‘ধর্ষণ’ মানেই ধর্ষণ, বলাৎকার। অর্থাৎ জোরপূর্বক নারীর শ্লীলতাহানি করা। মূলত: এটি হলো যৌন নিপীড়ন। একজন ব্যক্তির ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর কিংবা বলপ্রয়োগ করে যৌন সঙ্গম করার নামই ধর্ষণ। বিশেষ করে শারীরিকভাবে অক্ষম যেমন মানসিক প্রতিবন্ধী, বিকলাঙ্গ, অজ্ঞান কোনো নারীর সাথে যৌন সঙ্গমে লিপ্ত হওয়া মানেই তাকে ধর্ষণ করা। এই জঘন্য এবং পাশবিক অপরাধকে শুধু নারী নির্যাতন বলে হালকা করে দেয়ার কোনো অবকাশ নেই। এই কথাটি এই সময়ে যিনি বলেছেন, তিনিও অপরাধী। বিশ্বজুড়ে ধর্ষণের যে ঘটনা ঘটেছে, সবকটিই পুরুষ কর্তৃক। বিশেষ করে যুদ্ধবিগ্রহ, কিংবা ডাকাতি আর লুটতরাজেও আমরা দেখি প্রথমেই নারীরা ধর্ষণের শিকার হয়। যুদ্ধ বিগ্রহে ধর্ষণকারীরা যুদ্ধাপরাধীর সামিল বলে পরিগণিত হয়। কাজেই ধর্ষক বলতেই আমাদের চোখে ভাসে এক বর্বর, কামাতুর ও নারীর শরীরলোভী পুরুষের জীবন্ত প্রতিকৃতি। সুপ্রিয় পাঠক, ৭০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী নিহার বানু হত্যার কথা কি আপনাদের মনে আছে? অনিন্দ্য সুন্দরী এই নারীকে তারই সহপাঠী বন্ধুরা (আসামী একজনের নাম ছিল নীলু) মিলে ধর্ষণ পরবর্তী নির্মমভাবে হত্যা করে লাশ পুতে ফেলে। এই ঘটনাই ছিল আমার জীবনে দেখা প্রথম নারীকে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার ঘটনা। পরে এই ঘটনার তদন্ত এবং আসামীরা ধরা পড়ে। এদের বিচার হয়েছিল কিনা মনে পড়ছে না। আরো কিছুকাল পরেই এর কাছাকাছি সময়ে প্রথম শিশুকে খুন করে বালিতে পুতে ফেলার ঘটনা ঘটেছিল কুমিল্লার তিতাস নদীর পাড়ে। সুমি নামের আদুরী এক শিশুকে কি কারণে মনে নেই, প্রথমে অপহরণ এবং পরে খুন করে তিতাস নদীর পাড়ে তাকে পুতে রেখেছিল আসামীরা। এই ঘটনাও আমার জীবনে শিশু খুন করার প্রথম ঘটনা। দুটি ঘটনাই দেশজুড়ে তোলপাড় হয়েছিল। পত্রপত্রিকায় নিয়মিত ফলোআপ রিপোর্ট আমরা পেয়েছিলাম। তখন সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। দৈনিক পত্রিকা এবং সাময়িকীগুলোই ছিল অন্যতম সংবাদ মাধ্যম। এরই ধারাবাহিকতায়, শহীদ সাংবাদিক কন্যা শারমীন রীমা হত্যা, এবং আসামী মুনিরের ফাঁসি কার্যকর, পুলিশ কর্তৃক দিনাজপুরের গৃহকর্মী ইয়াসমিনকে গণধর্ষণ এবং হত্যার ঘটনা আমাদের দেশে আলোড়ন সৃষ্টিকারী চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডগুলোর অন্যতম। নারীদের তীব্র প্রতিবাদ আর আন্দোলনের মুখে বিলম্বে হলেও এই ঘটনারও বিচার হয়। এবং আসামীদের ফাঁসি কার্যকর হয়। এরপরেও কি থেমেছিল? না এই কাতারে যুক্ত হয় অনেক নাম ফাহিমা, মহিমা, সোহাগী, তনুসহ অনেক নিরপরাধ যুবতী, কিশোরী নারী ও শিশু। এই কয়দিনে দেশজুড়ে তোলপাড় করা শিশু আছিয়া হত্যার ঘটনায় আমরা স্তব্ধ হয়ে পড়েছি। কি অমানুষিক ও বর্বর নির্যাতন এই শিশুটির উপর না অভিযুক্তরা করেছিল! নিজ বোনের ঘরেই নিরপরাধ শিশুটি নিরাপত্তা পেলো না। তিন নরপশু কত নির্মমভাবেই এই শিশুটিকে মেরে ফেললো। একই সময়ে চলন্ত বাসেও ধর্ষিত হয়েছে নারী। জালিম পিতার হাতে নিজ কন্যা ধর্ষিত হয়েছে। পুরো দেশ যেন ধর্ষকদের স্বর্গ রাজ্যে পরিণত হয়েছে। শিশুরা যেখানে নিরাপদ না, নারীদের অবস্থা তো আরো ভয়াবহ। আছিয়ার ঘটনায় আমাদের প্রাণী সম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আকতার চিকিৎসারত অবস্থায় আছিয়াকে দেখতে গিয়েছিলেন। তিনি পরিবারের সাথে কথা বলেই বলেছেন, এই ঘটনায় দোষীদের অবশ্যই যথোপযুক্ত শাস্তির আওতায় আনা হবে। তিনি অতীতে নারী নির্যাতন বিরোধী বিভিন্ন আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। নারীদের উপর দেশব্যাপী সহিংসতা ও নির্যাতনের প্রতিবাদে সংসদ ভবনে কালো পোশাক পরে মোমবাতি প্রজ্বলন, প্রতীকী নারী আদালত পরিচালনা করে তিনি নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। কাজেই আমরা আশা করবো, আছিয়া এবং দেশে ধর্ষণজনিত ঘটনাগুলোর দ্রুত বিচার এবং উপযুক্ত শাস্তি হবে। এইসব ঘটনায় নারী সমাজ এখন রীতিমতো আতংকিত। মায়েরা শংকিত তাদের কন্যা সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। একটি শিশু ঘরে–বাইরে কোথাও নিরাপদ না। প্রশ্ন জাগে, কে দেবে এই নিরাপত্তা। অবশ্যই প্রথমে রাষ্ট্রকে এই দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হলো রাষ্ট্র। আর বর্তমানে রাষ্ট্র পরিচালনায় এসেছেন সংস্কারপন্থি সরকার। তারা বিগত কথিত ফ্যাসিবাদকে বিতাড়িত করে দেশের প্রতিটি সেক্টরকে নতুন করে সংস্কারের বাসনায় দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তাহলে, আমরা কি দেখছি এখন। দেশজুড়ে নারী ও শিশুরা মারাত্মক এক হুমকির মুখে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ইসলামী আইনে ধর্ষণকারী খুনির শাস্তি যদি হয় পাথর ছুঁড়ে মারা, তাহলে তাই করা হবে। আবার অন্যজন বলছেন, বিষয়টিকে ‘ ধর্ষণ : না বলে ‘নারী নির্যাতন’ বলার জন্য। আবার আইন উপদেষ্টা বলেছেন, ফাঁসি দেয়া যাবে না, কারণ এতে নাকি যে কেউ মামলা ঠুকে দিয়ে নিরপ রাধ ব্যক্তিকেই ফাঁসিতে ঝুলাবে। তাঁর এই বক্তব্যের প্রতিবাদে রাজপথে নেমেছে শিক্ষার্থীরা। তারা মিছিলে মিটিং–এ স্লোগানে মুখর হয়ে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছে। আর তারা এটাও বলছে,যদি আপনারা না পারেন, এই দায়িত্ব আমাদের উপর ছেড়ে দেন। আমরাই শাস্তির ব্যবস্থা করবো।
এই প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী কাউসার পারভীন বলেন, আসলে এসব ঘটনা হলো চরম সামাজিক অবক্ষয়ের বহিঃপ্রকাশ। কারণ আছিয়ার মা দরিদ্র, সে দ’ুবেলা দুমুঠো খাবারের আশায় মেয়েকে পাঠিয়েছে মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে। অথচ সেখানে গিয়েই আছিয়া নিরাপত্তা তো পেলই না,বরং সেই ঘরের তিন নরপশু কতৃক জঘন্যভাবে ধর্ষিত হয়ে সীমাহীন যন্ত্রণা ভোগ করেই মৃত্যুবরণ করলো। কাজেই এখন অবস্থা এমন হয়েছে, নারী না একজন শিশুও বাইরে তো দূরের কথা ঘরেও নিরাপদ না। আমাদেরকে প্রথমে নিজেদেরকে সচেতন হতে হবে। নিজেকে নিজেই সুরক্ষিত রাখতে হবে, সেটি প্রতিবাদে হোক কিংবা স্বীয় আচরণ, কার্যক্ষমতা দিয়েই প্রতিরোধের উপায় বের করতে হবে। এই ধরনের অনাকাঙিক্ষত পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি না হয় সেদিকেই খেয়াল রাখতে হবে। আর পুরুষ সে–তো সুযোগ পেলেই, তা হাতছাড়া করবে না, তাই সে যাতে সেই সুযোগের অপব্যবহার করতে না পারে, সেদিকেই খেয়াল রাখতে হবে। আমরা ফাহিমা,মহিমা, ইয়াসমিন আর সীমার কথা ভুলে যাইনি। তখনো প্রতিবাদ করেছি। আর এই ঘটনার প্রতিবাদের ভাষাও নেই। আমরা নিজেদেরকে যদি সংঘাত হানাহানি থেকে মুক্ত রেখে সমাজের ভালো কাজে যুক্ত রাখি, অবশ্যই সামাজিক অবক্ষয় দূর হবে। আমাদেরকে অনেক বেশী সহনশীল হতে হবে।
বনফুল (এনজিও)-এর প্রধান নির্বাহী রেজিয়া বেগম বলেন, দীর্ঘসময় ধরে আমরা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স নিয়ে কাজ করছি। নারী ও শিশুদেরকে কি ভাবে সুরক্ষিত রাখা যায়, সেবিষয়ে সচেতনতার মিশন আর ভিশন নিয়েই আমরা মাঠে, রাজপথে কাজ করেছি। কিন্তু আজ আছিয়ার ঘটনায় আমরা স্তম্ভিত হয়ে পড়েছি। ঘটনায় জড়িত তিন নরপশুর উপযুক্ত শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। আর পরিবারেই কিন্তু প্রথমে শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। শিশু ও নারী যাতে পরিবারের সদস্য দ্বারা নিপীড়িত না হয়, সেদিকেই বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। এই খেয়ালটা ধনী দরিদ্র, শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে সকলকে নজরদারীতে রাখতে হবে।
ফ্যাশন ডিজাইনার সুলতানা নূরজাহান রোজী বলেন, আসলে নারী ও শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। পরিবারের যিনি অভিভাবক তাকেই প্রথমে এই বিষয়ে সচেতন হতে হবে। সারাদেশে আজ অনেক আছিয়া রয়েছে। অনেক সহিংসতার ঘটনা অহরহ সমাজে, পরিবারে ঘটছে, সব ঘটনা ফোকাস হয় না। কিছু উঠে আসে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। আমরা মায়েরা আমাদের সন্তানদের প্রতি সচেতন ও দায়িত্বশীল হলে, এই ধরনের অবক্ষয় কমে আসতো অনেকাংশে। আমাদের আত্মসমালোচনা করেই নিজেরা নিজেদের সংশোধন করলেই সমাজ পরিবর্তন হবে। আমাদের নারী ও শিশুরা সুরক্ষিত থাকবে। শিশুদের নিরাপদ পরিবেশে বেড়ে উঠার সোপান আমাদেরকেই রচনা করে দিতে হবে। তবে যতই বলি না কেন, সমাজের এই অবক্ষয় প্রতিরোধে আমাদের সচেতনতার পাশাপাশি রাষ্ট্র ও প্রশাসনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। অপরাধীর যদি বিচার হয়, যদি উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা হয়, তাহলে এই ধরনের অপরাধ কিছুটা কমবে। এই শিশু আছিয়া মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে বলে গিয়েছে, তিন পাষন্ড আত্মীয় তাকে কি পাশবিক ও ভয়ঙ্কর নির্যাতন করেছে। সে বলেছে, তাদের উপযুক্ত শাস্তি হলেই সে মরে গেলেও শান্তি পাবে। আমরা আশা করবো, আছিয়া হত্যার বিচারের মধ্য দিয়ে একটি অবক্ষয়মুক্ত সমাজ আমরা পাবো। নারী ও শিশুরা সুরক্ষিত থাকবে ঘরে ও বাইরে।