পরীক্ষা আমাদের শিক্ষা জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়। এটি শিক্ষার্থীদের জ্ঞান, দক্ষতা এবং যোগ্যতা যাচাইয়ের প্রধান মাধ্যম। শিক্ষাব্যবস্থা ও পরীক্ষার মধ্যে এমন একটি সংযোগ রয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পরীক্ষা কেবলই ফলাফলের হিসাব–নিকাশ নয়, এটি শিক্ষার্থীদের মানসিক প্রস্তুতি, আত্মবিশ্বাস ও দায়িত্বশীলতারও একটি মাপকাঠি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, কিছু শিক্ষার্থী ভালো ফলাফলের আশায় নকলের মতো অসদুপায় অবলম্বন করে। এতে কেবল তাদের ব্যক্তিগত অগ্রগতিই থেমে যায় না; প্রশ্নবিদ্ধ হয় পুরো শিক্ষাব্যবস্থার স্বচ্ছতা, উপযোগিতা। এর ফলে যোগ্য শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিক্ষার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
নকল শুধু একটি খারাপ অভ্যাস নয়; এটি একটি সামাজিক ব্যাধি। যে সমাজে নকলের বিস্তার ঘটে, সেখানে সততা, নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ দুর্বল হয়ে পড়ে। নকলের মায়াজালে আটকে পড়া শিক্ষার্থীরা নিজেদের সৃজনশীলতা ও মেধার বিকাশে হয় অক্ষম, অকৃতকার্য। প্রতিটি পরীক্ষাকেন্দ্রেই এমন অনেক শিক্ষার্থী দেখা যায়, যারা শুধু ভালো ফলাফলের জন্য পরীক্ষা নামের প্রকৃত দক্ষতা মূল্যায়নের এই প্রক্রিয়াকে উপেক্ষা করে, নকলের আশ্রয় নেয়। এতে করে তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ কর্মজীবনেও অসৎ উপায়ে সাফল্যের পথ খোঁজে। আর আমাদের দেশে, কিছু মানুষের এমন প্রবণতা দীর্ঘমেয়াদে জাতিকে মেধাশূন্য করে তুলছে, কমিয়ে দিচ্ছে মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ, মানবিকতা।
নকলের প্রভাব কেবল শিক্ষার্থীদের নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি পুরো সমাজের জন্য এক বিষফোঁড়া। শিক্ষার্থীদের মধ্যে নকলের এই ঝোঁক, তৈরি হয় প্রস্তুতির অভাব, ভুল দৃষ্টিভঙ্গি এবং পরিবেশগত প্রভাবের কারণে। অনেক ক্ষেত্রে পরিবার কিংবা সমাজ শিক্ষার্থীদের ওপর এমন এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করে, যা তাদের অসৎ পথে পা বাড়াতে বাধ্য করে, বেপরোয়া বানায়। ফলে, দিন দিন শিক্ষার সঠিক মূল্যায়ন অসম্ভব হয়ে পড়ে, এবং প্রকৃত মেধাবীদের প্রাপ্য স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হতে হয়।
নকল একটি প্রতারণা, যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। উন্নত দেশগুলোতে নকলের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাজ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে নকলের শাস্তি হিসেবে ডিগ্রি বাতিল করার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানিকভাবে বহিষ্কার করা হয়। চীনে নকল ধরা পড়লে কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড ও জারি করা হয় সরকারি চাকরিতে আজীবনের নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু আমাদের দেশে নকল রোধে যে আইনের বিধান রয়েছে, তার সঠিক ও যথাযথ প্রয়োগের অভাবে উক্ত সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না।
অনেক সময় রাজনৈতিক প্রভাব বা সামাজিক চাপের কারণে নকলকারীরা তাদের প্রাপ্য শাস্তি এড়িয়ে যায়, ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। আমদের দেশে এখনও শিক্ষকেরা যখন নকলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন, তখন তাদের হুমকি, অপমান কিংবা ব্যক্তিগত আক্রমণের সম্মুখীন হয়। যা শিক্ষকদের মানসিক অবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত করে, ঘটায় শিক্ষার পরিবেশ ধারাবাহিক অবনতি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নকল রোধে নানা পদক্ষেপ নেওয়ার পরেও অনেক শিক্ষার্থী নকল করার মত অসৎ পন্থা অবলম্বন অব্যাহত রাখে।
নকল রোধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও তার যথাযথ প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। তবে শুধুমাত্র আইন প্রয়োগ করলেই হবে না; শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করাও অত্যন্ত প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ও মেধার বিকাশ নিশ্চিত করতে একটি স্বাস্থ্যকর এবং অনুপ্রেরণামূলক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। পরীক্ষার আগে প্রদান করতে হবে পর্যাপ্ত প্রস্তুতির সুযোগ ও প্রয়োজনীয় সহায়তা। শিক্ষার্থীদের নৈতিক মূল্যবোধ শেখাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে, পালন করতে হবে অতিরিক্ত কর্মসূচি।
নকলমুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলার মাধ্যমেই শিক্ষার প্রকৃত মান বজায় থাকবে, সম্ভব হবে মেধার যথাযথ মূল্যায়ন। তবেই বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বের মতো প্রতিষ্ঠা করতে পারবে একটি আদর্শ, টেকসই এবং যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা। এছাড়াও শিক্ষার ভিত্তি শক্তিশালী করতে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ অপরিহার্য। সবাই মিলে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সহযোগিতা করলে নকলকে প্রতিরোধ করার মাধ্যমে অচিরেই আমরা একটি সমৃদ্ধ জাতি গঠনে অবদান রাখতে পারব।