় করছে। আগে এ রোডে ১০–১৫টি গ্যাসচালিত গাড়ি চললেও বর্তমানে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫–৩০টির মতো। প্রতিদিনই যাত্রীদের কাছ থেকে ৪০–৫০ হাজার টাকা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। যাত্রীদের প্রতিবাদ করলে তাদের অপমানিত ও হুমকি দেওয়া হয়। এছাড়া অনেক গাড়ি নির্ধারিত রুটে না গিয়ে মাঝপথ থেকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়।’ তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ১১ নম্বর গাড়ির রুট পারমিট সিটি গেট থেকে সি–বিচ পর্যন্ত। অথচ সি–বিচ থেকে তারা কখনো সিটি গেট যায় না, কবিলাধাম এলাকায় যাত্রীদের নামিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে ফেলে। অপরদিকে কারখানা ছুটির সময় সি–বিচ না গিয়ে ইপিজেড থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে দেয়।
তিনি আরও বলেন, লেগুনা ও মেঙ্মি গাড়িগুলোতেও একইভাবে ভাড়া দ্বিগুণ করা হয়েছে। কিন্তু কোথাও কোনো ভাড়ার তালিকা নেই। ফলে সাধারণ যাত্রীরা চরমভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আমরা চাই ভাড়া পূর্বের মতো উঠানামা ৫ টাকা করা হোক এবং প্রতিটি গাড়িতে ভাড়ার তালিকা বাধ্যতামূলক করা হোক।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির একজন নেতা বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচলকারী অধিকাংশ যানবাহনই মিনিবাস। মিনিবাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ৮ টাকা হলেও সেখানে আদায় করা হচ্ছে ১০ টাকা। আগে প্রতি কিলোমিটারে বড় বাসের ভাড়া ছিল ২ টাকা ১৫ পয়সা, যা বাড়িয়ে ২ টাকা ৫০ পয়সা করা হয়েছে। মিনিবাসের ভাড়া ২ টাকা ৫ পয়সা থেকে ৩৫ পয়সা বাড়িয়ে করা হয়েছে ২ টাকা ৪০ পয়সা। কিন্তু বাস্তবে এই ভাড়ার হারও মানা হচ্ছে না।
যাত্রীদের অভিযোগ, পরিবহন শ্রমিকরা নিজেদের ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছে আর তারা বাধ্য হয়ে তা মেনে নিচ্ছেন। ফলে চট্টগ্রামের গণপরিবহন ব্যবস্থায় ভাড়া নৈরাজ্য যাত্রীদের জন্য বড় এক ভোগান্তিতে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক চৌধুরী ভাড়া নৈরাজ্যের কথা উল্লেখ করে বলেন, নগরীতে ভাড়া আদায়ের কোন নিয়ম কানুন নেই। গণপরিবহনের চালক এবং হেলপারেরা নিজেদের মর্জিমাফিক ভাড়া আদায় করে প্রতিদিনই সাধারণ মানুষের পকেট কাটছে।
বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম বিআরটিএ’র একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকার নির্ধারিত ভাড়া রয়েছে। কিলোমিটার হিসেব করে আমরা একটি ভাড়ার হার নির্ধারণ করে দিয়েছি। এই ভাড়ার অতিরিক্ত নেয়ার কোন সুযোগ নেই। তবে নগরীতে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের ব্যাপারে আমরা হরদম অভিযোগ পাই। অভিযানও মাঝেমধ্যে করা হয়। কিন্তু ভাড়া নৈরাজ্য ঠেকানোর মতো লোকবল আমাদের নেই।
শুধু গণপরিবহনই নয়, সিএনজি চালিত টেঙির ভাড়া নৈরাজ্যও চরমে পৌঁছেছে। নিয়ম কানুনের কোন তোয়াক্কা না করে দুই তিন কিলোমিটার দূরত্বে যাওয়ার জন্য দেড়শ’ টাকা ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। কখনো কখনো এক দেড় কিলোমিটার জায়গার জন্য ভাড়া আদায় করা হচ্ছে একশ’ টাকা। বাড়তি ভাড়া ছাড়া সিএনজিচালিত একটি টেঙিও চলে না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ যাত্রীরা।
নগরীর গণপরিবহন এবং সিএনজিচালিত টেঙির ভাড়া নৈরাজ্য ঠেকানোর কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য যাত্রী কল্যাণ সমিতি থেকে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয় যে, পুলিশ চাইলে এই ভাড়া নৈরাজ্য ঠেকাতে পারে। সিএমপির ট্রাফিক বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতেই আমাদের দিন চলে যায়। ভাড়ার ব্যাপারে আসলে আমাদের তেমন কিছু করার থাকে না। তবে বিআরটিএ অভিযান চালালে আমরা সর্বাত্মক সহায়তা দিয়ে থাকি।












