বাংলাদেশের সংগীত ভুবনে উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের নাম : নকীব খান। সেই ১৯৭৩ সালে স্কুলে পড়াকালীন বালকবেলার সময় থেকে গানের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন। সেই থেকে আজ অবধি আছেন সুরের সাথে। নিজেকে গড়েছেন একজন বাদ্য যন্ত্রশিল্পী, সুরকার ও কণ্ঠ শিল্পী হিসেবে। সুদীর্ঘ ৫০টি বছর সংগীতের ভুবনে বিচরণ করার যে গৌরবময় ইতিহাস গড়লেন, তা অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
টেলিভিশন জার্নালিস্ট ফোরাম অফ বাংলাদেশ গত ২৩ আগস্ট ২০২৫ তারিখে ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল–এর ক্রিস্টাল বলরুমে আয়োজন করেছিল Naquib Khan : 50 th Anniversary in Music. বর্ণাঢ্য এই আয়োজনে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দেশের বরেণ্য সংগীত শিল্পীবৃন্দ।
নকীব খানের বড় ভাই বরেণ্য সুরকার
জালালউদ্দিন খান, যিনি সংগীত জগতে জিলু খান নামেই পরিচিত। তিনি যখন বলেন, “নকীব আমার চাইতে দশ বছরের ছোট। সে যখন কান্না করতো, তার কান্না থামাতে আব্বাকে বলে হারমোনিয়াম আনার ব্যবস্থা করি। আমি হারমোনিয়াম বাজানোর পর আশ্চর্যজনক ভাবে নকীবের কান্না থেমে যেত। সুরের সাথে তার নৈকট্য কিন্তু আরও আগে থেকেই। আজ নকীব সু্খ্যাতি অর্জন করেছে। এটা আমাদের সকলের জন্য আনন্দের,গৌরবের। তার জন্য আপনারা দোয়া করবেন। “বড় ভাই হিসেবে অনুষ্ঠান মঞ্চে দাঁড়িয়ে এমন সুন্দর অনুভূতি প্রকাশ, নিঃসন্দেহে গৌরবের। ইতিপূর্বে এমনটি হয়েছে কিনা জানা নেই।
নকীব খান যে কত বড় মাপের শিল্পী বাংলাদেশের সংগীত ভুবনে, তার সংক্ষিপ্ত চিত্র মঞ্চে উপস্থাপন করেছেন এদেশেরই বরেণ্য সংগীত শিল্পীরা। সৈয়দ আবদুল হাদী বলেছেন: “নকীব নামের বৃক্ষটি আমাদের যে ফল দিয়ে এসেছে, তাতে এদেশের মানুষ আপ্লুত। তাকে আমরা সবসময়ই মনে রাখবো।”
গুণী সংগীত শিল্পী রফিকুল আলম তার অনুভূতি প্রকাশ করলেন এই বলে: “নকীব খানের সংগীত জীবনের পঞ্চাশ বছর বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে চার/ পাঁচটি সেমিনার আয়োজন করেও শেষ হবে না। সংগীতের জগতে তিনি বহু পরিচয়ের মানুষ। চাকরি করে এতকিছু সামাল দেওয়া শুধু তার পক্ষেই সম্ভব।”
জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী খুরশিদ আলম বললেন: “সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী নকীব খান বাংলাদেশের সংগীত জগতে প্রতিষ্ঠিত। তার মতো এত ভদ্র ও সজ্জন মানুষ আমি আর দেখিনি।”
সত্তর দশকের ব্যান্ড সংগীতের কিংবদন্তি শিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদ। তিনি বলেন, “নকীব সুরকে ভালোবাসে। সুরের মাধুর্যকে ভালোবাসে। সুরের মেলোডি নিয়ে দারুণ কাজ করে। যেজন্য নকীবের গান আমার পছন্দ। একদিন বিমানবন্দরে নকীবের সাথে দেখা। দেখেই কাছে এসে জড়িয়ে ধরে কুশালদি জানতে চাইলো। আমাকে নকীব যে সম্মান দিয়েছে, তা আমি কল্পনা করিনি। আচরণ, ব্যবহার, ভালোবাসা, অন্যকে সম্মান দেখানো–এই গুণগুলো নকীবের আছে। আজ নকীব যে অবস্থানে পৌঁছেছে, তাতে আমি আপ্লুত।”
আরও যারা শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, তারা হলেন সাবেক তথ্য সচিব সৈয়দ মারগুব মোর্শেদ, গীতিকবি শহীদ মাহমুদ জঙ্গী, সুরকার ফোয়াদ নাসের বাবু, পার্থ বড়ুয়া, বাপ্পা মজুমদার, গীতিকবি ডাঃ মোহাম্মদ আরিফ, রবি চৌধুরী, গীতিকবি সংঘের সভাপতি আসিফ ইকবালসহ সংগীতের সাথে যুক্ত শিল্পী ও সাংবাদিকবৃন্দ।
নকীব খান মানেই অসাধারণ বাংলা মেলোডি গানের সমাহার। অনুষ্ঠানের শুরুতেই বাপ্পা মজুমদারকে সাথে নিয়ে গাইলেন গীতিকবি খালিদ আহসানের লেখা ও নিজের সুর করা এবং রেনেসাঁ ব্যান্ডের গান “রানওয়ের মাটি ছুঁয়ে”। পরে একে একে তিনি গাইলেন জনপ্রিয় সব গান। বিভিন্ন সময়ে তার সাথে গাইলেন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পীরা।
নকীব খানের গান মানেই : মন শুধু মন ছুঁয়েছে। কালজয়ী এই গানটি একসাথেই গাইলেন পার্থ বড়ুয়ার নেতৃত্বে সোলস। হলভর্তি দর্শকের তুমুল করতালি স্মরণ করিয়ে দিল, গানটি আজও সমান জনপ্রিয়। কয়েক প্রজন্ম ধরে রেখেছে গানটি। তারুণ্যের গান হিসাবে আরেকটি গান জনপ্রিয়… এই মুখরিত জীবনের চলার বাঁকে। উপস্থিত সকল শিল্পীর পরিবেশনায় এই গানটি পরিবেশনের মাধ্যমে জমজমাট সাড়ে তিন ঘন্টার অনুষ্ঠানের সমাপন হলো।
টেলিভিশন জার্নালিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশের সভাপতি রেদোয়ান খন্দকার বললেন: আমাদের সংস্কৃতি হয়ে গেছে মরণোত্তর পুরস্কার বা সম্মাননা দেওয়া। তা থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে। আজ আমরা নকীব খানের মতো বাংলা আধুনিক ও ব্যান্ড মিউজিকের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী নকীব খানের সংগীতের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে সম্মাননা অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পেরে আনন্দিত।”
যাঁর গানে আমরা আজও মুগ্ধ, যাঁর সুর আজও আমাদের আন্দোলিত করে, সেই নকীব খান নিজের অনুভূতি প্রকাশ করলেন এই বলে: “পঞ্চাশ বছর ধরে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেওয়া অনেক বড় বিষয়। গান দিয়েই আমি সেই জায়গা পেয়েছি। এই দীর্ঘ সময় টিকে থাকা অনেক বড় ব্যাপার। মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই। আপনাদের ভালোবাসায় মুগ্ধ। অভিভূত। এটা যেন আমার জন্য গর্বের বিষয় না হয়ে যায়। আমি যেন সংগীতে আরও কিছু করতে পারি। আমি এখনো শিখছি। চেষ্টা করছি।”
সব বয়সীদের কাছে জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী নকীব খান। কেন–তা এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে জানতে পারলাম। যেসব সংগীতজ্ঞ ব্যক্তিরা তাদের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন, আবার তরুণ প্রজন্মের শিল্পীরাও যেভাবে সম্মান জানিয়ে গেল, তাতে অনুমেয়–নকীব খান বাংলাদেশের সংগীত ভুবনে উজ্জ্বল তারকা। উপস্থিত সকলেই আরও পঞ্চাশ বছর সংগীতের সাথে নকীব ভাইয়ের যুক্ত থাকার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
পুনশ্চঃ
অনুষ্ঠান শেষে শ্রদ্ধেয় নকীব ভাইয়ের সাথে ফিরছি। এত দীর্ঘ সময় অনুষ্ঠানের পর স্বাভাবিকভাবেই ক্লান্ত হওয়ার কথা। কিন্তু নকীব ভাইকে দেখলাম আরও উজ্জীবিত। উচ্ছল। বললেন: “জিলু ভাই এই অনুষ্ঠানে এসেছেন, এটা আমার জন্য পরম পাওয়া। যার হাত ধরে আমার গানের জগতে আসা। তার জন্যই আজ আমার এই সম্মাননা।” এমন বিনয়ী আচরণ এবং কৃতজ্ঞতা বোধের কারণেই নকীব খানের খ্যাতি, সম্মান দেশজুড়ে। তার সংগীত ভুবন আরও সমৃদ্ধ হোক, এই প্রার্থনা করি মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে।