ধর্মাচারী আবু মোহাম্মদ তবিবুল আলম

অভীক ওসমান | বুধবার , ২২ অক্টোবর, ২০২৫ at ৮:৪০ পূর্বাহ্ণ

ষাটের দশকের এক অনতি তরুণ বিস্ময়ে দেখছিল আন্দরকিল্লায়, আমানত বেকারির বিপরীতে প্যারামাউন্ট প্রসেস ন্যস্ত প্রিন্টিং ওয়ার্ক্সের একটি সাইনবোর্ড। তার পাশেই ছিল ফারুকীয়া হোটেল, যা রাজনীতিবিদ মিয়া আবু মোহাম্মদ ফারুকীর। প্যারামাউন্ট প্রসেস প্রিন্টিং ওয়ার্ক্স ছিল আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেকের চাচাতো ভাই, আবু মোহাম্মদ তবিবুল আলমের প্রতিষ্ঠান। কম্পিউটার যুগ তখন আসে নি; নিউজ হেডলাইন ও অন্যান্য কন্টেন্ট জিংক ব্লকের মাধ্যমে ছাপানো হতো। এমন এক শুভ প্রাতে একুশে পদকপ্রাপ্ত আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক আমাদের বলছিলেন, ‘আবু মোহাম্মদ তবিবুল আলম ছিলেন তার চাচা, এবং তাঁর দাদারা দুই ভাই ছিলেন। তিনি বর্ণনা করছিলেন, কীভাবে তখন ব্লক থেকে জিংক ব্লক দিয়ে পত্রিকার নিউজ, হেডলাইন, বিজ্ঞাপন তৈরি হতো। পরে আজাদী মনোটাইপ আনে এবং বর্তমানে আমরা কম্পিউটার যুগে প্রবেশ করেছি।’ সম্প্রতি আবু মোহাম্মদ তবিবুল আলমের ৭ম মৃত্যুবার্ষিকী গেলো; আমি তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।

১৯৮৩ সালের দিকে, আমি যখন জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসায় বাংলা বিভাগের লেকচারার হিসেবে ইন্টারভিউ দিতে যাই বা জয়েন করি, তখন আমার পরিচয় হয় এই মনীষী আবু মোহাম্মদ তবিবুল আলমের সাথে। সম্ভবত তিনি আমার ইন্টারভিউ বোর্ডে ছিলেন। প্রিন্সিপাল মরহুম আব্দুর রহিম, প্রয়াত প্রিন্সিপাল জালাল উদ্দিন আল কাদেরী, এবং আমার শ্বশুর মরহুম আব্দুল হালিম চৌধুরী তাঁরা সবাই তখন আনজুমানে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। আমার শ্বশুর আব্দুল হালিম চৌধুরী লয়েল রোডস্থ নবী মার্কেটের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক প্রেসিডেন্ট ছিলেন ভাষাসৈনিক প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম। তৎকালীন যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী মাহমুদুন্নবী চৌধুরী তাঁদের প্যাট্রোনাইজেশন করেছেন। আব্দুল হালিম চৌধুরী লয়েল রোডস্থ সিরিকোট ট্রেডার্সে আনজুমানের দানবাক্স কালেক্টরগণ আসতেন। দক্ষিণ চট্টগ্রামের অনেক শিক্ষার্থীসহ প্রায়ই লোকজন সেখানে আসতেন। তিনি সবাইকে চাপানি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। তাঁর দোকানে আইয়ুব আলী চৌধুরী, আব্দুল মান্নান সওদাগরও আসতেন।

আবু মোহাম্মদ তবিবুল আলম আমার নিকট পিতৃসম। আমি যখন বলুয়ার দিঘিস্থ, মরহুম নুর মোহাম্মদ আল কাদেরীর খানকাহ্‌ তৈয়ব শাহর মুরিদ হই, বাইরে আসার সময় তিনি আমাকে ‘মোবারক হো’ বলে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তিনি কখনো কখনো কঠোরও ছিলেন; এক পহেলা জানুয়ারি আমি ক্লাসে উপস্থিত না হলে বলেছিলেন, ‘আজকে ইংরেজি ক্যালেন্ডারের প্রথম দিন। আপনি যাননি কেন?’

পরবর্তীতে জামেয়া থেকে আমি বরমা ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজে চলে যাই। চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সচিব ও প্রধান নির্বাহী হিসেবে ৩০ বছর দায়িত্ব পালনকালে আমার তাঁর সঙ্গে দেখা হতো কদম মোবারকস্থ ইয়াসিন খাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন মসজিদে, জুমার নামাজের পূর্বে। দেখা হলে তিনি আমার সঙ্গে পিতৃতুল্য আচরণ করতেন, মাথায় হাত বুলাতেন এবং জিজ্ঞেস করতেন, ‘আমার শ্বশুর কেমন আছেন?’

একজন পিতা, একজন গার্ডিয়ান, একজন মানুষ হিসেবে তিনি এখনও আমার স্মৃতিতে জীবন্ত। তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন হাজী আমিনুল হক সওদাগর, জনাব আব্দুল ওয়াহাব (জয়েন্ট সেক্রেটারি), ডাক্তার এমএ হাশেম (কবি মানজুর মাহমুদের শ্বশুর) এরা সবাই পরবর্তী সময়ে তাঁর কাজ করেছেন। পরবর্তীতে আমি প্রথম নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে মাসিক তরজুমানে আহলে সুন্নাতের দায়িত্ব নিই। জীবনের প্রান্তবেলায় বর্তমান সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মঞ্জুরুল আলম পুনর্বার আমাকে এ দায়িত্ব দিয়েছেন। এ প্রেক্ষাপটে বিশেষ করে ঈদেমিলাদুন্নবী সংখ্যাটি আমরা ‘বিশেষ সংখ্যা’ হিসেবে প্রকাশ করি। গত ঈদে মিলাদুন্নবী সংখ্যা আবু মোহাম্মদ তবিবুল আলমের পুত্র আহমেদ নেওয়াজ ঢাকা থেকে প্রচ্ছদ তৈরি করে পাঠিয়েছেন; তাঁর পুত্র মাহমুদ নেওয়াজ বর্তমানে আনজুমানে কার্যকর কমিটির সদস্য।

জনাব মাহমুদ নেওয়াজ বলছেন, আবু মোহাম্মদ তবিবুল আলম ১৯২৭ সালে রাউজানে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আহমদ মিয়া চৌধুরী ছিলেন হাওড়া, বার্মা ও ময়মনসিংহের পোস্টমাস্টার জেনারেল। তৎকালীন সময়ে তিনি ছিলেন একমাত্র বাঙালি পোস্টমাস্টার। ১৯৩৪ সালের দিকে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। আবু মিয়া রাউজান হাইস্কুল থেকে মেট্রিক, চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক তাঁকে কোহিনূর মঞ্জিলে নিয়ে আসেন এবং নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তার জীবন গড়ে তুলতে সাহায্য করেন। ১৯৫২ সালে, ভাষা আন্দোলনের উত্তাল সময়কালে, তিনি সাদাত আরা বেগমকে বিয়ে করেন। সাদাত আরা বেগম ছিলেন ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ খালেদের ভগ্নি। আবু মিয়ার বাবা মূলত ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক এবং তাঁর বড় ভাই আব্দুল গণি চৌধুরীকে প্যাট্রোনাইজেশন দিয়ে শিক্ষিত করে তোলেন।

আবু মোহাম্মদ তবিবুল আলমের তিন পুত্র এবং দুই কন্যা। পুত্র আহমেদ নেওয়াজ বিখ্যাত চিত্রশিল্পী। পুত্র মাহমুদ নেওয়াজ আনজুমানে রাহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়ার কার্যকরী সদস্য। পুত্র আরিফ খালেদ ব্যাংকার মোহাম্মদ খালেদ দ্বারা দত্তক গ্রহণ। কন্যা তাহেরা আলম রুনি (আমীর খসরু মাহমুদের স্ত্রী, নিউ জেনারেশন লিডার ইসরাফিল খসরুর মাতা), কন্যা সাবেরা আলম নীনা (নীনা সারোয়ার, নারী উদ্যোক্তা)

আবু মোহাম্মদ তবিবুল আলম শাহেন শাহ সিরিকোটি (রা.) এর খলিফা হিসেবে ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার অবদান রাউজান ও চট্টগ্রামের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে স্মরণীয়।

সাবেক বাণিজ্য মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী যিনি গত শতাব্দীতে চিটাগং চেম্বারে প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমার বস ছিলেন। তার রেফারেন্সে একটা ঘটনার কথা বলি, মন্ত্রী থাকা অবস্থায় মেহেদীবাগ বাসভবনের প্রাঙ্গণে আমার সাথে তার কথা হচ্ছিল। কথার প্রসঙ্গে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যার, কোথায় যাচ্ছেন?’ তিনি বললেন, ‘আমার শ্বশুর বাড়িতে যাচ্ছি, কিন্তু আমার শ্বশুর আবু মোহাম্মদ তবিবুল আলমের নির্দেশ ছিল, পুলিশ প্রটোকল এবং হুইচ বাজিয়ে যেন রাজকীয়ভাবে তাঁর বাসায় না যাই। খুবই সিম্পল এবং সাধারণভাবে যেন তাঁর বাসায় যাই।’ এতে প্রমাণিত হয়, কত বড় মাপের একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন আবু মিয়া।

আবু মিয়া সম্পর্কে এডভোকেট মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার লিখেছেন, ‘তিনি আবু মিয়া নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। বিনয় ও সততার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। সিরিকোটি হুজুর একবার তাঁকে বলেছিলেন, ‘আবু মিয়া! জিসিম মেরা সিরিকোট মে হ্যায়, মগর রুহ মেরা বাঙাল মে পড়া হুয়া হ্যায়।’ কথাটি ছিল হুজুর কেবলার ইন্তেকালের কয়েকদিন আগে, তাঁর শেষ সিরিকোট শরীফ সফরের সময়। আবু মিয়া সাহেবই ছিলেন হুজুরের সর্বশেষ দর্শনপ্রাপ্ত মুরীদ ও সর্বশেষ খলিফা। জানা যায়, তখনই তাঁকে খেলাফত প্রদান করা হয়, যদিও তিনি কখনো তা প্রকাশ করেননি। হুজুর স্নেহভরে তাঁকে ‘ডাক্তার’ নামে ডাকতেন, কারণ আবু মিয়া সাহেব তাঁর ক্ষতচিহ্নে ড্রেসিং করতেন। হুজুর প্রফুল্লচিত্তে বলতেন ‘মেরা ডাক্তার আগেয়া!’ একবার হুজুর তাঁকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বলেছিলেন, ‘আবু মিয়া! সিনেমা আচ্ছা লাগতা হ্যায়?’ সেদিনই আবু মিয়া গোপনে সিনেমা দেখে এসেছিলেন। সেই ঘটনার পর তিনি সারাজীবনের জন্য সিনেমা দেখা ত্যাগ করেন। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি আনজুমানরহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের জেনারেল সেক্রেটারি ও ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিষ্ঠা ও আমানতের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউসের আ‘লা বা‘লা মকাম দান করুন।’

আবু মোহাম্মদ তবিবুল আলম ২০১৮ সালের ১৩ অক্টোবর ইন্তেকাল করেন। সম্প্রতি তাঁর সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকীতে ইয়াসিন খান মসজিদের একজন মুসল্লি বলেন, ‘এখানে যেভাবে শুয়ে আছেন মাওলানা হযরত হাসান শাহ (রাহমাতুল্লাহ আলাইহি), মনিরুজ্জামান এসলামাবাদী, শুয়ে আছেন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম মুসলিম এমবি ডাক্তার এম এ হাশেম, পৌরসভার চেয়ারম্যান ফজল করিম, প্রচ্ছদশিল্পী খালিদ আহসান ঠিক সেইভাবে আবু মোহাম্মদ তবিবুল আলমও এখানে অন্তিম শায়নে শায়িত আছেন।’

আনজুমানের শতবছর, জশনে জুলুসের ও তরজুমানের অর্ধশতবছর অত্যন্ত বর্ণাঢ্য ও সফলভাবে পালিত হয়েছে। এই শুভমুহূর্তে আবু মোহাম্মদ তবিবুল আলমকে আমরা শ্রদ্ধাচিত্তে স্মরণ করছি ও তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করছি।

লেখক: প্রাবন্ধিক, গবেষক, নাট্যকার; পরিচালকটিআইসি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ