নগরীর তুলনায় জেলায় আত্মহত্যা বেশি

মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখা জরুরি ।। বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস আজ

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৬:৩৮ পূর্বাহ্ণ

বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। কমছে জীবনের প্রতি ভালোবাসা। আত্মহত্যা ঠেকাতে ২০০৩ সাল থেকে প্রতি বছর ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস পালন করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় ইন্টারন্যাশানাল অ্যাসোসিয়েশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশন (আইএএসপি) এবং ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথ বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস পালন করে। জানা গেছে, চট্টগ্রামে নগরীর তুলনায় জেলার বিভিন্ন এলাকায় আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটছে।
নানা কারণে প্রতিদিন অকাতরে ঝরছে প্রাণ। হত্যাকাণ্ডের চেয়ে আত্মহত্যার প্রবণতাও কম নয়। বিপদের চরম সীমায় পৌঁছে পরিণামে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে হতাশা থেকে মুক্তির পথ খুঁজে নেয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এভাবে আত্মহত্যা বা আত্মহননের মধ্য দিয়ে একজন মানুষের চিরবিদায় কখনো প্রত্যাশিত হতে পারে না। কারণ প্রতিটি জীবনেরই মূল্য আছে। প্রতিটি মানুষ সমাজ-সংসারে এবং দেশের উন্নয়নে এগিয়ে যাওয়ার পথযাত্রায় কোনো না কোনো ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারেন।
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, আত্মহত্যা সাধারণত দুই ধরনের। একটি হচ্ছে পরিকল্পনা করে আত্মহত্যা (ডিসিসিভ)। আরেকটি হঠাৎ করে ফেলা আত্মহত্যা (ইমপালসিভ)। অনেক সময় দেখা যায়, কেউ যদি মৃত্যুর কথা বলেন, তখন সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করেন। একটি বড় ভুল ধারণা আছে, যারা মৃত্যুর কথা বলেন, তারা আত্মহত্যা করেন না। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, তাদের মধ্যেই আত্মহত্যার ঝুঁকি অনেক বেশি। তাই প্রতিটি মৃত্যুর ইচ্ছাকে আত্মহত্যার ইঙ্গিত হিসেবে ধরে নিতে হবে। আইনের চোখে আত্মহত্যা একটি অপরাধ বলে বিবেচিত হলেও তার প্রভাব পড়ছে না সমাজে। চিকিৎসকদের মতে, মানসিক বিষণ্নতা থেকেই মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করে থাকে। নিজের কাছে, পরিবার ও সমাজের কাছে নিজেকে মূল্যহীন ভাবতে গিয়েই মানুষ পা বাড়ায় আত্মহত্যার দিকে।
বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন আজাদীকে বলেন, একটি মানুষের মানসিক গঠনে যেসব বিষয় ভূমিকা রাখে সেগুলোর কোনও একটি বিষয় যদি অনুপস্থিত থাকে তাহলে তার প্রভাব তার কার্যক্রমে দেখা যায়। একজন হত্যাকারীর ভেতর দেখা যাবে মানবিক অনেক কিছু অনুপস্থিত। তার গঠন ঠিকমতো হয়নি। সে অন্যের স্বার্থের চেয়ে নিজের স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দেয়। তার মূল্যবোধের জায়গাটিও তৈরি হয়নি। সঠিক শিক্ষার অভাব, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে একজন মানুষ হত্যাকারী হয়ে উঠেন। আবার যিনি আত্মহত্যা করেন তার পেছনেও অনেকগুলো কারণ আছে। মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখা উভয়ের জন্যই জরুরি।
তিনি বলেন, আমাদের দেশের যেসব এলাকা বা স্থানের মানুষ বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা থেকে পিছিয়ে রয়েছে সেখানকার মানুষের মধ্যে তুলনামূলক হত্যা, যৌতুকসহ বিভিন্ন অপরাধ প্রবণতা বেশি দেখা যায়। তিনি আরো বলেন, সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি, অপব্যবহার প্রভৃতি কারণ অপঘাতে মৃত্যু কিংবা আত্মহননের অন্যতম অনুষঙ্গ।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মিশকাতুর রহমান আজাদীকে বলেন, আত্মহত্যার চেষ্টাকারীকে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসতে হবে। এ ধরনের রোগী অবশ্যই সুস্থ হতে পারে। তবে এর সবচেয়ে বড় ওষুধ হলো, যে কারণে আত্মহত্যার চেষ্টা তা সমাধানের চেষ্টা করা। তা যদি না করা যায়, তবে ওষুধে সে হয়তো কিছুদিন সুস্থ থাকবে, কিন্তু পুনরায় তার মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা জেগে উঠতে পারে।
তিনি বলেন, যে সংখ্যক লোক আত্মহত্যা করে তার চেয়ে ১০ গুণ বেশি আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। আত্মহত্যা করবে বলে চিন্তা করে তারও ১০ গুণ বেশি মানুষ। মানসিকভাবে বিপর্যস্তদের মধ্যে ৭০ শতাংশই আত্মহত্যা করে।
জানা যায়, গত বছর চট্টগ্রামে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল। প্রায় প্রতিদিনই চট্টগ্রামের কোথাও না কোথাও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছিল। চলতি বছরেও তা অব্যাহত আছে। সারা দেশের থানা, পুলিশ ফাঁড়ির দেয়া তথ্যানুযায়ী বিশেষ করে থানায় লিপিবদ্ধ মামলার তথ্যানুযায়ী দেশে প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৩১টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এ হিসাবে মাসে এ ধরনের অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটে ৯০০ জনের। আর বছরে আত্মহননে মৃত্যু ঘটে ১০ হাজার ৮০০ জনের। এসব মৃত্যুকে আত্মহত্যা বা আত্মহনন বলে থানায় প্রদত্ত এজাহারে উল্লেখ করা হয়। এ কারণে অনেক সময় প্রকৃত আত্মহত্যায় বা আত্মহননে মৃত্যুর পরিসংখ্যান জানা সম্ভব হয় না।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে আত্মহত্যার চেষ্টাকারীদের মধ্যে কীটনাশক পানের প্রবণতা বেশি। অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ সেবন করেও আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। এর পরে রয়েছে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা, ট্রেন বা বাসের নিচে ঝাঁপ দেয়া, উঁচু ভবন থেকে লাফিয়ে পড়া, গায়ে আগুন দেয়া, নিজের শরীরে অস্ত্র চালানোর মাধ্যমে আত্মহত্যা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ না করার কারণে আত্মহত্যার ঘটনা সাধারণত ইউডি (আননেচারাল ডেথ বা অপমৃত্যু) হিসেবেই যবনিকাপাত ঘটে। এছাড়া পুলিশের পক্ষ থেকে স্বপ্রণোদিত হয়ে যদি আত্মহত্যার মামলাগুলো তদন্ত করা যায় তাহলে বেশির ভাগ আত্মহত্যার প্ররোচনাকারীদের সনাক্ত করা সম্ভব। তবে আত্মহত্যার ক্ষেত্রে আইনের এই ধারাটিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধউঠানে এসে পড়ল মাঝারি গোলা
পরবর্তী নিবন্ধদুই মামলায় আসামি দেড় শতাধিক, গ্রেপ্তার ৮