নগরজুড়ে চলছে পানির জন্য হাহাকার। প্রতিদিন পত্রিকা অফিসে ফোন আসে। পানির দুর্ভোগের কথা জানান তাঁরা। এ নিয়ে গত ১৪ মার্চ দৈনিক আজাদীতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে তুলে ধরা হয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যর্থতা। বলা হয়েছে, কথা রাখতে পারে নি চট্টগ্রাম ওয়াসা। রোজার মধ্যে নগরীতে পানির কোনো সংকট হবে না বলে আশ্বস্ত করা হলেও প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়েছে পানির সংকট। ওয়াসার পানি উৎপাদন দৈনিক প্রায় ৮ কোটি লিটার কমে যাওয়ায় নগরীর পানি সরবরাহ নেটওয়ার্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বিভিন্ন এলাকায় পানির হাহাকার চলছে। অপরদিকে বছরের পর বছর ধরে পতেঙ্গা এলাকার হাজার হাজার মানুষ ওয়াসার পানি থেকে বঞ্চিত রয়েছে। বিভিন্ন সময় পানি সরবরাহের আশ্বাস দেয়া হলেও বিস্তৃত এলাকার অগুনতি মানুষ পানি পায়নি। এই রোজার দিনেও তারা পানি পাচ্ছে না, অনেকেই লবণাক্ত পানি দিয়েই ইফতার সেহেরি সারছেন। পতেঙ্গা এলাকায় ওয়াসার পানি সরবরাহের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, চলমান রোজায় পানির কোনো সংকট হবে না এমন একটি আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম ফজলুল্লাহ। কিন্তু রোজার প্রথম দিন থেকেই পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পানির হাহাকার দেখা দেয়। ওয়াসার লাইনে কোনো পানি পাওয়া যাচ্ছে না বহু এলাকায়। কোনো কোনো এলাকায় এক দুই ঘন্টা পানি থাকলেও দিনের বেশির ভাগ সময় পানি জুটছে না। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে চট্টগ্রাম ওয়াসার একজন কর্মকর্তা বলেন, আসলে নগরবাসীর পানির চাহিদা পুরোপুরি মেটানোর সক্ষমতা ওয়াসার রয়েছে। কিন্তু ওয়াসার পানির প্রধান উৎস হালদা নদী ও কর্ণফুলী নদীতে পানি কমে যাওয়ায় পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হচ্ছে। নদীর পানিতে তীব্র লবণাক্ততাও এক্ষেত্রে বড় ধরনের অন্তরায় হয়ে উঠেছে। সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও লবণের কারণে পানি উৎপাদন বন্ধ রাখায় সরবরাহ নেটওয়ার্ক থেকে দৈনিক ৮ কোটি লিটার পানি কমে গেছে। যা নগরীতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।
ওয়াসার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, কাপ্তাই হ্রদে বর্তমানে পানি রয়েছে ৮০ দশমিক ০৫ ফুট মিন সি (এমএসএল) লেভেল। এখন পানি থাকার কথা ৯০ ফুট এমএসএল। কাপ্তাই হ্রদের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে অন্তত ১০ ফুট কমে যাওয়ায় পানি ছাড়ার পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। উপর থেকে পানি না আসায় কর্ণফুলীর লবণাক্ত পানি উজানেও লবণাক্ততা বাড়িয়ে দিচ্ছে। উপর থেকে পানির পরিমাণ কমে যাওয়ায় নিচের জোয়ারের পানি বেশ উজানে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। এর থেকে উত্তরণ পাওয়ার জন্য কাপ্তাই হ্রদের পানি প্রবাহ বাড়াতে হবে। যা ভারী বৃষ্টি না হলে সম্ভব নয়।
চট্টগ্রাম ওয়াসার বিশেষ কাজ হলো নিরাপদ ও পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করা, শিল্প এবং বাণিজ্যিক ব্যবহারের মাধ্যমে স্যানিটেশন এবং ভাল স্বাস্থ্যকর অবস্থা নিশ্চিত করতে গার্হস্থ্য এবং অন্যান্য পয়ঃনিষ্কাশনের যথাযথ নিষ্পত্তি নিশ্চিত করা এবং চট্টগ্রাম শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। দ্রুত বর্ধনশীল শহরের সেবায় ওয়াসা পানি সরবরাহ এবং পয়ঃনিষ্কাশন প্রদানের সময় ওয়াসাকে অসংখ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। যেমন– ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত নেমে যাওয়া, পর্যাপ্ত পরিমাণে খাল ও নদী–নালার অভাব, শহরের ঘনবসতি ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাওয়া, ভূ–উপরিস্থ পানি কলকারখানার বর্জ্য নিষ্কাশনের মাধ্যমে ব্যবহার অনুপযোগী হওয়া, নগরবাসী কর্তৃক অবৈধ পানি ব্যবহার প্রবণতা। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে কাজ করতে হয় ওয়াসাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের পরিসংখ্যান নিরাপদ পানির নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। খাল–বিল–নদী দখল ও দূষণ, রাসায়নিক ও কীটনাশকের অবাধ ব্যবহার, উপকূলের লবণাক্ততা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে দেশে নিরাপদ পানির উৎস সংকুচিত হয়েছে। সারফেস ওয়াটারের বদলে মাটির নিচের পানির ওপর বিপজ্জনক নির্ভরতা বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে নিরাপদ পানির সংকটকে কাজে লাগিয়ে পানির বাণিজ্যিকীকরণ। ফলে চড়া মূল্যে বোতল কিংবা জারের পানি কিনে খাওয়া এখন স্বাভাবিক বাস্তবতা। এ পরিস্থিতির পরিবর্তনে পানিকে বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে দেখা বন্ধ করতে হবে। দেশের সব মানুষকে নিরাপদ পানি সরবরাহের দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্রকেই।
নগরীতে পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা একটি জটিল কিন্তু অপরিহার্য কাজ, যার জন্য সকল অংশীদারের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। একটি স্বাস্থ্যকর শহরে প্রতিটি বাসিন্দার জন্য পরিষ্কার এবং নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা ওয়াসার দায়িত্ব। নগরজুড়ে পানির যে হাহাকার শুরু হয়েছে, তা অচিরেই বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে।