নগরীর ৩০ স্পটে ভয়াবহ শব্দদূষণ হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, স্কুল, হাসপাতালের মতো নিরব এলাকাতেই দূষণের মাত্রা বেশি। নগরীর জিইসি মোড়ে বেশি শব্দদূষণ হচ্ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, দীর্ঘ মেয়াদে বেশি মাত্রায় শব্দ শুনলে মানুষের স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যা ওষুধের মাধ্যমে নিরাময় সম্ভব হয় না। এতে এক সময় বধির হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ‘ঢাকায় সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণ হয়। এখন চট্টগ্রামেও শব্দদূষণ বাড়ছে। গাড়ির অনির্ধারিত হাইড্রোলিক হর্ণ ও সাউণ্ড সিস্টেমের কারণে শব্দের তীব্রতা দিন দিন বাড়ছে। এতে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ শ্রবণশক্তি হারাচ্ছে।’ পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম গবেষণাগার কার্যালয়ের পরিচালক ইশরাত রেজা দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘আমরা প্রতিমাসেই নিয়মিতভাবে নগরীর বিভিন্ন স্পটের শব্দের মাত্রা পরীক্ষা করি। যেসব এলাকায় মান মাত্রার চেয়ে বেশি শব্দের তীব্রতা পাওয়া যায় সেগুলোর বিষয়ে আমরা প্রতিবেদন দেই। শব্দদূষণ রোধে পদক্ষেপ নিতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও মহানগর পুলিশকে এসব বিষয়ে অবহিত করা হয়।’
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম গবেষণাগার কার্যালয়ের তথ্য মতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল স্পটগুলোকে নিরব এলাকা ধরা হয়। এসব এলাকায় শব্দের মানমাত্রা হচ্ছে ৪৫ ডেসিবল। কিন্তু নগরীর এ ধরণের ১৫ স্পটে দেড়গুণের বেশি মাত্রায় শব্দদূষণ হচ্ছে। গত ডিসেম্বরে সংগৃহীত নমুনা অনুযায়ী পাহাড়তলী গার্লস হাইস্কুলের সামনে ৭৬.৬ ডেসিবল, ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের সামনে ৭৪.৫ ডেসিবল, ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি চট্টগ্রামের (ইউএসটিসি) সামনে ৭৮.৫ ডেসিবল, চিটাগাং গভর্মেন্ট গার্লস হাইস্কুলের সামনে ৬৮.৬ ডেসিবল, বাংলাদেশ মহিলা সমিতি স্কুলের (বাওয়া) সামনে ৭৮.৫ ডেসিবল, ডা. খাস্তগীর গভর্মেন্ট গার্লস হাইস্কুলের সামনে ৭৫.৫ ডেসিবল, চট্টগ্রাম কলেজের সামনে ৭৮.৫ ডেসিবল, সিটি কলেজের সামনে ৬৭.৬ ডেসিবল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সামনে ৭৫.৫ ডেসিবল, চট্টগ্রাম মা ও শিশু মেডিকেল কলেজের সামনে ৬৭.৬ ডেসিবল, আন্দরকিল্লা জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালের সামনে ৭১.৫ ডেসিবল, লালখান বাজার মমতা ক্লিনিকের সামনে ৭৭.৫ ডেসিবল, একে খান আল আমিন হসপিটালের সামনে ৭৬.৫ ডেসিবল, পাঁচলাইশ সার্জিস্কোপ হসপিটালের সামনে ৭৩.৫ ডেসিবল, পূর্ব নাসিরাবাদের সাদার্ন হসপিটালের সামনে ৬৯ ডেসিবল মাত্রায় শব্দের তীব্রতা পাওয়া যায়। তাছাড়া আবাসিক এলাকায় শব্দের মানমাত্রা ৫০ ডেসিবল হলেও নগরীর চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় ৬৫ ডেসিবল, আমিরবাগ আবাসিকে ৬৭.২ ডেসিবল, হালিশহর কে-ব্লক আবাসিকে ৬৯ ডেসিবল, কল্পলোক আবাসিকে ৬৬.৫ ডেসিবল, হিলভিউ আবাসিকে ৬৭ ডেসিবল, কসমোপলিটন আবাসিকে ৬৭.৫ ডেসিবল ও খুলশী (দক্ষিণ) আবাসিকে ৭৬.৫ ডেসিবল শব্দের তীব্রতা পাওয়া যায়। আবার মিঙড এরিয়া হিসেবে মানমাত্রা ৬০ ডেসিবল থাকার কথা হলেও মুরাদপুর একুশে হাসপাতালের সামনে ৬৯.৫ ডেসিবল ও মেহেদীবাগ ম্যাস্ক হাসপাতালের সামনে ৭৬.৫ ডেসিবল মাত্রায় শব্দদূষণ পাওয়া যায়। একইভাবে বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০ ডেসিবল শব্দের মানমাত্রা থাকলেও নগরীর একে খান মোড়ে ৮৪.৫ ডেসিবল, জিইসি মোড়ে সর্বোচ্চ ৯৭.৫ ডেসিবল, বহদ্দারহাট মোড়ে ৮৪.৫ ডেসিবল, আগ্রাবাদ মোড়ে ৮৮ ডেসিবল, সিইপিজেড মোড়ে ৮৭.৫ ডেসিবল ও অঙিজেন মোড়ে ৭৭.৫ ডেসিবল মাত্রায় শব্দের তীব্রতা নির্ণয় করে পরিবেশ অধিদপ্তর।
জিইসি মোড়ে কথা হলে এক ট্রাফিক কর্মকর্তা বলেন, ‘চট্টগ্রামের সবচেয়ে ব্যস্ততম স্পট জিইসি মোড়। এখানে প্রতি ঘন্টায় হাজার হাজার গাড়ি চলাচল করে। গাড়িগুলোর হর্ণ শব্দের তীব্রতা বাড়াচ্ছে। এতে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।’ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নাক কান গলা বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রিদোয়ান আহমেদ নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমার কানে শোঁ শোঁ শব্দ হয়। এতে মাথাব্যথা বেড়ে যায়। কাজেও মন বসে না। তাই ডাক্তার দেখাতে এসেছি। ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে অতিমাত্রায় শব্দের কারণে এমনটি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন। ডাক্তার ওষুধের পাশাপাশি কিছু নিয়ম মেনে চলার জন্য বলেছেন।’
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের নাক কান গলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নুরুল করিম চৌধুরী বলেন, ‘বর্তমানে যেভাবে শব্দদূষণ হচ্ছে তা খুব ক্ষতিকর। মানুষ যদি দীর্ঘদিন ধরে মাত্রাতিরিক্ত শব্দের মধ্যে থাকে তাহলে তারা ধীরে ধীরে শ্রবণশক্তি হারাবেন। কারণ শব্দের তীব্রতায় আস্তে আস্তে মানুষের স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটা ওষুধ দিয়ে নিরাময় সম্ভব হয় না। এক সময় স্থায়ীভাবে বধির হয়ে যায়। তখন মেশিন ছাড়া মানুষ কানে শোনে না।’ তাছাড়া শব্দদূষণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ক্ষুধামন্দা, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, কাজে মনোযোগী হতে না পারা, কানের মধ্যে ভোঁ ভোঁ, শোঁ শোঁ করাসহ উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভোগতে পারেন বলে জানান এ চিকিৎসক।