নগরে জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান মেগা প্রকল্পের বাইরে থাকা ২১ খাল পুনরুদ্ধারে প্রাক–সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয়েছে। নেদারল্যান্ডসের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ সম্ভাব্যতা যাচাই করছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। নেদারল্যান্ডসের প্রতিষ্ঠানটি মূলত শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ৪১ ওয়ার্ডে ড্রেনেজ ম্যানেজমেন্ট ও সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট নিয়ে সমীক্ষা চালাবে; যেখানে অন্তর্ভুক্ত থাকবে ২১ খালও। চসিকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এ সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে অর্থায়ন করছে বাংলাদেশস্থ নেদারল্যান্ডস দূতাবাস। প্রাক–সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে চার মাস।
এ বিষয়ে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন আজাদীকে বলেন, তাদেরকে (নেদারল্যান্ডসের প্রতিষ্ঠান) আমরা ইনভাইট করেছি। তারা যেন আমাদের খালগুলো নিয়ে ফিজিবিলিটি স্টাডি করে। আসলে ২১টি খাল পুনরুদ্ধার করা খুব জরুরি। সামনে মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু সেখানে আছে ৩৬ খাল, বাকি খালগুলো উদ্ধার না হলে জলাবদ্ধতার সমস্যা থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাওয়া সম্ভব না।
চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, শুধু খাল না, টোটাল ড্রেনেজ ম্যানেজমেন্ট ও সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট নিয়ে প্রাক–সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কথা বলেছে নেদারল্যান্ডসের প্রতিষ্ঠানটি। চার মাসে কাজ শেষ করতে পারবে বলেছে তারা। ইতোমধ্যে কাজ শুরুও করেছে।
সহযোগিতা চেয়ে নেদারল্যান্ডস দূতাবাসে চসিকের চিঠি : চসিক সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ জুন বাংলাদেশস্থ নেদারল্যান্ডস দূতাবাসে নিযুক্ত জলাবদ্ধতা বিষয়ক প্রতিনিধি নেলছে কিলেনের কাছে চিঠি দেয় চসিক। এতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন এলাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য প্রাক–সম্ভাব্যতা সমীক্ষা যাচাইয়ে সহযোগিতা চাওয়া হয়। এতে সাড়া দিয়ে প্রাক–সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয়েছে।
চসিকের দেয়া চিঠিতে বলা হয়, চট্টগ্রাম বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও প্রধান সমুদ্র বন্দর শহর। এখানে প্রায় ৭০ লাখ লোক বাস করে। শহরের দৈনিক প্রায় ৩ হাজার ২০০ টন বর্জ্য উৎপাদন হয়। কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও জলাবদ্ধতা দুটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা সারা বছর নগরবাসীর জন্য চরম ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমস্যাগুলোর ক্রমাগত অবনতি বিবেচনায় সমস্যার টেকসই সমাধানে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন একটি বৃহৎ প্রকল্প হাতে নিতে চায়। এজন্য প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তায় নেদারল্যান্ডস সরকারের সহযোগিতা কামনা করা হয় পত্রে। চসিক একটি প্রাক–সম্ভাব্যতা গবেষণা পরিচালনায় সহায়তা করতে নেদারল্যান্ডস দূতাবাসকে অনুরোধ করে। এই গবেষণার মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান খুঁজে বের করা সম্ভব হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করে চসিক।
২১ খালের আলোচনা চলছে ৮ বছর ধরে : চট্টগ্রাম ওয়াসার ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান–২০১৬ অনুসারে নগরে খাল আছে ৫৭টি। খালগুলোর দৈর্ঘ্য ১৬৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে গৃহীত সিডিএর মেগা প্রকল্পের আওতায় উন্নয়ন করা হচ্ছে ৩৬ খালের। যার দৈর্ঘ্য ৯৭ কিলোমিটার। অর্থাৎ ৬৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ২১টি খাল প্রকল্পের বাইরে রয়ে গেছে। তাই মেগা প্রকল্পের সুফল নিয়ে সংশয় দেখা দেয় এবং ২১ খাল নিয়ে প্রকল্প প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। অর্থাৎ ৮ বছর আগে ২১ খাল নিয়ে প্রকল্প প্রণয়নে আলোচনা শুরু হয়।
পরে ২০২২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সরকার বিভাগের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রাম এবং ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের গৃহীত কার্যক্রমের পর্যালোচনা সভায় ২১ খাল নিয়ে চসিকের প্রকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়।
চসিকের প্রকৌশল বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২১টি খালের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে কনসালটেন্ট ফার্ম নিয়োগে ২০২২ সালের ২৩ আগস্ট দরপত্র আহ্বান করে চসিক। এতে ১০টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। এর এক বছর পর ওয়াশো ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডকে নিয়োগ দেয়া হয়। ৩৪ লাখ টাকায় নিয়োগ পাওয়া প্রতিষ্ঠানটি ২০২৪ সালের শুরুতে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায়। পরবর্তীতে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা সিইজিআইএসও কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায়।
কথা ছিল, নির্বাচিত কনসালটেন্ট ফার্ম নতুন করে জরিপ করে খাল শনাক্ত করবে। আরএস–বিএস শিটের আলোকে খালের সীমানা নির্ধারণ করবে। খালের উপর থাকা অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করার পাশাপাশি এর পরিমাণও নির্ণয় করবে। খালের পাড়ে রাস্তা নির্মাণে কী পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করতে হবে এবং এর মূল্য নির্ধারণ করবে। খালের পাড়ে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণে প্রাথমিক নকশা এবং এর ব্যয় প্রাক্কলন প্রস্তুত করবে। পানির প্রবাহ, ঝড় এবং অন্যান্য আবহাওয়া সংক্রান্ত ডেটা বিশ্লেষণ করে প্রকল্পের প্রাক–সম্ভাব্যতাও যাচাই করবে প্রতিষ্ঠানটি।
এক বছর পর খালগুলো পুনরুদ্ধারে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে নতুন করে উদ্যোগ নেয় চসিক। তখন প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই (ফিজিবিলিটি স্টাডি) এবং প্রকল্পের উন্নয়ন প্রস্তাবনা (ডিপিপি) প্রস্তুত করতে পাওয়ার চায়নার সহযোগিতা চাওয়া হয়। এ বিষয়ে চীনের প্রতিষ্ঠানটির কান্ট্রি ম্যানেজার রেন হাওয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।
এক নজরে ২১ খাল : ওয়াসার ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান–২০১৬ অনুযায়ী, মেগা প্রকল্পের বাইরে থাকা ২১ খাল হচ্ছে চট্টেশ্বরী খাল, ১৫ নং ঘাট এয়ারপোর্ট খাল, রামপুর খাল, বালুখালী খাল, কৃষ্ণখালী খাল, কুয়াইশ খাল, ফরেস্ট খাল, উত্তর সলিমপুরের বারিঙ্গাছাড়া খাল এবং ভাটিয়ারীর ধামাইর খাল। এছাড়া নেভাল একাডেমি, চরপাড়া, হোসাইন আহমেদ পাড়া, সিইপিজেড আনন্দবাজার, সিইপিজেড নতুন পাড়া, উত্তর হালিশহর, উত্তর কাট্টলী, লতিফপুর এবং সলিমপুরের সু্লইচগেটের ১১টি সংযুক্ত খালও রয়েছে।