নগরায়ণের ভিড়েও টিকে আছে একজোড়া মুখপোড়া হনুমান

খাগড়াছড়ি পৌরশহর

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি | রবিবার , ১৫ জুন, ২০২৫ at ৬:৫০ পূর্বাহ্ণ

নগরায়ন, পাহাড় কেটে বসতি নির্মাণ, খাদ্য সংকট, জনসংখ্যা চাপের মাঝেও খাগড়াছড়ি শহরেই অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে দুর্লভ এক জোড়া মুখ পোড়া হনুমান। শহরের ছোট ছোট সবুজ বনগুলোতে তাদের দেখা যায়। খাগড়াছড়ি পৌরশহরের মধ্যে তাদের অবস্থান হলেও মানুষের কোলাহল এড়িয়ে চলে তারা। শহরের অভ্যন্তরে ছোট ছোট টিলা কেন্দ্রিক বনে মাঝে মাঝেই তাদের দর্শন পাওয়া যায়। সম্প্রতি হনুমানের অস্তিত্বের সন্ধান পায় এই প্রতিবেদক। পৌর শহরের কলেজ পাড়ার এক ছোট জঙ্গলে চাপালিশ গাছে ফল খেতে এরা আসে। শহরের বাসিন্দাদের বেশ কয়েকজন সবুজ জঙ্গল কেন্দ্রিক টিলাগুলো মুখপোড়া হনুমানের দেখা যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। মুখপোড়া হনুমান চিরসবুজ বনের বাসিন্দা। এর আগে গত কয়েক বছরে মাইসছড়ি ও দীঘিনালার একটি বনে এদের ঝাঁক দেখা যায়। কেবল বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপী এই প্রজাতির হনুমান বিপন্ন। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএ) এর তথ্য মতে মুখ পোড়া হনুমান বিশ্বব্যাপী সংকটাপন্ন প্রাণী।

স্থানীয়রা জানান, এখন চাপালিশ গাছের ফল পেকেছে। মূলত ফল খেতেই তারা বনের চাপালিশ গাছের শাখায় বিচরণ করছে। খাগড়াছড়ি শহরের বাসিন্দা বৃষ্টি চৌধুরী বলেন, চেঙ্গী স্কয়ার জনবল বৌদ্ধ বিহারের সামনে বটগাছের ফল খেতে তারা মাঝে মাঝে আসে। বেশ কয়েকবার দেখেছি। খাগড়াছড়ি শহরের বাসিন্দা মংসাথোয়ায় মারমা বলেন, বিভিন্ন স্থাপনার কারণে দিন দিন শহরে ভেতরে সবুজ বনের পরিমাণ কমছে। মানুষ পাহাড় কেটে বসতি বানাচ্ছে। গাছপালা সব কেটে ফেলা হচ্ছে। এতে দুর্লভ প্রাণীরা খাদ্য ও আবাস সংকটে পড়ে যাচ্ছে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও শহরের ভেতরে সংকটাপন্ন প্রাণীর অস্তিত্ব থাকা ভালো খবর। প্রকৃতি ও বাস্তুসংস্থান রক্ষায় তাদের সংরক্ষণে উদ্যোগ নিতে হবে।

মুখপোড়া হনুমানের ইংরেজি নাম ক্যাপড লিফ মাঙ্কি। এটি প্রাইমেট প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। মুখপোড়া হনুমান মূলত বৃক্ষচারী প্রাণী। চলাফেরা, খাবার সংগ্রহ, ঘুম, খেলাধুলা, বিশ্রাম, প্রজননসবই গাছে সম্পন্ন করে। এরা মূলত চাপালিশ, বহেরা, আমড়া, হরিতকি, বট, পাকুড়সহ বিভিন্ন প্রজাতির ফল খেতে পছন্দ করে। খাগড়াছড়ি শহরে বেশ কিছু এলাকায় এখনো চাপালিশ, চালতা, বটসহ বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ টিকে থাকায় এরা খাবারের খোঁজে লোকালয়ে আসে না।

পুরুষ মুখপোড়া হনুমানের শরীরের আকার ৭০ সেন্টিমিটার। শরীরের তুলনায় লেজ লম্বা। দৈর্ঘ্য প্রায় ৯৪ থেকে ১০৪ সেন্টিমিটার। স্ত্রী হনুমানের শরীর ৬৭ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। লেজ প্রায় ৯০ সেন্টিমিটার। পুরুষ হনুমানের ওজন সর্বোচ্চ ১৪ কেজি। স্ত্রী হনুমানের ওজন প্রায় ১১ কেজি। দেহের চামড়া কালচে। পিঠ ও দেহের ওপরের লোম গাঢ় ধূসরবাদামি এবং বুকপেট ও দেহের নিচ লালচে, লালচেবাদামি বা সোনালি। লোমবিহীন মুখমল, কান, হাত ও পায়ের পাতা কুচকুচে কালো। মাথার চূড়া ও লেজের আগাও কালো।

বায়োডাইভার্সিটি কনজারভেশন সোসাইটি অব সিএইচটি এর সংগঠক সবুজ চাকমা বলেন, বাংলাদেশে যে তিন প্রজাতির হনুমান পাওয়া যায় তার মধ্যে মুখপোড়া হনুমানের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। তবে অবাক করা ব্যাপার তারা খাগড়াছড়ি পৌর শহরের ভেতরে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। তারা লোকালয়ে আসে না, শহরের আশপাশের অক্ষত পাহাড় কেন্দ্রিক বনে বিচরণ রয়েছে তাদের। দুর্গম বনের এই প্রাণী এখনো আমাদের শহরে রয়েছে। এটি ইতিবাচক। কেউ যাতে তাদের উপর আক্রমণ করতে না পারে সেক্ষেত্রে বনবিভাগকে সতর্ক থাকতে হবে। এছাড়া বৈদ্যুতিক লাইনগুলো হনুমানের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে।

খাগড়াছড়ি বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. ফরিদ মিঞা বলেন, আমাদের দেশে মুখপোড়া হনুমানের সংখ্যা কমে এসেছে। তবে খাগড়াছড়ি জেলা শহরে এখনো তাদের অস্তিত্ব রয়েছে। মুখপোড়া হনুমান দলবদ্ধভাবে বিচরণ করে। দলবদ্ধ এই প্রাণীদের একেকটি দলে সচরাচর ২ থেকে ১৪টি প্রাণী থাকে। মুখপোড়া হনুমানসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী রক্ষায় আমরা সচেনতামূলক কার্যক্রম করে যাচ্ছি। কেউ বন্যপ্রাণী শিকার করলে আমরা তাকে আইনের আওতায় আনব।

বাংলাদেশের ১৯৭৪ ও ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে মুখপোড়া হনুমানকে সংরক্ষণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকিশোর অপরাধ রোধে সমন্বিত উদ্যোগের আহ্বান
পরবর্তী নিবন্ধআগামী নির্বাচনে সরকার গঠন করবে বিএনপি