কদিন হতে দেশের পত্রপত্রিকায় একটি বিষয় নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে। তাহলো গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে বন্যপ্রাণীর অস্বাভাবিক মৃত্যু। কয়েক মাসের মধ্যে এখানে ১১ টি জেব্রা, ১টি বাঘ ও ১টি সিংহীর মৃত্যু হয়েছে। শুধু গাজীপুরে নয় ঢাকার মীরপুরে অবস্থিত জাতীয় চিড়িয়াখানায় বিগত আড়াই মাসে ৮টি প্রাণীর মৃত্যু হয়েছে। এগুলো হলো ১টি জেব্রা, ২টি ব্যাঘ্র শাবক, ২টি জিরাফশাবক, ১টি ইম্ফালা, ১টি সিংহ ও ১টি ওয়াইল্ড বিস্ট। এ ছাড়া রংপুর চিড়িয়াখানায়ও ২টি বাঘিনী মৃত্যুবরণ করেছে। গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে পরপর নয়টি জেব্রার মৃত্যু হয়েছে ২ জানুয়ারি হতে ২৪ জানুয়ারি ২০২২ এর মধ্যে। আগে পার্কটিতে মোট জেব্রা ছিলো ৩১টি। ১১টি মারা যাওয়ার পর এখন আছে ২০টি। এতো দ্রুত সময়ে ১১ টি জেব্রার মৃত্যু অনেকেরই রহস্যজনক মনে হচ্ছে। এই সাফারি পার্কটি দীর্ঘদিন ধরে জেব্রার পালে সমৃদ্ধ ছিলো। কয়েকদিন পর পর জেব্রার পালে আসছিলো নতুন নতুন বাচ্চা। ক্রমাগত সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখান থেকে মীরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানায় কিছু জেব্রা পাঠানোর কথা ছিলো। কিন্তু এখন আমদানী করে চাহিদা পুরণ করতে হবে। এদিকে তিন সপ্তাহের মধ্যে নয়টি জেব্রার মৃত্যুর কারণ খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সাফারি পার্ক কর্তৃপক্ষ। তদন্ত কমিটি খাদ্যে বিষক্রিয়া, বিষ প্রয়োগ, ভাইরাস/ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ মাথায় রেখে তদন্ত করেছেন। জেব্রার খাবার মূলত: ঘাস, সাফারি পার্কের চারণভূমির পাশাপাশি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জায়গা হতে ঘাস এনে জেব্রাকে খাওয়ানো হয়। সেটিও তদন্তের বিষয়। ২০১৩ সালে পার্ক প্রতিষ্ঠার পর দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ হতে বাঘ, সিংহ, জিরাফ, জেব্রা, হরিণ, ক্যাঙ্গারু, কালো ভালুক, সাম্বার, গয়াল, হাতিসহ প্রচুর বন্যপ্রাণী ও পাখি আনা হয়। গত আট বছরে নিয়মিত ভাবে বাঘ, জিরাফ, ক্যাঙ্গারু, জেব্রা সহ বিভিন্ন প্রাণীর মৃত্যু হয়েছে। মারা গেছে দুর্লভ কিছু পাখিও। একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে চোরা কারবারিদের কাছ থেকে উদ্ধার ও দেশের বনাঞ্চল থেকে বিভিন্ন সময়ে উদ্ধার করা প্রাণী ও পাখি বেশির ভাগই বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে এনে রাখা হয়েছে।
এদিকে তদন্ত কমিটির রিপোর্টে আঘাত বিষক্রিয়া ও রোগ ছড়িয়ে পড়ায় বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের জেব্রা, বাঘ ও সিংহ গুলি মারা গেছে বলে মতামত প্রদান করেছেন। তাদের মতে মারা যাওয়া জেব্রাগুলোর মধ্যে তিনটি মারা গেছে আঘাতে। আটটি মারা গেছে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে। তবে নিউমোনিয়ায় আক্রান্তগুলোর শরীরে বিষক্রিয়ার উপস্থিতি পাওয়া যায়। অন্যদিকে সাফারি পার্কে মারা যাওয়া বাঘটি এনথ্রাক্স আক্রান্ত ছিলো। এছাড়া মীরপুর চিড়িয়াখানার সিংহীটিও এনথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। বাঘ শাবক দুটি মারা গেছে ট্রিপেনোসোমা ব্লাডপ্লোটোজোয়া রোগে যা মাছির কামড়ে ছড়ায়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারের সূত্রে জানা যায়, সাফারি পার্কের ১১টি জেব্রার মধ্যে ৩ টি জেব্রা আঘাতে মারা গেছে। আঘাতে জেব্রাগুলোর নাড়িভুড়ি বের হয়ে গিয়েছিল। তবে প্রাণীগুলো কিভাবে আঘাত পেয়েছিলো তা জানা যায়নি। বাকি ৮টি জেব্রা প্রচণ্ড নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। তবে এগুলোর শরীরে বিষক্রিয়ার উপস্থিতিও পাওয়া গেছে। অর্থাৎ ওদের শরীরে যে কোনো ভাবে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে। এটি হয়ত তাদের খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করা ঘাস থেকেও হতে পারে কারণ সাফারি পার্কের ঘাসে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রায় সিসা বা বিষ পাওয়া গেছে। সে জন্য অন্য জায়গা থেকে ঘাস এনে জেব্রাগুলোকে খাওয়ানো হতো। তবে প্রতিটি চিড়িয়াখানা ও সাফারি পার্কে নিম্নমানের ও পচা বাসি খাবার সরবরাহের একটি অভিযোগ যুগ যুগ ধরে উঠে আসছে। যখন খাদ্যে বিষক্রিয়ায় কোনো প্রাণী মারা যায় তখন এটি নিয়ে হইচই শুরু হয়। তার আগে পর্যন্ত এসব বিষয় কেউ খেয়াল রাখে না। অথচ এগুলো দেখার ও তদারকের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ রয়েছে। তাই এসব অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু রোধ করতে হলে প্রয়োজন প্রতিটি চিড়িয়াখানা ও সাফারি পার্কে পশু চিকিৎসক ও পশু চিকিৎসালয়। প্রয়োজন প্রতিটি প্রাণীকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা, না হলে এধরনের মৃত্যু ঘটতেই থাকবে।
আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে সহজাত প্রবৃত্তি হলো কোনো পশু পাখি দেখলে তাকে অহেতুক বিরক্ত করা ও ক্ষেত্র বিশেষে মেরে ফেলা। পশু পাখি দেখলে আমরা আক্রমণ করি এবং এতে এক ধরনের আনন্দও পাই। অথচ বিধাতা এগুলো তৈরী করেছেন আমাদের প্রয়োজনে। চিড়িয়াখানা গিয়েও আমরা পশুপাখি কে ঢিল ছু্ড়ি বা তাদের উপর বিভিন্ন জিনিস ছুড়ে মারি। রাস্তায় চলাচলের সময় একটু খেয়াল করলে প্রচুর আঘাতপ্রাপ্ত কুকুর দেখা যায়। হয়ত কোনোটির লেজ কাটা, কোনোটির পা কাটা, কান কাটা, কোনোটির পা আঘাত প্রাপ্ত আবার কোনটির শরীরে গরম পানি ঢেলে দেওয়ায় ঘা ইত্যাদি। অথচ কুকুরের মত প্রভুভক্ত প্রাণী এই জগতে আর একটিও নাই। আপনি যে কোনো কুকুরকে একদিন কিছু খেতে দিলে সে আপনাকে অনেক দিন মনে রাখবে এবং সময় সুযোগ মত আপনার উপকার করবে অথচ সেই অবলা প্রাণীকে আমরা অহেতুক আঘাত করি। অতীতে দেশের প্রায় সব এলাকায় বন জঙ্গল ও ঝোপঝাড় ছিলো এবং সেখানে প্রচুর কীটপতঙ্গ ও পশুপাখি থাকতো। আমাদের আক্রমণ ও ঝোপ ঝাড় উজাড় করে ফেলায় ঐসব প্রাণী অন্যত্র চলে গেছে বা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। শুধু আশেপাশের এলাকায় নয়, সরকারের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভিতরেও গাছপালা কেটে উজাড় করে দেওয়ায় পাহাড়ি বিভিন্ন প্রাণী বিশেষ করে হাতীর পাল খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে চলে আসে। একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, আমরা পাহাড় পর্বত সব কেটে ন্যাড়া করে ফেলেছি। কয়েক বছর আগেও শহরাঞ্চলে প্রচুর সাপ, ব্যাঙ, বানর, হরিণ, গুইসাপ ইত্যাদি দেখা যেত। এখন আমাদের কার্যকলাপে সব উধাও হয়ে গেছে। কিছু কাল আগেও শীতকালে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে জলাশয়ে ও হাওরাঞ্চলে প্রচুর শীতের পাখি আসতো। সেগুলোকে নির্বিচারে শিকার করায় এখন অতিথি পাখির আগমন অনেক কমে গেছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়ত শীতের পাখি আর আসবে না। সব ধরনের প্রাণীর প্রতি আমাদের রূঢ় আচরণের জন্য এগুলো আস্তে আস্তে বিলুপ্তির পথে। এতে করে দেশের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখে পড়ছে। যার বিরূপ ফলাফলের মুখোমুখি আমাদেরকে অবশ্যই হতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সাধারণ সম্পাদক, চবি গণিত অ্যালামনাই এসোসিয়েশন।