নগরের দুই পশুর হাটে এবার ডিজিটাল লেনদেন করতে পারবেন ক্রেতা–বিক্রেতারা। অর্থাৎ ক্যাশ বা নগদ লেনদেনের পরিবর্তে ব্যাংকের কার্ড বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এ লেনদেন করা যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’ উদ্যোগের আওতায় এ সেবা চালু করে। পশুর হাট দুটি হচ্ছে সাগরিকা ও কর্ণফুলী পশুর বাজার (নূর নগর হাউজিং এস্টেট)। এ দুই হাটে ৫০ কোটি টাকার ডিজিটাল লেনদেনের টার্গেট করা হয়েছে। গতবার রাজধানীর ছয় পশুর হাটে পরীক্ষামূলকভাবে এ ডিজিটাল লেনদেন চালু হয়। চট্টগ্রামে এবার প্রথম শুরু হলো। এছাড়া ঢাকার ৮টি পশুর হাটেও এবার ডিজিটাল লেনদেন হবে। গতকাল দুপুরে নগরীর কাজির দেউড়ির সেনাকল্যাণ সংস্থা কনভেনশন হলে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ স্মার্ট হাট’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সাগরিকা ও কর্ণফুলী পশুর বাজারে একটি করে দুটি ডিজিটাল বুথ থাকবে। সেখানে এটিএম মেশিন থাকবে। পয়েন্ট অব সেলস (পিওএস) যন্ত্র ও মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের (এমএফএস) মাধ্যমে ক্রেতারা পশু বিক্রির টাকা পরিশোধ করতে পারবেন। এতে ক্রেতারা বাসা থেকে টাকা বহন করার ঝামেলা থেকে রেহাই পাবেন। একইভাবে জাল টাকার বিস্তারও রোধ হবে। এছাড়া নগদ অর্থ লেনদেনের ঝুঁকি হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি লেনদেনকারীদের ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট বা রেকর্ড সৃষ্টি হবে। সৃষ্ট রেকর্ড পশু বিক্রেতাগণকে ভবিষ্যতে সহজ শর্তে ঋণপ্রাপ্তিসহ বিভিন্ন সেবা ও সহায়তা গ্রহণের জন্য সহায়তা করবে।
সংবাদ সম্মেলনে রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, আগে নকল টাকার কারণে অনেক গরুর বেপারি সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন। অনেক ক্রেতা গরু কেনার টাকা হারিয়েছেন। এখন ডিজিটাল লেনদেনের কারণে আর এই ঝুঁকি থাকবে না। মানুষকে নগদ টাকা নিয়ে চিন্তায় পড়তে হবে না। কোরবানির বিকিকিনিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অপরাধচক্রের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে আর বেচাকেনাও নিরাপদ ও ঝামেলাহীন হয়ে উঠবে।
মেয়র বলেন, কোরবানির গরুর বাজারে দূর–দূরান্ত থেকে পশু কেনাবেচা করতে মানুষ আসেন। কোরবানির বাজারকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অপরাধচক্র জালনোট সরবরাহ, পশুর ট্রাকে ডাকাতি, ক্রেতাদের টাকা ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধ কার্যক্রম পরিচালনা করে। ডিজিটাল হাটে সব ধরনের আর্থিক সেবা ডিজিটালি হবে বিধায় এই অপরাধচক্রের কার্যক্রম কমে আসবে।
তিনি বলেন, এবারে দুটি হাটের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তীতে সবগুলো কোরবানির হাটে ক্যাশলেস লেনদেনের সুবিধা সৃষ্টি করবে চসিক। প্রধানমন্ত্রী যে ক্যাশলেস বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে চট্টগ্রামকে স্মার্ট নগরীতে পরিণত করার কাজ চলছে। এ ধরনের ডিজিটাল সেবার উদ্যোগ চট্টগ্রামের বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনার সুফল ঘরে তুলতে সহায়তা করবে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির হারও বৃদ্ধি করবে।
মেয়র বলেন, প্রধানমন্ত্রী যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ কনসেপ্ট নিয়ে আসে তখন অনেকে সমালোচনা করে। উদ্ভট চিন্তা বলে অনেকে। অথচ তারাই আজ সুফল ভোগ করছে। তিনি বলেন, অনেকে হয়তো চিন্তা করতে পারে গরুর বাজারে কিসের ডিজিটাল লেনদেন। কিন্তু আমরা সত্য বলে পরিণত করছি। সাগরিকায় স্থায়ী এটিএম বুথ বসানোর ব্যাপারেও সহযোগিতার আশ্বাস দেন মেয়র।
মাস্টারকার্ড বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার সৈয়দ মোহাম্মদ কামালের সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এ বি এম জহুরুল হুদা, বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম ডিপার্টমেন্টের পরিচালক মোতাসেম বিল্লাহ, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগের উপ–পরিচালক ড. আশরাফুল আলম খান, বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম ডিপার্টমেন্টের অতিরিক্ত পরিচালক শাহ জিয়াউল হক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. আমান উল্লাহ ও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের ইভিপি আবদুল নাসের।
উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক জুলিয়া চৌধুরী, যুগ্ম পরিচালক রেজাউল করিম, সরকার মো. আমির খসরু, সালাহউদ্দিন মাহমুদ, উপপরিচালক হাসনাত আহসান ও চসিকের এস্টেট অফিসার রেজাউল করিম।
এ বি এম জহুরুল হুদা বলেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকে স্মার্ট রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য আমাদের পেমেন্ট সিস্টেমকে স্মার্ট করতে হবে। দেশের আর্থিক কার্যক্রমকে ডিজিটাল করার মাধ্যমে আমরা ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’ গড়তে লড়ছি। বাংলাদেশ ব্যাংক দেশব্যাপী বিস্তৃত স্থায়ী ও সাপ্তাহিক পশুর হাটের লেনদেন ক্যাশলেস করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, পশুর হাট যতদিন চলবে ততদিন বুথ থাকবে। সাদা পোশাকে পুলিশ থাকবে। ব্যাংকাররা সহযোগিতার জন্য পুলিশের সাহায্য নিতে পারবেন। যে কোনো সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান দিতে হাটগুলোতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভিজিল্যান্স টিম থাকবে। সবাইকে জাল টাকা পরীক্ষা করে দেওয়া হবে।
শাহ জিয়া উল হক বলেন, গরু কেনাবেচায় নগদ টাকার লেনদেন না থাকায় নিরাপত্তার ঝুঁকিও থাকবে না, জাল টাকা রোধ করা যাবে এবং এই খাতে কী পরিমাণ টাকার লেনদেন হয়, তার একটি ডাটাবেইজ তৈরি করা যাবে। ডিজিটাল লেনদেনের কারণে একজন খামারি আগে যেখানে একবার গরু এনে বিক্রি করতে পারতেন, এখন নগদ টাকার লেনদেন না হওয়ায় কয়েকবার গরু হাটে এনে বিক্রি করতে পারবেন।
মো. মোতাসেম বিল্লাহ বলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামের ১০টি হাট মিলিয়ে ১৫০ কোটি টাকা ডিজিটাল লেনদেনের টার্গেট রয়েছে। চট্টগ্রামে ৫০ কোটি টাকা ডিজিটাল লেনদেন কঠিন হবে না। যে গরুর খামারি হাটে আসবে তাদের তালিকা করে হিসাব খুলে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। যদি কারও হিসাব না থাকে তাহলে বুথ থাকবে। নির্দিষ্ট হাটে কার্ড দিয়ে পশু কিনতে পারবে। জাল টাকার ঝুঁকি থাকবে না। খামারিরা প্রতারিত হবেন না। আশা করি, পরের বছর চট্টগ্রাম শহরের সব পশুর হাট স্মার্ট হাটে রূপান্তর হবে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, কোরবানির বাজারকে কেন্দ্র করে ৭০ হাজার কোটি টাকার নগদ অর্থ লেনদেন হয়। নগদ লেনদেনের ঝুঁকি নিরসনে এবং সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গত বছর ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন প্রথমবারের মতো ৬টি বুথ বসায় ডিজিটাল লেনদেনের জন্য। সেবার মাত্র ৪ দিনে ৩৩ কোটি টাকা ডিজিটালি লেনদেন হয়। এ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এ সেবা আরো প্রসারিত করতে উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ কার্যক্রমে চট্টগ্রামে লিড ব্যাংক হিসেবে আছে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। গত বছর ৪টি জেলায় প্রাথমিকভাবে প্রচারণা চালানো হয়। এবার ২৬টি জেলায় প্রচারণা চালানো হয়। পশু বিক্রেতাগণকে ব্যক্তিগত রিটেইল হিসাব খোলার বিষয়ে সচেতন করা হয়। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স এসোসিয়েশনের সার্বিক সহায়তায় তৃণমূল পর্যায়ে পশু বিক্রেতাগণকে আর্থিক পরিসেবার আওতায় আনতে এবং সাধারণ ক্রেতাগণের সর্বপর্যায়ে ডিজিটাল লেনদেনের সুযোগ সৃষ্টিতে বাংলাদেশ ব্যাংক কোরবানি পশুর হাটে ডিজিটাল পদ্ধতিতে লেনদেন বিশেষত বাংলা কিউআর কোডের মাধ্যমে লেনদেন প্রসারের এই কার্যক্রম গ্রহণ করে।












