নগরের পাঁজর ঘেঁষে গাছ ফুল প্রাণের অনন্য সমারোহ

সিআরবি

| শনিবার , ১৭ জুলাই, ২০২১ at ৬:২৪ পূর্বাহ্ণ

বৈশাখের কৃষ্ণচূড়া, বর্ষার কদম আর হেমন্তের ছাতিম। কংক্রিটের অরণ্যের মাঝে নানা ঋতুর ফুলে বর্ণ আর গন্ধে ডুবে থাকা একখণ্ড সবুজ বনানী। সিআরবির বিচিত্র বৃক্ষ সম্ভারে শতবর্ষী রেইন ট্রি আর শিরীষের সাথে আছে জারুল, নিম, সেগুন, পিটালি, ডুমুর, কড়ই, পাকুর, এমনকি আম-জামও। নগরীর এম এ আজিজ স্টেডিয়াম পেরিয়ে পূর্ব রেলের সদর দপ্তর, যাকে নগরীর মানুষ সিআরবি (সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং) নামেই চেনে। সড়কের দুপাশে পাহাড়, টিলা আর উপত্যকা মিলিয়ে সবুজের এক বিচিত্র সম্ভার। এর মাঝে দাঁড়িয়ে আছে শতবর্ষী শিরীষ গাছ। যার তলায় প্রতি বছর হয় বর্ষবরণের বর্ণিল আয়োজন।-বিডিনিউজ।
সিআরবি ভবন ধরে জিএম বাংলোর (রেলের জেনারেল ম্যানেজারের বাসভবন) দিকে পাহাড়ে উঠতেই ঢাল নেমে গেছে দক্ষিণ দিকে। নগরীর টাইগার পাসের পাহাড়ের সাথে যুক্ত এ অংশ। তার আগে চোখে পড়বে পাহাড়ের ঢালে বেড়ে ওঠা জঙ্গল আর লালখানবাজারের সড়াকের কাছাকাছি হাতি বাংলো। হাতির আদলে তৈরি বলে বাংলোর এমন নাম। সাত রাস্তার মোড় থেকে কদমতলী ও টাইগার পাসমুখী সড়কের দুপাশে বিশালাকার শতবর্ষী রেইন ট্রি আর শিরীষের সারি। এসব অতি পরিচিত বৃক্ষের সাথে আছে নানা রকম স্বল্প পরিচিত আর বিলুপ্ত প্রায় গাছও। সিআরবি এলাকায় ১৯৭ প্রজাতির উদ্ভিদের সন্ধান মিলেছে, যার মধ্যে ১৫৪টি ঔষধি। বিপন্ন প্রায় ৯টি প্রজাতির গাছও আছে সেখানে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইফেক্টিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান অপিনিয়নের (ইকো) উদ্যাগে পরিচালিত এক গবেষণায় পাওয়া গেছে এসব প্রজাতির তথ্য। সিআরবি রেলওয়ে হাসপাতাল সংলগ্ন খালি জমি ও রেলওয়ে হাসপাতাল কলোনির ছয় একর জমি সরকারি-বেসরকারি (পিপিপি) প্রকল্পের আওতায় ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ কোম্পানি লিমিটেডকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল, ১০০ আসনের মেডিকেল কলেজ ও ৫০ আসনের একটি নার্সিং ইনস্টিটিউট নির্মাণের জন্য। এরপর থেকে সিআরবির ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক বেষ্টনী অখণ্ড রাখার দাবি তুলে সেখানে হাসপাতাল না করার দাবি জানিয়ে আসছে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। চলতি বছরের মার্চ থেকে সিআরবির উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে ইকো। এখনো পুরো জরিপ শেষ হয়নি তাদের। এখন পর্যন্ত সিআরবিতে মোট ১৯৭ টি উদ্ভিদ প্রজাতির তথ্য নথিভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে বড় বৃক্ষ ৭৪ প্রজাতির ও মাঝারি বৃক্ষ আছে ৩৭প্রজাতির। গুল্ম প্রজাতি আছে ৬৭টি। লতা জাতীয় উদ্ভিদ ১৪ প্রজাতির।
গবেষণার নেতৃত্বে থাকা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মাদ ওমর ফারুক রাসেল বলেন, চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন পাহাড় ও বনে কী কী উদ্ভিদ আছে তা জানতেই তাদের এ গবেষণা। তিনি বলেন, ‘সিআরবিতে পুরো কাজ এখনো শেষ করা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যেই ১৯৭ প্রজাতির উদ্ভিদ পেয়েছি। এখন পর্যন্ত শনাক্ত করা হয়নি এমন প্রজাতির সংখ্যা বিশের বেশি। এগুলো যাচাই করে দেখতে হবে। এর মধ্যে দেশে প্রথম পাওয়া গেল- এমন কোনো প্রজাতিও মিলতে পারে। এছাড়া সংরক্ষণ করা না হলে ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হতে পারে এমন প্রজাতি পাওয়া গেছে অর্ধশতাধিক।’ রাসেল বলেন, ‘সিআরবি এলাকায় যে শতবর্ষী রেইনট্রিগুলো আছে, সেগুলোতে বহু ধরনের পরগাছা, যেমন- ছত্রাক, শৈবাল, অর্কিড ও পরজীবীর বসবাস। সেগুলোর সংখ্যাও এখনো নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, এসব প্রজাতির সংখ্যা দেড়শর কম হবে না। শতবর্ষী গাছ কাটা হলে এসব আশ্রয়ী প্রজাতিও ধ্বংস হয়ে যাবে। গাছে অনেক কীটপতঙ্গ বসবাস করে। তারা ফুলের মধু আহরণের সময় পরাগায়ন ঘটায় যাতে উদ্ভিদের বংশবিস্তার হয়। এটা পুরো একটা ইকো সিস্টেম।’ এসব গাছপালাকে কেন্দ্র করে সিআরবিতে অনেক ছোট ছোট প্রাণি, যেমন- ব্যঙ, সাপ, নানা রকম পাখির বিচরণ ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে বলে জানান সহযোগী অধ্যাপক রাসেল। তিনি বলেন, ‘গাছ না থাকলে মাটির অনুজীব ও মাটির রাসায়নিক ভারসাম্যও নষ্ট হবে। গাছ কার্বন ডাই অক্সাইড নিয়ে সালোক সংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্য তৈরি করে আর পরিবেশে অক্সিজেন দেয়। ছয় একর জমির পরিবেশ বদলে ফেললে পুরো এলাকার ভারসাম্যে বিঘ্ন ঘটবে।’
বৃক্ষ, গুল্ম ও লতায় ঘেরা সিআরবিতে দিনের বিভিন্ন সময় সূর্যের আলোর রেখা পাতা ও ডালের ফাঁকে নানা নকশা আঁকে। কিন্তু বিজ্ঞানের ব্যাখ্যায় তার ভিন্ন তাৎপর্য আছে। মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল বলেন, এখানে অনেক জায়গায় সূর্যের আলো সরাসরি মাটিতে পড়ে না বলে একধরনের প্রাকৃতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। গাছ না থাকলে সরাসরি সূর্য আলো মাটিতে পড়বে। তখন বর্তমান ভারসাম্য থাকবে না। সিআরবিতে পাওয়া ঔষধি গাছের মধ্যে আছে মস (ইৎড়হিষড়রিধ বষধঃধ), টোনা (ঙৎড়ীুষঁস রহফরপঁস), অর্জুন (ঞবৎসরহধসরধ ধৎলঁহধ), লজ্জাবতী (গরসড়ংধ ঢ়ঁফরপধ), আপাং (অপযুৎধহঃযঁং ধংঢ়বৎধ), নিশিন্দা (ঠরঃবং হরশঁহফঁ), টগর (ঞধনবসধবসড়হঃধহধ ফরাবৎরপধঃধ), সজিনা (গড়ৎরহমধ ড়ষবরভবৎধ), দেবকাঞ্চন (ইধঁনরহরধ ঢ়ঁৎঢ়ঁৎরধ) ও মাটিসুন্দারের (ঞধপপধ রহঃরমৎরভড়ষরধ) মত প্রজাতি।
মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল বলেন, ‘ঔষধি গাছগুলো আমাদের অমূল্য সম্পদ। এছাড়া বিলুপ্ত প্রায় এমন কিছু গাছ আছে, যা এখনই সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে।’ সিআরবিতে এরকম বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদের মধ্যে দুধকুরুস (ডৎরমযঃরধ ধৎনড়ৎবধ), বাকা গুলঞ্চ (ঞরহড়ংঢ়ড়ৎধ বৎরংঢ়ধ), সোনাতলা (উরঢ়ষড়পষধংরধ মষধঁপবংপবহং) ও গুলঞ্চের (ঞরহড়ংঢ়ড়ৎধ পড়ৎফরভড়ষরধ) দেখা মিলেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের নিয়ে পরিচালিত এ গবেষণায় হুমকিতে থাকা উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে সর্পগন্ধা, বকুল, পিতরাজ ও দুরন্ত মিলেছে নগর কেন্দ্রের এই প্রাকৃতিক বনানীতে।
হাসপাতাল নির্মাণের ওই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত সিআরবি তার ঐতিহ্য হারাবে বলেও মনে করছেন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। ইতোমধ্যে রেলের শ্রমিক-কর্মচারী, চট্টগ্রামের বিশিষ্ট নাগরিকরা, বিভিন্ন পরিবেশবাদী-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সিআরবিতে হাসপাতাল স্থাপন না করার দাবি জানিয়েছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত আরো ৮০২, মৃত্যু ৯
পরবর্তী নিবন্ধবাংলাদেশের দাপুটে জয়