ধর্মনিরপেক্ষতার লেবাসে সাম্প্রদায়িকতার চাষাবাদ

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | শনিবার , ১০ জুলাই, ২০২১ at ৭:৩২ পূর্বাহ্ণ

এটি বিশ্বস্বীকৃত সত্য যে; দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত খণ্ডিত পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল আজকের স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ নাগরিক পবিত্র ইসলাম ধর্মাবলম্বী। সত্য ও শান্তির ধর্ম পবিত্র ইসলামের মৌলিক শিক্ষাই হচ্ছে নীতি-নৈতিকতা, মনুষ্যত্ব-মানবিকতা, সকল স্তরের গণমানুষের কল্যাণ-ন্যায্যতা এবং সামগ্রিক ইহ-পারলৌকিক বিশ্বাসে মহান স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জন। মানবসমাজে বিরাজিত নানামুখী বিভেদ-বিচ্ছেদ-বিরোধ সংহার ও মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব-সৌহার্দ-সম্প্রীতির বন্ধন সমৃদ্ধ করে আর্থ-সামাজিক ও আধ্যাত্মিক কর্মপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধকরণের মধ্যেই ইসলাম ধর্মের মৌলিক নির্যাস প্রোথিত। পবিত্র ইসলামে জঙ্গি-মৌলবাদ বা অন্য ধর্মের প্রতি প্রতিহিংসা-প্রতিশোধপরায়ণতা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত প্রিয় মাতৃভূমির জাতীয় আদর্শের অন্যতম স্তম্ভ হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতার লেবাসে পবিত্র ইসলামকে কলুষিত করার লক্ষ্যে ন্যূনতম ইসলামের আদর্শে বিশ্বাসী নয় এমন সব ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে দেশবিধ্বংসী রাজনৈতিক অপকর্ম পরিচালনা দৃশ্যমান। সহজ-সরল ধর্মপ্রাণ বিশেষ করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ইসলাম ও পবিত্র কোরআনের নানা বিষয়ে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে এদের বিভ্রান্ত করার অপকৌশল ইতিমধ্যেই ঘৃণ্য পন্থায় উন্মোচিত হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত ধার্মিক মুসলিম সম্প্রদায় শুধু কলঙ্কিত হচ্ছে না; বিশ্বব্যাপী নানাদিক থেকে হয়রানি ও অপদস্ত হওয়ার দৃষ্টান্তও প্রণীত হচ্ছে। অস্থিতিশীল পরিবেশের আচ্ছাদনে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের অনেকেই অনেকক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প বিকাশ ও বিস্তারে বিভিন্ন নামাকরণে গোষ্ঠীবদ্ধ কঠিন সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডে জড়িত বলে প্রবল জনশ্রুতি রয়েছে। শুধুমাত্র দাড়ি-টুপির মধ্যেই যে ইসলাম নিহিত নয় এবং মানবকল্যাণই যে ইসলামের মূলমন্ত্র; তাতে আস্থা না রেখে ধার্মিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জঙ্গি-মৌলবাদী কদর্য অভিধায় অভিষিক্ত করতেও এরা দ্বিধাবোধ করছে না।
বস্তুতপক্ষে ধর্মনিরপেক্ষতা কোন নির্দিষ্ট ধর্ম ও এর অন্ধগোড়ামিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় না। জঙ্গি-মৌলবাদ একই ধারাবাহিকতায় কোন ধর্মান্ধ জনগোষ্ঠীকে উপলক্ষ করে বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে সুপ্রতিষ্ঠিত নয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য; উন্নত বিশ্বের কতিপয় পরাক্রমশালী দেশের আধিপত্যবাদ ও খনিজসম্পদ লুন্ঠনের কূট কৌশল অবলম্বনে এবং নিগূঢ় চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের বিস্তৃত বেড়াজালে তাদেরই হীন স্বার্থ বাস্তবায়নে এ ধরনের জঙ্গি-মৌলবাদী তকমা লাগিয়ে অন্য দেশের সরকারকে দুর্বল ও পরাশক্তির ক্ষমতা সুদৃঢ় করার অপপ্রয়াস কতটুকু প্রযোজ্য তা গভীর অনুসন্ধানের দাবী রাখে। বিশ্বে সুপরিচিত জঙ্গিবাদের অন্যতম প্রবক্তা ওসামা বিন লাদেনকে ঘিরে পাকিস্তানের সামরিক শাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় আফগানিস্তানে প্রভুত্ব নিশ্চিতকরণে প্রভাবশালী দেশসমূহের কতটুকু কদর্য কর্মযজ্ঞ পরিচালিত হয়েছে তারও সুক্ষ্ণ তদন্ত প্রয়োজন। ইরাকে সাদ্দাম হোসেন, লিবিয়ার গাদ্দাফিসহ স্ব স্ব দেশে আকাশচুম্বী জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়কদের ক্ষমতাচ্যুত ও হত্যা করার আড়ালে বৈশ্বিক অপরাজনীতির কুটিল চক্রান্ত কিভাবে কার্যকর করা হয়েছে তারও বস্তুনিষ্ঠ পরীক্ষা-নিরীক্ষা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
সাম্প্রতিক ফিলিস্তিনি নিরীহ জনগণের উপর নৃশংস অমানবিক আচরণে নারী-পুরুষ হত্যাসহ সুদূর অতীত থেকে দখলদারীত্বের জঘন্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উৎস-মূলে কোন দেশ বা সরকার কিভাবে নিষ্ঠুর অভিযান অব্যাহত রেখেছে তার নিরপেক্ষ অনুসন্ধান ও আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার কার্য সম্পন্ন করাও অত্যন্ত জরুরি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার ধ্বংসসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জঙ্গিবাদী পন্থায় সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তি বা উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ড মানব ও মানবিকতাকে ধূলিসাৎ করার কুৎসিত পদক্ষেপ গ্রহণের আবিষ্কারও বিশ্বের সকল সুশীল ও সচেতন নাগরিকবৃন্দের দীর্ঘ দিনের দাবী। ইসরায়েলসহ বিভিন্ন দেশে শুধু ইসলাম ধর্মাবলম্বী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে জঙ্গি-মৌলবাদী বিশেষণে কলুষিত করা কতটুকু যৌক্তিক বা সমুচিত; তার বিচার-বিশ্লেষণের প্রায়োগিক বিবেচনা সমধিক গুরুত্ব বহন করে। অন্য সকল ধর্ম ও ধর্মাবলম্বীদের সংঘটিত হিংস্র জঙ্গিবাদী ধ্বংসযজ্ঞ নানা কদাচার-পাপাচার ও ধর্মান্ধতার নগ্ন আস্ফালনের ফলশ্রুতি কিনা; তার বিশদ পর্যালোচনার ব্যাপারে উন্নত বিশ্বের অমনোযোগী হওয়ার বিষয়টিও ক্ষত-বিক্ষত দেশসমূহের জনগণ জানার অধিকার রাখে।
আমাদের হয়তো অনেকেরই জানা যে, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রত্যয় বা আদর্শ আক্ষরিক অর্থে সংস্কৃত-বাংলা থেকে উদ্ভূত নয়। এটি ইংরেজি ‘সেকুলারিজম’ প্রত্যয়ের অনুবাদ প্রতিশব্দ। ভারতবর্ষে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনে ধর্মনিরপেক্ষতা শিক্ষাচিন্তার ইহজাগতিকতায় পরিপুষ্ট। ১৮০২ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন প্রণীত নীতি-নৈতিকতার ব্যাখ্যা সমৃদ্ধ পত্রের আলোকেই ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করে আমেরিকার সংবিধানে প্রথম সংশোধন আনা হয়। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের পর ১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটেনের লেখক জর্জ জ্যাকব হলিওয়েফ সর্বপ্রথম ভাষা ও সাহিত্যে সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি ব্যবহার করেন। প্রায় শতবছর পর খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ অন্নদাশঙ্কর রায়’র মতানুসারে; এই উপমহাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রথম রাষ্ট্র-চিন্তায় ব্যবহার করেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু। ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংজ্ঞায়িত করতে কৃতি সমাজ-দার্শনিকরা নিজ ধর্মের প্রতি আনুগত্য ও অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীল মানসিকতাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। রাষ্ট্র শাসনেও একই ধারায় সকল ধর্ম-ধর্মাবলম্বীর প্রতি যৌক্তিক সহনশীলতাকে রাষ্ট্রের মৌলিক নীতিরূপে বিবেচ্য হয়ে আসছে। অবশ্যই ধার্মিকতা ও ধর্মান্ধতার পার্থক্য নিরূপণে প্রত্যেক জাতি-রাষ্ট্রকে জাগরুক রাখতে হবে। অন্যথায় এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সমাজকে অন্ধকারের গহ্বরে নিমজ্জিত করবে – নি:সন্দেহে তা বলা যায়।
স্বীকার করতে অবশ্যই কোন দ্বিধা নেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারের জঙ্গি-মৌলবাদ নির্মূলে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি প্রভূত সাফল্য অর্জন করেছে এবং বাংলাদেশকে যথার্থ অর্থে জাতির আদর্শিক কেন্দ্রবিন্দু ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মুক্ত কাঠামোয় অবিচল আস্থার সাথে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। দেশের আপামর জনগণ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন; সকল অসৎ-অশুভ পরাজিত অন্ধকারের অচলায়তনকে বিচূর্ণ করে বাঙালি জাতি পরিপূর্ণ প্রগতির আলোকবর্তিকায় এগিয়ে যাবেই। কবি সুকান্তের ভাষায়, ‘সাবাস বাংলাদেশ এই পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়।’ দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিনশ্বর চেতনা জাতির সংসিদ্ধ মননে কতটুকু সার্থক ও কার্যকর, তার অর্থবহ বিশ্লেষণ এখনো তদর্থ প্রয়োজন।
এটি সর্বজনবিদিত যে ধর্মনিরপেক্ষ জাতিরাষ্ট্র গঠনে বিশ্বের কিংবদন্তী জাতীয়তাবাদী ও শোষিত-বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের অন্যতম কালজয়ী মহাননেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রদর্শনের জন্য বিশ্বনন্দিত। ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম কর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবো না। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারো নাই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারো বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নাই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খৃষ্টানরা তাদের ধর্ম করবে তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হল এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বৎসর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেঈমানী, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যভিচার- এই বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা চলবে না।’ এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়িক ধর্মচিন্তা তথা ধর্মনিরপেক্ষতার নবতর স্বরূপ উন্মোচন করেন।
বঙ্গবন্ধুর ধারণায় ছিল; মহাত্মা গান্ধীই ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে ভারতীয় জাতীয়তাকে সুদৃঢ় এবং ভারত-বিভাগ ও বঙ্গ-বিভাগকেও রুদ্ধ করতে পারতেন। ভারতের বিশিষ্ট বামপন্থী চিন্তক রজনী পাম দত্ত পন্ডিত জওহর লাল নেহেরুর মন্তব্যকে অনুসরণ করে বলেছিলেন, হিন্দু মুসলমান ঐক্যের জন্য জাতীয় নেতা হিসেবে গান্ধী কার্যকর ভূমিকা পালন করেননি। হিন্দু নেতা হিসেবে অর্থাৎ হিন্দুরা তাঁর কাছে “আমরা” এবং মুসলমানরা তাঁর কাছে “তাহারা” সম্বোধন করে উভয় সম্প্রদায়ের কাছে ঐক্যের আবেদন জানানোর বিষয়টি কখনো ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পরিচয় বহন করেনি। সে জন্যই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাংলার ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হাজার বছরের ঐক্যের পরিজ্ঞান ছিল বাঙালি জাতীয়তার ভিত্তি। এটি হিন্দু, বৌদ্ধ, উপজাতীয় ও মুসলমানদের একটি অনবদ্য সভ্যতা-সংস্কৃতির শাশ্বত পরিপ্রেক্ষিত। এরই ভিত্তিতে ভারতের মত এটি রাজনৈতিক ইউনিয়ন না হয়ে হাজার বছরের বাঙালির আচ্ছাদনে সাংস্কৃতিক জাতি-রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এই ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তার ভিত্তিতে অব্যাহতভাবে সুদৃঢ় করা হলেই বাঙালি জাতি, বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি বিশ্বে একটি আধুনিক জাতি হিসেবে স্বীকৃতি পাবেই।
বঙ্গবন্ধু শৈশবকালে কিছু বিরূপ পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছিলেন হিন্দু মুসলমানদের সম্পর্ক নিয়ে এবং দু’একজন মুসলমানদের হিন্দুদের দ্বারা অত্যাচারিত হতে দেখেছেন। হক সাহেব ও শহিদ সাহেবের গোপালগঞ্জের সভা আয়োজনের ব্যাপারে হিন্দু মুসলমানদের মতপার্থক্য এবং সহপাঠী মালেককে হিন্দু মহাসভার সভাপতি সুরেন ব্যানার্জির বাড়িতে ধরে নিয়ে মারধর করার কারণে বঙ্গবন্ধুকেও অন্য সহপাঠীদেরসহ মালেককে উদ্ধারের জন্য মারপিট করতে হয়েছিল এবং এক পর্যায়ে সহপাঠী মালেককে কেড়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। এই ঘটনায় এলাকার হিন্দুরা বঙ্গবন্ধুসহ অনেকের বিরুদ্ধে ছোরা নিয়ে রমাপদ দত্তকে হত্যার জন্য আঘাত করা হয়েছে বলে মিথ্যা মামলা দায়ের করেছিল। বঙ্গবন্ধুকে এর জন্য বঙ্গবন্ধুর পিতার সম্মতিতে গ্রেফতার এবং জেল হাজতে থাকতে হয়েছিল।
তাছাড়া হিন্দু বন্ধুদের আমন্ত্রণে তাদের বাড়িতে যাওয়ার কারণে বন্ধুদের অভিভাবক কর্তৃক বন্ধুদেরও অনেক বকাঝকা সহ্য করতে হয়েছে। বন্ধু ননীর সাথে সংঘটিত এই ধরনের ঘটনা সেই অঞ্চলে বাঙালি মুসলমান যুবকদের মধ্যে জাতক্রোধ সঞ্চারিত করেছিল। এভাবেই বৈরী এক পরিবেশ থেকে বেড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু কীভাবে এক অসাম্প্রদায়িক ধর্মচিন্তা ও চেতনার অনন্যসাধারণ রাজনৈতিক পরিমণ্ডল তৈরি করেছিলেন সেটি গভীর উপলব্ধির বিষয়। পিতার কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষাকে পরিপূর্ণ ধারণ করে ‘শেখ মুজিব’ ‘বঙ্গবন্ধু’ হতে পেরেছিলেন, বিষয়গুলোও তরুণ প্রজন্মের অবশ্যই জানা প্রয়োজন। ‘বাবা রাজনীতি কর আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ এ তো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না। আর একটা কথা মনে রেখ, ‘ংরহপবৎরঃু ড়ভ ঢ়ঁৎঢ়ড়ংব ধহফ যড়হবংঃু ড়ভ ঢ়ঁৎঢ়ড়ংব্থ থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না।‘ বঙ্গবন্ধু পিতার এই অমিয় বার্তাটি কোনদিন ভুলেননি।
২৮ জানুয়ারি লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিঙের সাউথ এশিয়া সেন্টার আয়োজিত বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়; তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘সমাজের সমতা প্রতিষ্ঠা এবং ধর্মকে রাজনীতির বাইরে রাখার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে মতাদর্শ, তা এখনও সারা পৃথিবীর জন্য প্রাসঙ্গিক। ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার না করার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর শক্তিশালী স্বতন্ত্র যে ধরণ ছিল, বর্তমান সময়ে তার বিস্তৃত ব্যবহার রয়েছে। যা কেবল বাংলার জন্য নয়, সারা পৃথিবীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’ অনবদ্য রচনায় অধ্যাপক সেন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান প্রণয়নে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাকে বিশেষভাবে উপস্থাপনের বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সেকুলারিজম ধারণার মানে মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে না, এমন নয়। সেটা ছিল ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার হবে না।’ তিনি বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতা দর্শন ব্যাখ্যায় ষোড়শ শতকের সম্রাট আকবরের মতাদর্শের তুলনামূলক আলোচনায় বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ও আকবরের মতাদর্শ এখনও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এটা কেবল ভারতে ব্যবহৃত হতে পারে তা নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও প্রাসঙ্গিক।’
মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠায় মহামনীষীদের জীবনচরিত ও আদর্শ-চলৎশক্তির পরিচর্যা-অনুকরণ ও অনুশীলন সমধিক অর্চণীয়। বিঘোষিত উঁচুমার্গের এই সব কীর্তিগাঁথা যথার্থ অর্থে প্রোথিত করা না হলে ইতিহাসের কালো অধ্যায়ে নষ্ট চরিত্রের অবস্থানে আমাদের নির্বাসিত করা হবে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটিই বাস্তবতা। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ) সম্পর্কে খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ উইলিয়াম মুর বলেছিলেন, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যে যুগে এই ধরিত্রীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন; তিনি শুধু সেই যুগেরই মনীষী নন বরং তিনি ছিলেন সর্বকালের, সর্বযুগের, সর্বশ্রেষ্ঠ মহামনীষী। সমাজের সামগ্রিক অসঙ্গতি, শোষণ, অবিচার, ব্যভিচার, সুদ-ঘুষসহ অপরাধমুক্ত সকলের জন্য মঙ্গল ও কল্যাণকর সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে তিনি অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। স্রষ্টার প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও অকৃত্রিম ভালোবাসা, আত্মার পবিত্রতা ও মহত্ত্ব, ক্ষমা, ধৈর্য্য, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, উদারতা ও অবিচল কর্তব্যনিষ্ঠার মাধ্যমে দীপ্র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য তিনি অনুপম উপমায় বিশ্বশীর্ষ ভূষণায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
প্রতারণা-মিথ্যাচার-দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে দেশ ধ্বংসের নতুন কদর্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নে লিপ্ত অভিশপ্ত নরপশুদের উদ্দেশ্যে দেশের বরেণ্য কবি হুমায়ুন আজাদ’র ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ কবিতার পংক্তি উপস্থাপন করতে চাই। ‘আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।/ কড়কড়ে রৌদ্র আর গোলগাল পূর্ণিমার চাঁদ/ নদীরে পাগল করা ভাটিয়ালি খড়ের গম্বুজ/ শ্রাবণের সব বৃষ্টি নষ্টদের অধিকারে যাবে।/ রবীন্দ্রনাথের সব জ্যোৎস্না আর রবিশংকরের সমস্ত আলাপ হৃদয়স্পন্দন গাথা ঠোঁটের আঙুর/ ঘাইহরিণীর মাংসের চিৎকার মাঠের রাখাল কাশবন একদিন নষ্টদের আধিকারে যাবে।/ চ’লে যাবে সেই সব উপকথা : সৌন্দর্য-প্রতিভা-মেধা;- এমনকি উন্মাদ ও নির্বোধদের প্রিয় অমরতা/ নির্বোধ আর উন্মাদদের ভয়ানক কষ্ট দিয়ে অত্যন্ত উল্লাসভরে নষ্টদের অধিকারে যাবে।’ দেশের আপামর জনসাধারণ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের তীক্ষ্ণ চেতনাবোধে উজ্জীবিত বাংলাদেশ সকল অনুপ্রবেশকারী-বর্ণচোরা-ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে অতিসূক্ষ্ণ সাম্প্রদায়িকতা পরিচর্যায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ দ্রুততর সময়ের মধ্যে চিহ্নিত ও নিগৃহীত হবেই। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অবৈধ-অনৈতিক পন্থায় তদবির-লবিং বাণিজ্যের বদৌলতে ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাঠপর্যায়ে কতিপয় ভেজাল অর্থলিপ্সু কর্তাব্যক্তিদের প্ররোচিত-প্রভাবিত প্রতিবেদনে মিথ্যার মোড়কে পদ-পদবী-পদক জনগণ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করবে। সকল চতুরতা-অভিনয় শৈলী-কূটচক্রের এসব কুশীলবদের মুখোশ উন্মোচন করে এদের উন্মুক্ত বিচরণ অচিরেই বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর অবিনাশী আদর্শিক চেতনায় ঋদ্ধ নাগরিক মহান স্বাধীনতার ইতিহাস-কৃষ্টি-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিসহ সত্য-সুন্দর-কল্যাণ-মঙ্গল-আনন্দের সকল অনুষঙ্গ এসব নষ্টদের নিধন করে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ অপরাজিত রাখতে কখনোই পিছপা হবে না- এই দৃঢ় আশাবাদটুকু ব্যক্ত করা মোটেও অযৌক্তিক বা অমূলক নয় বলেই আমার আন্তরিক বিশ্বাস।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধভাটিয়ারী মসজিদে সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ