চট্টগ্রামে তিনজনের শরীরে জিকা ভাইরাস শনাক্ত এবং নগরীর ছয়টি এলাকায় কীটতাত্ত্বিক দলের এডিস মশা চিহ্নিতকরণে পরিচালিত জরিপের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে বিভিন্ন পদক্ষেপসহ তিনটি সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো আইইডিসিআর জিকা ভাইরাস শনাক্তের রিপোর্ট পায়। ফলশ্রুতিতে আইইডিসিআরের ‘র্যাপিড রেসপন্স টিম’ ১২ থেকে ১৮ জুলাই চট্টগ্রামের তিনটি সরকারি হাসপাতাল, পাঁচটি বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়গনস্টিক সেন্টার এবং নগরীর পাঁচটি ওয়ার্ডে রোগতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চালায়। এই এলাকাগুলো হলো–চট্টেশ্বরী রোড (ওয়ার্ড ১৫), ও আর নিজাম রোড (ওয়ার্ড ১৫), আগ্রাবাদ (ওয়ার্ড ২৭), পাহাড়তলী (ওয়ার্ড ৯), হালিশহর (ওয়ার্ড ২৬), এবং ঝাউতলা (ওয়ার্ড ১৩)। জরিপকালে মোট ১২৮টি বাড়ি পরিদর্শন করা হয়, যার মধ্যে ৬২টি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এই তথ্যের ভিত্তিতে ব্রেটো ইনডেক্স ছিল ৭৫.২৯, হাউস ইনডেক্স ৪৩.০৪ এবং কন্টেনার ইনডেক্স ছিল ৫১.০১। ডব্লিউএইচও নির্দেশনা অনুযায়ী, ব্রেটো ইনডেক্সে ২০–এর উপরে হলে এলাকাটি উচ্চ–ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়, ফলে এই সকল এলাকা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ওয়ার্ডভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চট্টেশ্বরীতে ব্রেটো ইনডেক্স ৪৮.৩৯, ও আর নিজাম রোডে ৪২.৮৬, আগ্রাবাদে ১৩৪.৬২, পাহাড়তলীতে ১১০.০০, হালিশহরে ৬৬.৬৭ এবং ঝাউতলায় ৩৩.৩৩, যা সকল এলাকাকেই উচ্চ–ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে। প্রাপ্ত লার্ভা নমুনায় প্রজাতি ভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৬৫ শতাংশ ছিল এডিস ইজিপ্টি ৩২.৬৪ শতাংশ ছিল এডিস এলবোপিক্টাস এবং ২.৮৬ শতাংশ নমুনায় উভয় প্রজাতির মিশ্র উপস্থিতি পাওয়া যায়। এডিস ইজিপ্টি মশার আধিক্য এই শহরাঞ্চলে জিকা ভাইরাসের সংক্রমণের উচ্চ সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়।
অন্যদিকে প্রতিবেদনে রোগতাত্ত্বিক প্রাথমিক ফলাফলে বলা হয়েছে, চলতি জুলাইয়ে চট্টগ্রামে শনাক্ত তিনজন নিশ্চিত জিকা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর বিশ্লেষণে দেখা যায়, আক্রান্তদের মধ্যে দুইজন পুরুষ এবং একজন নারী। বয়স অনুযায়ী অধিকাংশ রোগীর বয়স ছিল ৪০–৪৯ বছর এবং বাকিদের বয়স ৫০–৫৯ বছর। পেশাগত দিক থেকে দুইজন রোগী ব্যবসায়ী এবং একজন গৃহিণী ছিলেন। সব রোগীর মধ্যে জ্বর, অস্থিসন্ধিতে ব্যথা (আর্থ্রালজিয়া), ও মাংসপেশিতে ব্যথা (মায়ালজিয়া) ছিল। এছাড়া দুই পুরুষ রোগীর মধ্যে ত্বকে র্যাশ এবং মাথাব্যথা লক্ষ্য করা গেছে, আর নারী রোগীর ক্ষেত্রে লিম্ফনোড ফুলে যাওয়া (লিক্ষ্যাডেনোপ্যাথি) এবং শরীর ফোলা (এডিমা) দেখা গেছে। তিনজনের মধ্যে শুধুমাত্র নারীর এর লক্ষণ শুরু হওয়ার পূর্বের ১৫ দিনের মধ্যে ভ্রমণের ইতিহাস আছে (কক্সবাজার)। মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধমূলক আচরণে স্পষ্ট দুর্বলতা দেখা যায়। নারী রোগী দীর্ঘ হাতাওয়ালা কাপড় পরতেন, রাতের বেলায় মশারি ব্যবহার করতেন এবং জানালায় মশার পর্দা ব্যবহার করতেন। কেউই দিনে মশারির ব্যবহার করতেন না।
প্রতিবেদনে চারটি পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে– হাসপাতাল সমূহে উপসর্গের ভিত্তিতে রোগী শনাক্তকরণে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য নির্ধারিত জিকা কেস ডেফিনিশন নিয়ে আলোচনা ও লিফলেট বিতরণ, আক্রান্ত বাড়ির আশেপাশে এডিস মশার প্রজননস্থল যেমন পরিত্যক্ত ড্রাম, ফুলের টব, পানি জমে থাকা গর্ত শনাক্ত করে সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীকে অবহিতকরণ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ প্রদান, উপদ্রুত এলাকায় ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং মশা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কার্যক্রম (ফ্লিপচার্ট বিতরণ ও উঠান বৈঠক) পরিচালনা করা এবং চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন অফিসের সমন্বয়ে সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও বাহক নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সাথে মশক নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে আলোচনা করা।
অন্যদিকে প্রতিবেদনে তিনটি সুপারিশ করা হয়েছে– সেগুলো হলো, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর লক্ষণ বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান করা। কীটতাত্ত্বিক জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাসমূহে অনতিবিলম্বে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং পর্যায়ক্রমে সিটি কর্পোরেশনের অন্যান্য ওয়ার্ডসমূহকে উক্ত কার্যক্রমের আওতায় আনা এবং মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে জনগণের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা।