নগরজুড়ে নিলামের সিএনজি

চলছে পুলিশের নাম ও মোবাইল নম্বর লাগিয়ে

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:২৮ পূর্বাহ্ণ

মোটর যান অধ্যাদেশ অনুযায়ী বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) থেকে নিবন্ধন ব্যতিরেকে কোন ধরনের যানবাহন সড়কে চলাচল করতে পারে না। কিন্তু সরকারি আদেশ অমান্য করে নগরীতে চলছে নিলামের অসংখ্য সিএনজি অটোরিক্সা। নগরীতে কর্মরত ট্রাফিক সার্জেন্টরাই এসব গাড়ি নিজের নামে চালান। গাড়িতে সাঁটিয়ে দেয়া হয় সার্জেন্টদের মোবাইল নাম্বারও। দৈনিক আজাদীর অনুসন্ধানে এ ধরনের অসংখ্য গাড়ির খোঁজ মিলেছে। কিছু নিজেরা কিনে আবার টোকেনের মাধ্যমে মাসোহারা নিয়ে এসব গাড়ি রাস্তায় চলাচলের সুযোগ করে দেন ট্রাফিক সার্জেন্টরা। কেউ রাস্তায় ধরলে চালক সংশ্লিষ্ট সার্জেন্টকে ফোনে ধরিয়ে দিয়ে ছাড় পেয়ে যান।
২২ সেপ্টেম্বর নগরীর হালিশহর এক্সেস রোড, সড়কটি দিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটছে ‘নিলামকৃত সাধারণ ডায়েরী ১০৯৩’ লেখা একটি সিএনজি অটোরিক্সা। ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়লে চালককে জিজ্ঞেস করতেই লেমিনেটিং করা একটি ভিজিটিং কার্ড দেখান। যাতে লেখা আছে, ইফতিখান, সার্জেন্ট অব বাংলাদেশ পুলিশ, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ, চট্টগ্রাম। চালক বলেন, ‘সার্জেন্ট ইফতি সাহেবের গাড়ি এটি। গাড়িটিতে করে তার বাচ্চা স্কুলে যায়। এরপর রাস্তায় দুয়েকটি ভাড়া মারি।’ চালকের দেয়া ভিজিটিং কার্ডের দুইটি ফোন নাম্বারে ফোন করা হলে একটি বন্ধ পাওয়া গেছে, অন্যটিতে রিং হলেও তিনি রিসিভ করেননি।’
২০ সেপ্টেম্বর নগরীর চেরাগী পাহাড় মোড়। ‘কোর্ট নিলাম ৮৫২’ লেখা একটি সিএনজি অটোরিকশার চালক বলেন, এটি সার্জেন্ট সাজিদুলের নামে চলে। ১২ সেপ্টেম্বর মোমিন রোড এলাকায় যাত্রী নিচ্ছিল ‘ কোর্ট হইতে নিলামকৃত, মামলা নং ১৬(৪)০৯, জিআর ৩৩৩/০৯’ লেখা সিএনজি অটোরিকশাটি। এসময় চালক বলেন, গাড়িটি আমার। সার্জেন্ট সাইফুলের নামে চলে এটি। তবে তিনি সার্জেন্টের মোবাইল নাম্বার দেননি।
৯ সেপ্টেম্বর নগরীর মোমিন রোডে দেখা হয় আরেকটি নিলাম সিএনজির। গাড়ির সামনের অংশে ‘নিলামে ক্রয়কৃত ডাইরী নং-৭১৪, সিএমআর ২৩৮’ লেখা রয়েছে। গাড়িটির একপাশে লেখা রয়েছে গৌবিন্দ নামের এক সার্জেন্টের মোবাইল নাম্বার। এ বিষয়ে সার্জেন্ট গৌবিন্দের কাছে গত শনিবার রাতে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার একটি নিলামের গাড়ি ছিল। এটি ৬ মাস আগে বিক্রি করে দিয়েছি। এখন গাড়িটি কোথায় জানি না।’
একইভাবে নগরীর চৌমুহনী এলাকায় দেখা যায় ‘নিলামকৃত গাড়ি জিডি নং ১০৮৪’ লেখা একটি সিএনজি অটোরিকশা। গাড়ির গায়ে লেখা রয়েছে মোজাহিদুল ইসলাম নামের একজনের নাম্বার। ওই মোবাইল নাম্বারে ফোন করে সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
টাইগার পাস মোড়ে দেখা মেলে নিলয় মিথিলা পরিবহন নামের একটি সিএনজি অটোরিকশা। সেটিতে লেখা রয়েছে, ‘কোর্ট হইতে নিলামকৃত জিডি নং-১০২০, পিআর নং-৩৭/১৬, তাং-০৩/০২/১৬ইং’। গাড়িতে লেখা রয়েছে সার্জেন্টের একটি মোবাইল নম্বার। শনিবার রাতে রুহুল আমিন নামের ট্রাফিকের ওই সার্জেন্ট দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘আমি তিন বছর আগে গাড়িটি কিনেছিলাম। পরে সমালোচনা হচ্ছে জেনে বিক্রি করে দিয়েছি।’ তিনি বলেন, আমরাতো নিলামে অংশ নিতে পারি না। একজনের কাছ থেকে কিনেছিলাম। গাড়িতে আদালতের কাগজ থাকে। তবে নিলামে কেনা হলেও অনিবন্ধিত গাড়ি রাস্তায় চলাচল করতে পারে না বলে জানান এই ট্রাফিক কর্মকর্তা।
একইভাবে নগরীর আকবর শাহ ও চৌমুহনী এলাকায় দেখা যায়, ‘নিলামে ক্রয়কৃত সিএমআর নং ১৯৫৮/১১’ এবং ‘ কোর্ট হইতে নিলামকৃত সিএমআর নং- ১৩৪৩-১২, জিডি নং-৭৪৭’ লেখা দুইটি সিএনজি অটোরিকশা। এসব সিএনজিতে সার্জেন্ট নাঈমুল ইসলাম (নাঈম) লেখা রয়েছে। গাড়িতে লেখা মোবাইল নাম্বারে জানতে চাইলে সার্জেন্ট নাঈম গাড়ি দুটি তার স্বীকার করে শনিবার রাতে দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘২০১৮ সালে কিনেছিলাম। পরে বিভিন্ন স্থানে ধরাধরি হওয়ায় একটি গাড়ি আমি বিক্রি করে দিয়েছি। আরেকটি গাড়ির চালক খুবই গরীব। তার অনুরোধের কারণে সেটি বিক্রি করিনি। ওটি পটিয়ার শান্তিরহাট এলাকায় চলাচল করে।’
একইভাবে আন্দরকিল্লা মোড়ে দেখা যায়, ‘মামলা ৩/১/১৩, জিআর ১৮৪/১৩’ লেখা একটি সিএনজি অটোরিঙা। চালকের কাছে জানতে চাইলে তিনি একটি ভিজিডিং কার্ড দেখান। ভিজিটিং কার্ডে সার্জেন্ট শাহেদুল ইসলামের মোবাইলে ফোন করা হলেও দুই মোবাইল নাম্বারই বন্ধ পাওয়া গেছে।
অন্যদিকে দেওয়ান হাট এলাকায় একটি সিএনজি অটোরিঙায় দেখা গেছে, ‘নিলামে ক্রয় ১০/০৯/১৫ইং জিডি নং-৭৪৫’। গাড়িতে লেখা মো. আলমগীর নামের ওই ব্যক্তিকে ফোন করা হলে তিনি সদরঘাট ট্রাফিক অফিসের সিভিল স্টাফ বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘আমি এখানে (সদরঘাট ট্রাফিক অফিস) ৭,৮ তারিখ পর্যন্ত আছি। আমি গাড়িটি বিক্রি করে দিব।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীতে চলাচলকারী নিলাম লেখা সিএনজি অটোরিঙাগুলোর বেশিরভাগ মালিক ট্রাফিকের সার্জেন্ট। বিভিন্ন মামলায় দীর্ঘদিন থানায় আলামত হিসেবে পড়ে থাকার এক পর্যায়ে আদালতের নির্দেশে সংশ্লিষ্ট থানা কর্তৃপক্ষ এসব অটোরিঙা নিলাম আহবান করলে সার্জেন্টরাই এসব গাড়ি কমদামে কিনে নেয়। পরে নিজের নামে রাস্তায় ছেড়ে দেন। আবার প্রভাবশালী অনেকে নিলামে এসব গাড়ি কিনে ট্রাফিক সার্জেন্ট থেকে টোকেন নিয়ে রাস্তায় এসব গাড়ি ভাড়ায় দেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) শ্যামল কুমার নাথ শনিবার রাতে দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘ কোন সার্জেন্টের নামে অবৈধভাবে কোন গাড়ি রাস্তায় চালানোর সুযোগ নেই। আমরা এ বিষয়ে অভিযোগ কিংবা তালিকা পেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া হবে।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিএনপির জনসমর্থনে সরকারের হৃৎকম্প শুরু হয়েছে : ফখরুল
পরবর্তী নিবন্ধএলজিইডি প্রকৌশলীদের বসুন্ধরা বিটুমিন প্ল্যান্ট পরিদর্শন