নকল-ভেজালের ভিড়ে আসল চেনা দায়, জনস্বাস্থ্য হুমকিতে

প্রয়োজন কঠোর আইন ও তার যথাযথ প্রয়োগ

ঋত্বিক নয়ন | সোমবার , ২৫ মার্চ, ২০২৪ at ১০:০৮ পূর্বাহ্ণ

নকলভেজালমেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যসামগ্রীতে ছেয়ে গেছে দেশ। ‘নকল হইতে সাবধান’ এই বিজ্ঞাপন এতটাই প্রচলিত যে, কেউ আর ‘সাবধান বাণী’ হিসেবে এ কথাটি মানতে চায় না। শিক্ষিতঅশিক্ষিত সকলের জন্যই সমান প্রযোজ্য। ভেজালের এ সাম্রাজ্যে সবই আছে, শুধু ‘আসলটাই’ উধাও। ভেজাল খাবার খেয়ে আমরা জাতিকে ক্রমাগত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছি, নতুন প্রজন্মকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছি। কখনো ভিন্ন ভিন্ন আবার কখনো একত্রে খাদ্যে ভেজাল রোধে অভিযান চালায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই), ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ও বাংলাদেশ পুলিশ। তবে অভিযোগ রয়েছে, ভেজালকারীদের দৌরাত্ম্যের তুলনায় অভিযান যথেষ্ট অপ্রতুল।

ভেজাল খাদ্যপণ্যে সয়লাব হয়ে পড়ছে শহরবন্দরজনপদ। খোলাবাজার, হোটেলরেস্তোরাঁ, ফাস্টফুড থেকে শুরু করে চায়নিজ রেস্টুরেন্ট, কনফেকশনারি, ক্যান্টিন, এমনকি মুদি দোকান পর্যন্ত বিস্তৃতি ঘটেছে নকলের। কোথায় নেই ভেজাল? হাত বাড়িয়ে যা কিছু খাচ্ছি সবকিছুতেই ভেজাল। বাজারে এমন কিছু নেই, যা নকল কিংবা ভেজাল হচ্ছে না। পণ্য ভেরিফিকেশনের জন্য হলোগ্রাম, স্টিকার, স্ক্যানার, আরএফআইডি ট্যাগ, বারকোড ইত্যাদি সিস্টেম চালু আছে। কিন্তু সেসব হলোগ্রাম বা স্টিকারগুলোও যখন নকল করা হয় তখন গ্রাহক কোনোভাবেই আর আসলনকল আলাদা করতে পারেন না। নকলের ভিড়ে আসল চেনা দায়। দিন দিন বিস্মৃত হচ্ছে ভেজালের গণ্ডি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইফতারের অপরিহার্য পাঁচটি সামগ্রী হলো মুড়ি, ছোলা, পেঁয়াজু, বেগুণী ও জিলাপী। তার প্রতিটি তৈরিতেই ভেজাল মিশে নানা ভাবে। মুড়ি ছাড়া ইফতার কল্পনা করা যায় না। সেই মুড়ি আকারে বড় ও সাদা করতে ব্যবহৃত হচ্ছে ট্যানারির বিষাক্ত রাসায়নিক সোডিয়াম হাইড্রো সালফাইড। অথচ এ রাসায়নিক পদার্থটি কাপড়ের মিলে সাদা রং করতে ব্যবহৃত হয়। ক্রেতাদের আকর্ষণে ভেজাল এ মুড়িই বাজারে বিক্রি করছে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী। চাল সাদা করার জন্য ধান সেদ্ধ করার সময় মেশানো হচ্ছে ইউরিয়া সার। এই মুড়ি খেলে ডায়রিয়া, আমাশয় থেকে শুরু করে কিডনি বিকল, লিভার সিরোসিস এমনকি মরণঘাতি ক্যান্সারও হতে পারে। এছাড়া এ মুড়ি খেলে অসময়ে গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ জানিয়েছেন।

বেগুণী, পিঁয়াজু, চপ কিংবা জিলাপীতে ব্যবহৃত হচ্ছে কাপড়ে ব্যবহৃত রং বা টেক্সটাইল কালার। কম খরচে বেশি লাভের আশায় এক শ্রেণীর ইফতার বিক্রেতা কাপড়ে ব্যবহারের রং ইফতার সামগ্রীতে ব্যবহার করছে। কারণ হিসেবে জানা যায়, এক কেজি টেক্সটাইল কালারের বর্তমান বাজার মূল্য তিনশ টাকা। সেখানে এক কেজি ফুড কালারের মূল্য প্রায় দশ হাজার টাকা।

ইফতার সামগ্রী ভাজতে তেল বা ঘি ব্যবহৃত হয়। এখানেও ভেজালকারীদের হাত পড়েছে। গোল আলু, গমের সুজি, নারিকেলের তেল, পাম অলিভ দিয়ে তৈরি হচ্ছে ভেজাল সয়াবিন তেল। আবার সয়াবিন তেলের সাথে ইউরিক এসিড মিশিয়ে ঝাঁঝালো করে তৈরি হচ্ছে সরিষার তেল।

মিষ্টি জাতীয় দ্রব্য তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে ভেজাল চিনি। যার রাসায়নিক নাম সোডিয়াম সাইক্লামেট। মিষ্টি জাতীয় দ্রব্যকে অধিকতর মিষ্টি করতে ব্যবহৃত হচ্ছে স্যাকারিন, সুকরালেস ইত্যাদি। চিনির চেয়ে কয়েকশ গুণ বেশি মিষ্টি হওয়ায় রসগোল্লা, চমচম কিংবা জিলাপী তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে উল্লেখিত দ্রব্যাদি। মিষ্টিকে বিভিন্ন রং দিতে ব্যবহৃত হচ্ছে টেক্সটাইল কালার।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা: একিউএম সিরাজুল ইসলাম বলেন, পেঁয়াজু, বেগুণী কিংবা চপ ভাজতে ব্যবহৃত তেল একবারের বেশি ব্যবহার করা উচিত নয়। কিন্তু তা মানছে না কেউ। অত্যধিক ব্যবহারে তেলে এক ধরনের কার্বন তৈরি হয়, যা থেকে ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া রং ও রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে পাকানো ফল মানব দেহে জটিল রোগ সৃষ্টি করে। তিনি বলেন, খাদ্যে ভেজাল রোধে ভেজাল বিরোধী অভিযান যথেষ্ট নয়। এর সাথে প্রয়োজন কঠোর আইন ও তার যথাযথ প্রয়োগ।

এছাড়াও বিভিন্ন কেমিক্যাল আর পিঁয়াজের রস মিশিয়ে তৈরি করা হয় এক নম্বর খাঁটি সরিষার তেল। ছানার পরিত্যক্ত পানির সঙ্গে আটা, ময়দা, ভাতের মাড়, এরারুট মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে ‘খাঁটি দুধ’। মরিচের গুঁড়ায় ব্যবহার করা হয় রাসায়নিক রং ও ইটের গুঁড়া। কাউন ও কাঠের গুঁড়া মিশিয়ে তৈরি করা হয় প্যাকেট মসলা। নোংরা পানি ব্যবহারের মাধ্যমে আইসক্রিম বানানো হচ্ছে। শিশুখাদ্য দুধও ভেজালমুক্ত রাখা যাচ্ছে না। অতিরিক্ত রেডিয়েশনযুক্ত গুঁড়া দুধ আমদানি হচ্ছে দেদার। ইউরিয়া, ফরমালিনসহ নানা কেমিক্যাল মিশিয়ে মাছকে বিপজ্জনক বিষে পরিণত করা হচ্ছে। মাছ তাজা থাকা অবস্থায় ইনজেকশনের মাধ্যমে ফরমালিন পুশ, ফরমালিন মেশানো পানি দিয়ে তৈরি বরফের পাটা দিয়ে দিনভর মাছ চাপা রাখা হচ্ছে।

সূত্রমতে, বিএসটিআই মান কোড সমর্থন করেএমন পণ্যের বাজারজাতকরণের আগেই পণ্যের গুণগত মানের নিশ্চয়তা (পণ্য পরিক্ষা) বিএসটিআই সিএম সনদ গ্রহণ করতে হয়। সিএম সনদ ছাড়া পণ্যের উৎপাদন ও বাজারজাত করা যায় না। পণ্যের মোড়কে সিএম সনদের নম্বরও উল্লেখ করতে হয়। কিন্তু অনেক পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান বিএসটিআইয়ের সিএম সনদ না নিয়েই পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। পরীক্ষাবিহীন এসব পণ্যের গুণগত মান ঠিক রয়েছে কিনা, তা যাচাই করতে পারেন না ভোক্তারা। আবার বিএসটিআই মনোগ্রাম ব্যবহার করাতে সরল বিশ্বাসে ভোক্তারা প্রতারিত হচ্ছেন।

কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন আজাদীকে বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারির অভাবে দেশে মানহীন, অবৈধ, নকল খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের বাজারে সয়লাব হয়েছে। অনেকে আবার বিএসটিআইর লোগো ছাপিয়ে এসব মানহীন পণ্য বাজারজাত করছে। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। সংস্থাগুলোর পারস্পরিক সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এটা থেকে রেহাই মিলবে না। তিনি বলেন, এখন মাঝে মাঝে অভিযান হয়, জরিমানা করা হয়। কার্যত কোনো সুফল আসছে না। এভাবে চলতে থাকলে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়বে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশাহ সূফি সৈয়দ আব্দুচ্ছালাম ঈছাপূরী (রহ.) স্মরণীয় ও বরণীয়
পরবর্তী নিবন্ধচতুর্থ দফায় আরও ১১৮ শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা প্রকাশ