নগরীর বহদ্দারহাট নিউ চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার ৪ নম্বর সড়কের ৪০ নম্বর ভবনটি জনৈক হাজী সাহেবের। ছয় মাস আগে তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছিলেন মো. মাসুদ ফোরকান (৩০) নামে এক যুবক। ওই ভবনের অন্যান্য ভাড়াটিয়াই শুধু নয়, আশেপাশের মানুষও তাকে যথেষ্ট সম্মান করতেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসুল্লি হিসেবে। কিন্তু গতকাল বাকলিয়া থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে ওই ফ্ল্যাট থেকে যখন ২৩ হাজার ইয়াবার পাশাপাশি ইয়াবা বিক্রির ৮ লাখ ৮৩ হাজার ৬২২ টাকা উদ্ধার করে, তখন ভবনের অন্যান্য ভাড়াটিয়া এবং স্থানীয়দের চোখ ছানাবড়া! পরে জানাজানি হয়, ‘ধর্মীয় লেবাসে’র আড়ালে একটি ইয়াবা সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ওই যুবক। শুধু তাই নয় সরাসরি মিয়ানমারের ইয়াবা সিন্ডিকেটের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে তাঁর। গ্রেপ্তারের পর প্রমাণ স্বরূপ পুলিশের সামনে তিনি হোয়াটস অ্যাপের মাধ্যমে মিয়ানমারে যোগাযোগ করেছেন। পুলিশ ওই ফ্ল্যাট থেকে মাসুদ ফোরকান ছাড়াও তার স্ত্রী শামীম আরা শমী (২৮) এবং মাসুদের বন্ধু মোবারক হোসেন (৩৮) ও দোকান কর্মচারী মো. রাসেলকে (১৮) গ্রেপ্তার করে। এদের মধ্যে মাসুদের বাড়ি বাঁশখালী উপজেলার চাঁনপুর গ্রামে। মোবারকের বাড়ি কঙবাজার জেলার পেকুয়া উপজেলার দক্ষিণ গুলদী গ্রামে। আর রাসেলের বাসা চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায়। ফ্ল্যাট থেকে ইয়াবা এবং ইয়াবা বিক্রির টাকা ছাড়াও ডাচ-বাংলা ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংকের ১২টি চেকবই, দুটি পাসপোর্ট, বিপুল পরিমাণ ধর্মীয় বইপত্র এবং বেশকিছু ধাতব চুম্বক উদ্ধার করে পুলিশ।
বাকলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নেজামউদ্দীন আজাদীকে বলেন, গত ৫ নভেম্বর রাতে ইয়াবার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগে নগরীর শাহ আমানত সেতু এলাকায় অভিযান চালিয়ে আব্দুর রাজ্জাক (২১) নামে একজনকে আমেরিকায় তৈরি একটি পিস্তল ও ২টি ম্যাগজিনসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সে জানিয়েছিল টেকনাফের লেদা ক্যাম্প থেকে ঢাকায় ইয়াবা পাচার করে তারা। ঢাকায় নির্দিষ্ট গ্রুপের কাছে ২০ থেকে ৩০ হাজার ইয়াবা পৌঁছে দিলে বিনিময়ে বিদেশী পিস্তল সরবরাহ করা হয়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরদিন টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে মো. কামাল (৪০) নামে আরেকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। দু’জনের বিরুদ্ধে বাকলিয়া থানায় অস্ত্র আইনে মামলা দায়ের হয়। ওই মামলায় তাদের পাঁচদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
ওসি জানান, জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃত দু’জন জানিয়েছে, লেদা ক্যাম্পে এমন একশ’ জনের একটা গ্রুপ আছে ইয়াবা পাচারের। আর তাদের সিন্ডিকেটের আরেকটি আস্তানা নগরীর নিউ চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় আছে। তখন আমরা বিভিন্ন সূত্রে খবর নিয়ে এই আস্তানার সন্ধান পাই এবং উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) এস এম মেহেদী হাসান স্যারের নেতৃত্বে অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) পলাশ কান্তি নাথ, সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ রাইসুল ইসলাম স্যারসহ আমরা এ অভিযান চালাই।
গতকাল বিকেলে সরেজমিনে নিউ চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার ৪ নম্বর সড়কের ৪০ নম্বর ভবনে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের সামনে প্রচুর লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে কানাঘুষা চলছে। ‘হাজী সাহেবের ভবনের’ দারোয়ান মো. ইসরাফিল বলেন, ‘বাসায় ঢুকতে, বের হতে সালাম দিতেন মাসুদ সাহেব। মানুষকে সবসময় নামাজ ও দ্বীনের দাওয়াত দিতেন। তিনি যে এতবড় মাপের ইয়াবা ব্যবসায়ী এটা কেউ বুঝতে পারিনি।’
পাশের ভবনের বাসিন্দা মো. সেলিম বলেন, ‘আমি নিয়মিত উনার মুদির দোকান থেকেই বাজার করতাম। দেখা হলেই সালাম দিতেন। মানুষের সঙ্গে খুবই মার্জিত ব্যবহার করতেন। মসজিদে গিয়ে সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করতেন। এমন মানুষের বাসায় ইয়াবা পেয়েছে শুনে অবাক হয়েছি। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তিনি এ কাজ করতে পারেন।’
ভবনের তৃতীয় তলার নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখা যায় সারি সারি প্রচুর ধর্মীয় গ্রন্থ। ফ্ল্যাট জুড়ে আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। উপস্থিত সাংবাদিকদের সামনে মাসুদ ফোরকান দাবি করেন, কালামিয়া বাজার এলাকায় তার একটা চা পাতার দোকান আছে। কিন্তু দোকানের আয় দিয়ে এ ধরনের একটি ফ্ল্যাটের ব্যয় কীভাবে নির্বাহ করেন জানতে চাইলে তিনি নিশ্চুপ থাকেন। পরে পুলিশ জানায় বহদ্দারহাট কাঁচাবাজারে তার মুদি দোকান আছে।
বাসায় পাওয়া ইয়াবা ও টাকার বিষয়ে মাসুদ জানান, শুক্রবার সকালে হাবিবউল্লাহ নামে তার এক বন্ধু ইয়াবাগুলো তার বাসায় রেখে যায়। হাবিবউল্লাহর পরিচিত একজন এসে সেগুলো নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। জব্দ টাকাগুলো তার দোকানের ব্যবসার টাকা বলে মাসুদ দাবি করেছেন। কিন্তু ওসি নেজাম উদ্দীন বলেন, এসব নিজেদের বাঁচানোর কৌশল হিসেবে তারা বলছেন। তিনি বলেন, তাদের বাসা থেকে বেশ কিছু চুম্বক পাওয়া গেছে। এই চুম্বকের সঙ্গে প্যাকেটে মোড়ানো ইয়াবা বেঁধে গাড়ির নিচে লোহার সঙ্গে লাগিয়ে কঙবাজার থেকে চট্টগ্রামে এই মাদক নিয়ে আসা হতো।
মাসুদের স্ত্রী শামীম আরা ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তিনি ৩৮ তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। তিনি আবারও বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। শামীম আরা নিজেই আলমারি থেকে টাকাগুলো বের করে দেন। মাসুদ যে ইয়াবার ব্যবসা করতেন তা তার স্ত্রী জানতেন। তাদের ছয় মাস বয়সী এক ছেলে আছে।
গ্রেপ্তারকৃত মোবারক জানান, মাসুদের সাথে তার তাবলীগে গিয়ে পরিচয়। সেখান থেকে ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব। তিনি নগরী থেকে সার্জিক্যাল আইটেম কিনে গ্রামে বিভিন্ন দোকানে সরবরাহ করেন। তিনি ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন বলে দাবি করেন।
সিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার এস এম মেহেদী হাসান বলেন, ‘মাসুদ ও মোবারক উভয়ই ইয়াবা সিন্ডিকেটে সক্রিয়ভাবে জড়িত। তারা দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যবসা করে আসছে। অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হওয়া দুজন এবং এরা একই নেটওয়ার্কে আছে। গ্রেপ্তার চারজনের মধ্যে যিনি প্রধান (মাসুদ) তার সঙ্গে মিয়ানমারের ইয়াবা ব্যবসায়ীর সরাসরি যোগাযোগ আছে। গ্রেপ্তারের পর প্রমাণ স্বরূপ আমাদের সামনে সে হোয়াটস অ্যাপের মাধ্যমে মিয়ানমারে যোগাযোগ করেছে। আরেকজনের সঙ্গে কঙবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘এলাকার লোকজন আমাদের জানিয়েছেন, মসজিদে গিয়ে সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন মাসুদ। তার বাসায় আলমারি জুড়ে সব ধর্মীয় বইপত্র। মাঝে মাঝে তাবলীগে যেতেন। আসলে ধর্মের লেবাসে তারা ইয়াবার ব্যবসা করে। ধর্মের লেবাসটা নিয়েছে যাতে তাদের দেখে কারও সন্দেহ না হয়।’