নগরায়ণ ও নদীর হারানো গতি

রূপম চক্রবর্ত্তী | বৃহস্পতিবার , ১১ জুলাই, ২০২৪ at ৮:২৬ পূর্বাহ্ণ

নদী আর নগর একে অপরের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের চরম অবনতি পরিলক্ষিত করছি। নদনদীকে কেন্দ্র করে কৃষি, চলাচল, বাণিজ্য সুবিধাজনক বলে বাংলায় পৃথিবীর বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সমাবেশ ঘটেছে বিগত শতাব্দীর পর শতাব্দীর ধরে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে বিভিন্ন নগর, শহর, বাণিজ্যিক কেন্দ্র গড়ে উঠেছে নদীর তীরবর্তী এলাকায়। একটা সময় ছিল যখন সড়ক ব্যবস্থার অবস্থা খুব খারাপ ছিল। তখন মানুষ নৌপথ ব্যবহার করেই যাতায়াত করত। এই নদীগুলো সর্পিল গতিতে ছুটে চলে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে নদীর বাক বদলে বদলায় জীবন। বদলে যায় জনপদের প্রকৃতি, জনপদের বৈশিষ্ট্য। ঐতিহ্যের লীলা ভূমি থেকে শুরু করে নগর, বন্দর, গঞ্জ সবকিছু গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। যুগে যুগে নদী অববাহিকায় গড়ে উঠেছে বহু সভ্যতা। আপন গতিতে ছুটে চলা নদীর পানির ওপর নির্ভর করেছে তাদের জীবিকা, সংস্কৃতি, দর্শন ও জীবনধারা। কখনো কখনো নদীর গর্ভে হারিয়েও গেছে অনেক সভ্যতা।

বিশ্বের বহু নামকরা শহর রয়েছে যারা বুকে ধারণ করে রেখেছে হাজার বছরের পুরনো বিখ্যাত সব নদী। শিল্পায়ন ও নগরায়ণের কারণে নগরের পাশের যে নদীটি আছে সে নদীটি কিন্তু সব সময় আক্রান্ত হচ্ছে। নগরায়ণের দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে গেছে। বহু রাস্তাঘাট, সেতু, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে বা এখনো হচ্ছে। এতে পরিবেশের দ্রুত অবক্ষয় হচ্ছে। বহু নদনদী শুকিয়ে ও দখল হয়ে গেছে। খাল, বিল, পুকুরদিঘি, হাওড় হারিয়ে যাচ্ছে। যা কিছু অবশিষ্ট আছে তা আজ চরমভাবে দূষিত।

শিল্পকলকারখানা থেকে নির্গত নাইট্রাস অক্সাইড, নাইট্রোজেন, সালফার অক্সাইড, সালফার ডাইঅঙাইড, কার্বন ডাইঅক্সাইড ইত্যাদি গ্যাসগুলোর মাধ্যমে এসিড বৃষ্টি হয় যা নদীতে অ্যাসিডিফাই করে, ফলে নদী দূষিত হয়। এছাড়াও শিল্পকলকারখানা থেকে নির্গত বিভিন্ন ভারী ধাতু যেমনপারদ, সিসা, নিকেল, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, আর্সেনিক বিভিন্নভাবে নদীকে দূষিত করে।

অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে ৪০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী এই ঢাকা শহর এখন বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহরের মধ্যে একটি। সম্প্রতি একটি গবেষণায় সারা বিশ্বে বসবাসের জন্য অযোগ্য নগরীর মধ্যে দ্বিতীয় স্থান দখল করেছে ঢাকা। বুড়িগঙ্গা নদীর পাশ দিয়ে যখন আপনি হাঁটবেন তখন বুঝবেন কীভাবে এই নদীটি দূষিত হচ্ছে।

বুড়িগঙ্গার রূপ দর্শন করতে গেলে তার জীর্ণশীর্ণ, শ্রীহীন, দূষিত, দুর্গন্ধময় চেহারা দেখে অবশ্যই ব্যথিত হবেন। বুড়িগঙ্গার আগের রূপ বা সৌন্দর্য এখন আর নেই। কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে। কোটি মানুষের ব্যবহৃত বিষাক্ত পানি ও বর্জ্য এসে পড়ছে বুড়িগঙ্গায়। গৃহস্থালি, শিল্পকারখানা ও হাসপাতালের কঠিন বর্জ্য পদার্থের বড় একটা বড় অংশ কোনো শোধন ছাড়াই প্রতিদিন বুড়িগঙ্গায় পড়ছে। ক্রমাগত দূষণে এর পানি কালচে আকার ধারণ করেছে। কালো রঙের পানি উৎকট গন্ধ ছড়াচ্ছে। পানি দুর্গন্ধে শ্বাস নেওয়াই দায় হয়ে পড়ে। নদীর পানিতে ভাসছে নানা ধরনের ময়লাআবর্জনা। বুড়িগঙ্গার আজকের এই করুণ পরিস্থিতির জন্য দায়ী অপরিকল্পিত নগরায়ণ। এই অপরিকল্পিত নগরায়ন থেকে সৃষ্টি অপরিকল্পিত শিল্পায়ন। যার কারণে বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে এবং উঠছে বিভিন্ন ধরণের শিল্পকারখানা। অপরিকল্পিত নগরায়নের পাশাপাশি দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি বুড়িগঙ্গার পরিবেশকে দিনকে দিন দূষিত করেছে।

ঢাকার মতো চট্টগ্রামেও নগরায়ণের যথেষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন স্থানে নদীর তীরে গড়ে উঠা তেলের দোকান, খোলা টয়লেট, সার কারখানা, সিমেন্ট কারখানাসহ বিভিন্ন শিল্প এলাকার শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কেমিক্যাল বর্জ্য ড্রেন ও খালের মাধ্যমে ফেলা হচ্ছে নদীতে।

গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের উপকূলীয় নদনদীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হচ্ছে কর্ণফুলী নদীতে। প্লাস্টিক বর্জ্য নদীর তলদেশের মাটি, পানি, মাছ ও উদ্ভিদের ক্ষতি ছাড়াও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রতিদিন চট্টগ্রাম নগরী থেকে নানাভাবে প্রায় আড়াই শ মেট্রিক টন পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে পড়ছে। এসব বর্জ্য মাছসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করছে। এতে বিভিন্ন ধরনের রোগে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। সরকারকে অবশ্যই এই জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং এর ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। অন্যথায়, আমাদের শুধু তাকিয়ে দেখতে হবে, কীভাবে সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে গত ২৬ জুন ২০২৪ তারিখে ‘আরবান রেজিলেন্স ফোরাম’ এর আলোচনা সভায় দ্রুত নগরায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় টেকসই নগর উন্নয়নের আহ্‌বান জানানো হয়।

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম এমপি বলেন, “সরকার একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ গড়তে এবং জলবায়ুবান্ধব উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য ন্যাশনাল আডাপ্টেশন প্ল্যান (NAP) ও বাংলাদেশ ডেল্টা পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে এবং জাতীয় নগর নীতি চূড়ান্ত করেছে। তিনি আরও বলেন, ‘স্থিতিশীল শহর ও নগর গড়তে সরকার এখন স্থির অবকাঠামো, সমন্বিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা, কমিউনিটিভিত্তিক অভিযোজন, বনায়ন ও ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধার এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।’ বাংলাদেশের নদীমাটি ও প্রাকৃতিক পরিবেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বদলে যাচ্ছে। এই বদল সামনে আরও দৃশ্যমান হবে। ফলে ওই পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার মতো কার্যকর কৌশল আমাদের নিতে হবে।

বাংলাদেশের নদী ও বদ্বীপ অঞ্চল ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়। সে উদ্যোগ কতটুকু কার্যকর হচ্ছে তার বাৎসরিক রিপোর্ট সংবাদপত্রে প্রকাশ করতে হবে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় নির্মিত বাঁধগুলো দিয়ে যাতে পানি যেতে পারে, সে জন্য জলকপাটগুলোর প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। প্রকল্প নেওয়ার পর তা যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ না হয়, তাহলে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। বিভিন্ন ধরনের প্রকল্পের ক্ষেত্রে দেশে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার যাতে ঘাটতি না হয় তার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। নদী দূষণ রোধে উৎসমুখে বাঁধ দেওয়াসহ সতর্ক থাকতে হবে। নদী দূষণ রোধে নদীর পানিতে ময়লা ফেলা বা নৌযান নির্গত বর্জ্য, তেল ফেলা নিষিদ্ধ করতে হবে। সব শিল্প, কলকারখানায় বর্জ্য পরিশোধন প্লান্ট সংযোজন ও যথাযথ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। ‘ক্লিনার প্রোডাকশন’ পদ্ধতি চালু করতে হবে। নৌযানে রূপান্তরিত গ্যাস ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। শিল্প, কলকারখানা ও গার্হস্থ্য ব্যবহার্য কঠিন বর্জ্য পদার্থ পানিতে মিশতে দেওয়ার পথ বন্ধ করতে হবে। আমরা যদি কর্ণফুলী আর বুড়িগঙ্গাকে টেমস নদীর আদলে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখে এবং তার বাস্তবে রূপান্তরের চেষ্টা করতে পারি তাহলে প্রত্যেকটি নগর এবং তার পাশের নদীগুলো পর্যটকে পরিপূর্ণ হবে। নদীবিধৌত শহরগুলোর পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা দাপুটে যৌবনদীপ্ত টেমসের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। টেমসের ঝিরিঝিরি বাতাসে মিশে থাকে এক জাদুময় মোহ। আর তা গায়ে মাখতেই হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ছুটে আসে পর্যটকরা। চলুন সবাই মিলে দূষণমুক্ত নদী এবং নগর গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসবুজ সুন্দর
পরবর্তী নিবন্ধএকুশই কি মানব সভ্যতার শেষ শতাব্দী