নালায় পড়ে আবারো শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় নগরীতে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। আজাদীতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, নালায় পড়ে নগরের হালিশহর আনন্দিপুর এলাকায় হুমায়রা আক্তার নামে তিন বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। নালাটি ছিল একটি বাসার ‘সার্ভিস ড্রেন’। গত বুধবার বিকেল ৩টার দিকে বল কুড়াতে গিয়ে ড্রেনটিতে পড়ে যায় ওই শিশু। পানির স্রোত থাকায় মুহূর্তেই তলিয়ে যায় সে। এর প্রায় এক ঘণ্টা পর পড়ে যাওয়ার স্থান থেকে অন্তত ৩০ গজ দূরে নালা থেকে স্থানীয়দের সহযোগিতায় তার মরদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। এর আগে গত ১৮ এপ্রিল চকবাজার হিজরা খালে পড়ে মারা যায় সেহেরিশ নামে আরেক শিশু। হুমায়রা আবদুর রহমান ও মরিয়ম দম্পতির একমাত্র সন্তান। তাদের বাসা ঘটনাস্থলের অদূরে একই এলাকায়। আবদুর রহমান ক্যাবল সংযোগ প্রতিষ্ঠানের লাইনম্যান হিসেবে কর্মরত আছেন। একমাত্র সন্তান হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি। আর বুকফাটা আহাজারি করছিলেন হুমায়রার মা।
হুমায়রার মা কান্নজড়িত কণ্ঠে সাংবাদিকদের বলেন, আমি ভেতরে ছিলাম। আমার মেয়ে গেটের সামনে বল দিয়ে খেলছিল। বল পানিতে পড়ে যায়। মেয়ে বল নিতে গিয়ে নালায় পড়ে যায়।
ঘটনাস্থলে এক প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকদের জানান, তিনি কর্মস্থল থেকে ফিরছিলেন। এ সময় দুই শিশু খেলছিল। শিশু দুটিকে পাশ কাটিয়ে সামান্য সামনে যেতেই পেছন থেকে এক শিশু তাকে ডেকে মরিয়মের পানিতে পড়ে যাওয়ার বিষয়টি জানান। তিনি তখন সেখানে একটি বল দেখতে পান। এরপর সাথে সাথে নালায় নেমে মরিয়মকে অনেক খুঁজেও পাননি।
স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, এলাকাবাসী নালার স্ল্যাব তুলে হুমায়রাকে উদ্ধারের চেষ্টা করে। প্রায় এক ঘণ্টা পর তাকে নিথর অবস্থায় উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যায়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক হুমায়রাকে মৃত ঘোষণা করেন। উদ্ধারের সময় হুমায়রা ইউটিলিটি সার্ভিসের পাইপের সাথে আটকানো অবস্থায় ছিল।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা কমান্ডার ইখতিয়ার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, মেইন রোডে স্কেভেটর দিয়ে ড্রেন ক্লিন করা হচ্ছে। সে কাজ চলমান। যতটা ড্রেনে আমরা কাজ করেছি প্রতিটি ড্রেনের স্ল্যাব তুলে আমরা আবার বসিয়ে দিয়েছি। এলাকাবাসীও এটা দেখেছে। আমাদের প্রতিটি ড্রেন স্ল্যাব দিয়ে ঢাকা আছে। আমাদের ড্রেনের নিরাপত্তা আমরা নিশ্চিত করেছি। তিনি বলেন, যে ড্রেনে পড়েছে ওটা সার্ভিস ড্রেন। এটা সিটি কর্পোরেশনের ড্রেন নয়, ভবনটির (ড্রেন সংলগ্ন ভবন, যে ভবনে থাকা গার্মেন্টেস মরিয়মের মা চাকরির জন্য এসেছেন) নিজস্ব ড্রেন। এটা মেইন ড্রেন এর সাথে যে কানেক্ট হয়েছে ওখানে যে চিপাটা সেখানে ওভার ফ্লো’র কারণে ঢুকে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ ঘটনায় দায় কার, সেটা না খুঁজে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেবা সংস্থাগুলোকে মনোযোগী হতে হবে। তাঁরা বলেন, জনগণ কোনো অবস্থাতেই কার দায় সেটা দেখতে চায় না। তারা প্রত্যাশা করে নিরাপদে হাঁটা–চলার স্বস্তিকর পরিবেশ। হুমায়রার মতো সন্তান যে কোনো পিতা–মাতার জন্য একটি স্বপ্নের বীজের মতো। কিন্তু সে স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হয়ে গিয়েছে নিদারুণ গাফিলতি এবং কর্তব্য অবহেলায়। একটি রাষ্ট্রে একজন শিশু খেলতে গিয়ে বা হাঁটতে গিয়ে নালায় পড়ে তলিয়ে যাবে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাঁরা বলেন, একের পর এক মৃত্যু হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা আমাদের ব্যথিত করে। এটা স্পষ্ট যে, সেবা সংস্থাসমূহের অদক্ষতা এবং উদাসীনতার কারণে জনভোগান্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নগরে উন্মুক্ত খাল–নালাগুলোর পাশে বেষ্টনি দেওয়ার কথা বারবার বলে আসছেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তবে এতেও ইতোপূর্বে টনক নড়েনি সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের। সিটি করপোরেশনের সাধারণ সভায় প্রতিবারই খাল–নালায় বেষ্টনির বিষয়ে আলোচনা হয়। তবে তা কেবল আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। মৃত্যুর ঘটনার পর শুধু অস্থায়ী বেষ্টনি দিয়ে দায় সারা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, যেসব খাল–নালা সড়কের পাশে আছে, সেগুলোতে বেষ্টনি দেওয়া জরুরি। তা না হলে বৃষ্টি হলে নালা এবং সড়ক পানিতে একাকার হয়ে যায়। তখন সড়ক নালা বোঝা যায় না। মূলত এ কারণে দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। খাল–নালায় পড়ে একের পর এক মৃত্যু ঘটলেও সিটি করপোরেশন ও সিডিএ নগরবাসীর সুরক্ষায় পুরোপুরি ব্যবস্থা নেয়নি এখনো। মানুষের জীবন নিয়ে তামাশা করছে এই দুটি সংস্থা। এগুলো স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, অবহেলায় হত্যাকাণ্ড।’ তাঁরা বলেন, প্রতিটি মৃত্যুর পর নানা উদ্যোগ গ্রহণ করার কথা বলা হলেও থামানো যায়নি মৃত্যুর মিছিল। সামান্য বৃষ্টি হলেই এসব খাল–নালা হয়ে উঠে মৃত্যুফাঁদ। যা নিয়ে নগরবাসী রীতিমতো আতঙ্কিত। মৃত্যুর এ মিছিল থামাতে হবে।