পানি আছে। নদ–নদী, খাল–বিল, পুকুর–জলাশয়ও আছে। পাইপলাইনে চট্টগ্রাম ওয়াসার সরবরাহকৃত পানিও আছে নগর জুড়ে। আছে গভীর–অগভীর নলকূপও। এর মাঝেও বড় সংকট সুপেয় পানির। পানীয়জল বলে সহজে চেনা খাওয়ার পানির দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় চট্টগ্রাম নগরীর বসবাসরত ৭০ লাখ মানুষকে। ঘরে–বাইরে পানির জন্য রীতিমতো লড়াই করতে হয় প্রতিনিয়ত।
প্রতি বছরের মতো চলতি বছরও শুষ্ক মৌসুমে যখন পানীয় জলের চাহিদা বেড়েছে, ঠিক তখনই ওয়াসার সবগুলো প্রকল্পের পানির উৎসস্থল কর্ণফুলী ও হালদা নদীর পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে গেছে সীমাহীন। যা মানব দেহের সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৭–৮ গুণের বেশি।
যার কারণে চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি উৎপাদন এখন দৈনিক ৭ থেকে ৮ কোটি লিটার কমে গেছে। এর ফলে নগরীর বিশাল এলাকা জুড়ে পবিত্র এই রমজানে দিনের পর দিন পানির সংকট দেখা দিয়েছে। সেই সাথে ওয়াসার সরবরাহ করা পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ মানব দেহের সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৭ থেকে ৮ গুণ বেশি হওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে নগরবাসী। এটি মানব দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই ব্যাপারে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবদুর রব আজাদীকে বলেন, অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি খেলে কিডনি বিকল ও রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে। এছাড়া শরীরে ইলেক্ট্রোলাইটসের ভারসাম্য রক্ষা হবে না। বিশেষ করে রক্তে সোডিয়ামের মাত্রা বেড়ে গিয়ে নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হবে বলে জানান তিনি।
পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা হলে তারা বলেন, শিল্প কারখানার দূষিত তরলবর্জ্য, পয়োঃবর্জ্য ও গৃহস্থালি বর্জ্যে কর্ণফুলী–হালদাসহ চট্টগ্রামের খাল–নদী–নালাসহ প্রাকৃতিক জলাশয়ের পানি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এছাড়া দিন দিন ভূ–গর্ভস্থ পানির স্তর নিচের দিকে নেমে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির সংকট বাড়ছে।
চট্টগ্রাম নগরীর পানির একমাত্র উৎস হচ্ছে হালদা ও কর্ণফুলী নদী। এই কর্ণফুলী নদীর উভয় পাশে গড়ে উঠেছে শত শত শিল্প কারখানা। এসব শিল্পকারখানার রাসায়নিক বর্জ্যে এবং গৃহস্থালি বর্জ্যে প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে কর্ণফুলী ও হালদার পানি। এসব বর্জ্য এই দুটি নদীতে সরাসরি এবং শাখা খালগুলোর মধ্যদিয়ে এসে পড়ছে। এর ফলে বিশেষ করে কর্ণফুলী নদীর পানি বিপজ্জনকভাবে দূষিত হচ্ছে। আর কর্ণফুলীর পানি এস মিশছে হালদায়। ফলে প্রাকৃতিক জলাশয়ের পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।
উদ্বেগজনক ভাবে বেড়েছে ওয়াসার পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ : হালদা ও কর্ণফুলী নদীর পানিতে উদ্বেগজনক ভাবে বেড়েছে লবণাক্ততার পরিমাণ। চট্টগ্রাম ওয়াসা চট্টগ্রাম মহানগরীর জন্য হালদা ও কর্ণফুলী থেকে তাদের ৪টি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রতিদিন ৪৬ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করে। বর্তমানে হালদা ও কর্ণফুলীর পানিতে প্রতি লিটারে সর্বোচ্চ ২ হাজার ১০০ মিলিগ্রাম থেকে ২ হাজার ৩০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত লবণাক্ততা দেখা যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞ এবং চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্মকর্তারা জানান, মানব শরীরের জন্য প্রতি লিটার পানিতে লবণাক্ততার সহনীয় মাত্রা হল ২৫০ মিলিগ্রাম। অথচ বতর্মানে জোয়োরের সময় কর্ণফুলী ও হালাদার প্রতি লিটার পানিতে রেকর্ড ২১শ’ থেকে ২৩শ’ মিলিগ্রাম লবণ পাওয়া যাচ্ছে। যা মানব শরীরের সহনীয় পর্যায়ের চেয়ে সাড়ে ৮ গুণ বেশি।
ওয়াসার তথ্য মতে, গতকাল চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রতি লিটার পানিতে ২ হাজার ১০০ মিলিগ্রাম লবণ পাওয়া গেছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বরের শেষ দিক থেকে কর্ণফুলী ও হালদা নদীর পানিতে লবণের মাত্রা পরিলক্ষিত হয়। গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রায় ইউনিট বন্ধ করে রাখার ফলে কাপ্তাই লেক থেকে হালদায় পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় জোয়ারের সময় কর্ণফুলীর লবণাক্ত পানি হালদায় প্রবেশের মাত্রা বেড়ে যায়। এখন মার্চ মাসে এসে লবণাক্ততা আরও অতিমাত্রায় পৌঁছেছে। এই কারণে জোয়ারের সময় ওয়াসার প্লান্টগুলো বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রকৌশলীদের সাথে কথা হলে তারা জানান, শুষ্ক মৌসুমে হালদা নদীতে কাপ্তাই লেকের পানি প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে জোয়ারের সময় কর্ণফুলীর লবণাক্ত পানি হালদা নদীতে প্রবেশ করছে। যার কারণে চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি উৎপাদন এখন দৈনিক ৭ থেকে ৮ কোটি লিটার কমে গেছে। বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত হালদায় লবণাক্ততার পরিমাণ কমার সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন ওয়াসার প্রকৌশলীরা।
এদিকে নগরীর দক্ষিণ কাট্টলী, হালিশহর, পাঠানটুলী, মোগলটুলী, ধলিয়ালা পাড়া, রঙ্গিপাড়াসহ বিশাল একটি অংশে পবিত্র এই রমজানে দিনের পর দিন–পানির সংকট দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে এসব এলাকার লোকজন ওয়াসা কার্যালয় ঘেরাও সহ বিক্ষোভ করেছেন।
ভূ–গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে চলে যাওয়ায় সুপেয় পানির জন্য সারা বছরই অস্থির থাকতে হয় চট্টগ্রাম ও তিন পার্বত্য জেলার মানুষকে। অন্যদিকে ভরা বর্ষায় বিপদ হয়ে আসে বন্যা–জলোচ্ছ্বাসের দূষিত পানি। দুই মৌসুমেই নিরাপদ পানির জন্য থাকতে হয় উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তায়।
সুপেয় পানির যতটুকু জোগান মেলে, তার বিনিময় মূল্য সংস্থানেও দেশের বড় জনগোষ্ঠীকে উৎকণ্ঠায় থাকতে হয়। শহরে কেনা ফিল্টারড বা বোতলের পানিও কতটা নিরাপদ, তা নিয়েও মাঝেমধ্যেই প্রশ্ন ওঠে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহকৃত পানি সরাসরি পান করা গেলেও বাংলাদেশে সরবরাহকৃত পানি না ফুটিয়ে বা ফিল্টারে না দিয়ে কেউ পান করতে সাহস পান না। খাবার ও অন্যান্য পণ্যের মতোই সুপেয় পানির খরচ মেটানো কঠিন হয়ে পড়ে অনেকের জন্য। ব্যয়বহুল ফিল্টার কেনাও সবার পক্ষে সম্ভব নয়। এমন পরিস্থিতিতে আজ শনিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব পানি দিবস।