নকশীকাঁথা : বাঙালির আত্মিক ঐতিহ্য

কুমুদিনী কলি | সোমবার , ২২ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৬:০২ পূর্বাহ্ণ

বাঙালির গ্রামীণ জীবন এক অনাড়ম্বর অথচ গভীর সৌন্দর্যমণ্ডিত অধ্যায়। মাটির ঘ্রাণ, মাঠের সবুজ, নদীর দোলা আর মানুষের সহজসরল জীবনযাত্রা মিলেই গড়ে ওঠে তার স্বকীয় পরিচয়। এই পরিচয়ের অন্যতম প্রতীক হলো নকশীকাঁথা!

এক টুকরো কাপড়, অথচ তার ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকে শত বছরের স্মৃতি, সুখদুঃখ, প্রেমবিরহ, আর শিল্পীসত্তার নিঃশব্দ আর্তি। নকশীকাঁথা শুধু ব্যবহারিক উপকরণ নয়; এটি বাঙালির মর্মসত্তার শিল্পীত দলিল, যা সময়কে ধরে রাখে, ইতিহাসকে বুনে চলে, আর অনুভূতিকে রঙিন করে তুলে। শুধুমাত্র অন্তঃপুরবাসিনীর হস্তশিল্প হয়েই নয়, নকশীকাঁথা স্থান করে নিয়েছে বাংলা সাহিত্যের বিস্তৃত ভুবনে, সে ভুবন নকশীকাঁথায় মুড়িয়ে নিয়েছেন স্বয়ং পল্লী কবি জসীমউদদীন।

তাঁর ‘নকশীকাঁথার মাঠ’ প্রেম, প্রকৃতি, বিচ্ছেদ আর অপেক্ষার এক সকরুণ মর্মগাথা হিসেবে যুগের পর যুগ ধরে সমাদৃত। তাই নকশীকাঁথার উষ্ণতা ছড়িয়ে গেছে সমগ্র বাংলা সাহিত্যে।

গ্রীষ্মের নিখাদ দুপুরে, অথবা, পড়ন্ত বিকেলের শীতল দখিনা বাতাসে সামান্য অবকাশে। নতুবা,বর্ষার জল থইথই সময়েনয়তো, শীতের মিঠে রোদ গায়ে লাগানোর অজুহাতে হাতে সুঁই সুতা আর কাঁপড়ের বুক চিড়ে ফুটিয়ে তোলা নানা অনুষঙ্গে শিল্পের নান্দনিক প্রকাশ।

ঘরের কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিতান্ত প্রয়োজনীয় এই জিনিসটি অনেকটা প্রয়োজনের তাগিদেই তৈরী করতেন গ্রামের নারীরা। পুরোনো আটপৌরে কাপড় দিয়ে, পুরোনো কাপড়ের পাড় থেকে সুতা নিয়ে সেলাই করা হতো কাঁথা। কালক্রমে তাতে নান্দনিক ভাবনার মিশেল ঘটে, তৈরী হতে থাকে দৃষ্টিনন্দন এক অভিনব প্রয়াস। একরঙা ধুতি কাপড় অথবা থান কাপড় জোড়া লাগিয়ে তৈরী করা কাঁথায় নানা রকম নকশা সেলাই করে তৈরী হতে থাকে নকশীকাঁথা। নকশীকাঁথা মূলত যিনি সেলাই করেন, তাতে তিনি তার মন মতো নকশার কাজ করে থাকেন। এজন্য নকশীকাঁথা সেলাইকারীর মন ও মননের এক অনন্য নিদর্শন হয়ে ওঠে নকশীকাঁথা। একেকজন একেকরকম ভাবনার চিত্র ফুটিয়ে তোলেন তাঁর শিল্পকর্মে। তাই নকশীকাঁথার নকশাতে থাকে নানা বৈচিত্র্য। নানা রকম নকশা নানা রকম ফোঁড়ের মাধ্যমে কাঁথার শরীরে ফুটে ওঠে। কাঁথা যেনো তখন প্রাণ পায়।

সারাদিন ঘরের নানা কাজের ফাঁকে সামান্য অবসরটুকুতে একটু একটু করে তৈরী হয় নকশীকাঁথা। আর তাতে প্রতি ফোঁড়ে জুড়ে যায় সেই নারীর মনের আকুতি, বাসনা, অভিব্যক্তি। নকশীকাঁথা নারী হৃদয়ের গহীনে লুকায়িত আবেগ অনুভূতির একটি সাজানো ডালি। কাঁথাকে যদি মানবজীবনের সাথে তুলনা করা হয়, তবে তার প্রতিটি ফোঁড় হলো জীবনের নানা ঘটনাবলী আর নকশাগুলো হলো ঘটনাবলীর মিলিত প্রয়াস,যা জীবনকে অর্থবহ করে গড়ে তোলে।

সমকালীন সমস্ত কিছু নকশীকাঁথায় ফুটিয়ে তুলতেন তখনকার নারীরা। আর এতে করে নকশীকাঁথা যেনো হয়ে উঠেছে সমসাময়িকতার প্রামাণ্য দলিল। আজও এত আধুনিক সময়ের তরঙ্গে ভেসে ভেসেও নকশীকাঁথার আবেগ, তা নিয়ে মানুষের অভিনব অনুভূতি এতটুকু ম্লান হয়নি। বরং কালক্রমে তা আরও নতুন, আরও আকর্ষণীয়, আরো দৃষ্টিধন্য হয়ে উঠেছে।

গ্রামীণ জীবনে নকশীকাঁথা আজও এক অদ্ভুত নিবিড়তার নাম, এক অনন্য অনুভূতি, এক অন্তঃপুরবাসিনীর নীরব নিঃশ্বাসের প্রতিরূপ। বাংলার চিরায়ত লোকাচারেও নকশীকাঁথা এক অনন্য নিদর্শন। মেয়ের বিয়ের সময় নতুন জামাইকে নকশীকাঁথা উপহার দেয়া হয়। একজন মায়ের আশীর্বাদ, শুভকামনা ও মেয়ে জামাইকে নিয়ে থাকা নানা স্বপ্নের বীজ লুকায়িত থাকে সেলাই করা নকশীকাঁথাতে। আর নব বিবাহিত মেয়ে শ্বশুরালয়ে যাবার সময় নিয়ে যায় সাথে করে মায়ের হাতের তৈরী এক পরম আশ্রয়, যা দেখলেই মায়ের মুখ ভেসে ওঠে। এছাড়াও ঘরে নতুন কোনো শিশু সন্তানের শুভাগমন ঘটলেও তাকে নকশীকাঁথা দেয়া হয়। তার জন্মের আগে থেকেই একটু একটু করে তৈরী করা নকশীকাঁথায় মিশে থাকে নতুন সন্তানের জন্য এক পৃথিবী ভালোবাসা।

নকশীকাঁথা মূলত এক লঘুভার শিল্প, যেখানে বাড়তি সাজ নেই, কোনো অহংকার নেই। আছে শুধু সহজ সরল সেলাই। লতাপাতার আঁকিবুঁকি, মাছ পাখির জীবন্ত রেখা,সহজ সরল অনাড়ম্বর গ্রামীণ জীবন সবই নকশীকাঁথায় ধরা পড়ে।

তবু এই ঐতিহ্য আজ বহুমাত্রিক সংকটে। সময়ের গতি পাল্টেছে, গ্রাম থেকে শহরে মানুষের ঢল বেড়েছে, আর প্রযুক্তি জীবনের তাললয়কে দ্রুত বদলে দিয়েছে। হাতেসেলাই করা কাঁথা তৈরিতে ধৈর্য্য ও দীর্ঘ শ্রম প্রয়োজন, যা আজকের ব্যস্ত জীবনযাপনের সঙ্গে বেমানান হয়ে উঠছে। বাজারে সহজলভ্য মেশিনস্টিচের কাঁথা বা শিল্পজাত বেডকভার তাই ক্রমে স্থান দখল করছে ঐতিহ্যবাহী নকশি কাঁথার জায়গা। বহু গ্রামীণ নারী যাদের হাতে কাঁথা তৈরির দক্ষতা ছিল, তারা এখন অন্য পেশায় নিয়োজিত কিংবা আর্থিক অনিশ্চয়তায় পড়ে এই শিল্পচর্চা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে নকশি কাঁথা আজ অতীতের অমূল্য উত্তরাধিকার হলেও, সমকালীন জীবনে তার অবস্থান দোদুল্যমান এ যেন কোনও পুরোনো দিনের অথচ অবিনশ্বর সুর, যা শোনা যায় ক্ষীণস্বরে। তবে অন্ধকারের গায়ে আলো এখনও জ্বলে। বিভিন্ন কারুশিল্পসংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ও সংস্কৃতিগবেষকের উদ্যোগে নকশি কাঁথা নতুনভাবে ফিরে আসছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নারীদের সংগঠিত করে তাদের দক্ষতাকে পুনরুজ্জীবিত করা হচ্ছে; বাজারজাতকরণ হচ্ছে আরও আধুনিক শৈলীতে; আর আন্তর্জাতিক হস্তশিল্পমেলায় নকশি কাঁথা আবার স্বীকৃতি পাচ্ছে বাংলাদেশের নিজস্ব শিল্পরূপ হিসেবে। একই সঙ্গে ডিজিটাল নথিভুক্তির মাধ্যমে পুরোনো কাঁথার নকশা, রঙ, নির্মাণপদ্ধতি সংরক্ষণ করা হচ্ছে যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারে, সূঁচের সরু ফোঁড় কীভাবে একটি জাতির অনুভূতিময় ইতিহাস রচনা করতে পারে। নকশি কাঁথা আমাদের শেখায় শিল্প কখনো জাঁকজমকে নির্ভর করে না।

নকশীকাঁথা এক অনন্য ও ভালোবাসার নিদর্শন হয়ে আজও তাই ঘরে ঘরে মূল্যবান সম্পদ হিসেবে সংরক্ষিত হয়। বছরের পর বছর ধরে লালিত হতে থাকা এ যেনো এক আবেগের নাম।

এমন আবেগ, যাতে মিশে আছে গ্রাম বাংলার চিরায়ত লোকাচার, ঐতিহ্য। নকশীকাঁথার হাত ধরে নতুন প্রজন্ম একটি সমৃদ্ধ অতীত নিয়ে জানে, ভাবতে বাধ্য হয় আগের প্রজন্মের লালিত করা সৃষ্টিশীলতাকে নিয়ে। নকশীকাঁথার উষ্ণতায় তাই মিশে থাকে নরম ও আদুরে ভালোবাসাময় স্পর্শ, যাতে পৃথিবীর সমস্ত জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনও হার মানতে বাধ্য হয়। এটি শুধু একটি হস্তশিল্প নয়! এটি বাঙালির আত্মিক ঐতিহ্য, চিরন্তন মমতার প্রতীক এবং অনন্য ভালোবাসার অবিনশ্বর নিদর্শন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সংস্কৃতিকর্মী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবরেণ্য শিক্ষক প্রফেসর শায়েস্তা খানের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি
পরবর্তী নিবন্ধমধ্যযুগের মহাকবি আলাওল