চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়াতে এইচএসসি পর্যন্ত রুমির পড়াশোনা। ফুফাতো ভাইয়ের সাথে একই ক্লাসে ছিল সে, ফুফির সন্দেহের শিকার হয়ে কুমিল্লার নাম–ধাম না জানা এক ছেলের সাথে বিয়ে হয়। এরপর চলে আসে চট্টগ্রামের আকবর শাহতে। বাড়িতে সকলে ফুফির কথায় বিশ্বাস রাখে, ফলে ছেলের খোঁজ আর নেওয়া হয়নি। বিয়ের কিছুদিনের মাথায় জানতে পারে তার স্বামী নিজের নামের বানানও লিখতে পারে না। মায়ের অসুস্থতার কারণে আর ঝামেলায় যেতে চায়নি রুমি, মন দিয়ে সংসার করছিলো। চার বছরের এক ছেলে সন্তানও আছে কিন্তু স্বামী নেশা করে বৌ–পিটিয়ে ক্লান্ত। চাকরির নাম নেই। এখন রুমিই সংসারের হাল ধরে বাসাবাড়িতে কাজ নিয়েছে।
তাদের পাশের পাড়ায় থাকে নিশাত। বড় অফিসের কর্মকর্তা। প্রেম করে ফয়সালের সাথে বিয়ে হয়। ফয়সালও বিশাল ইঞ্জিনিয়ার। দু’জনের সুন্দর সংসারে আছে দুষ্টু–মিষ্টি সন্তান মিতাও। কিন্তু ফয়সালের একটি বদ স্বভাব হলো, অল্পতেই রেগে যায়। নিশাতের গায়ে হাত তোলে কখনো। সকলের সামনে অপমান নিত্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নিশাতের বাসাতেই সহকারী হিসেবে কাজে হাত বাড়াত রুমি। দুজনের প্রেক্ষাপট আলাদা হলেও কষ্টগুলো একই। তাদের দুজনেরই হয়তো শুনতে হয় মানিয়ে নেওয়ার কথা।
আমাদের আশেপাশে এমন অসংখ্য গল্প আছে। গল্পগুলো এতই সাবলীল যে, এখন এসবে কারো সহানুভূতি কিংবা রাগ হওয়ারও ইচ্ছা হয় না হয়তো। এমন গল্পের বাইরের দর্শক বিভা। স্বামীর সোহাগ আদরের কোনো কমতি নেই। একজন ভালো স্বামী, ভালো বাবা সর্বোপরি দায়িত্বশীল একজন মানুষ তার সঙ্গী। কিন্তু কোথাও গিয়ে জীবনের তারটা ছিঁড়ে গেছে, তাদের কথা বলার মতো কোনো বিষয় নেই। কেবল সামাজিকভাবে ভালো থেকে যাওয়া। এভাবে ভালো থাকার চাইতে বিভা বাঁচতে চায় অনুভূতিতে। যে অনুভূতির টান আর তাদের দুজনের মধ্যে নেই। ফলে বহুবছর পর নিজের মনের মত একজনের সাথে বিভার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়। বিভা সমাজের চাপকে ভুলে কিছুটা ভালো থাকা শুরু করেছিলো। সমাজও এক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেয়নি, পরকীয়ার মত ট্যাগিং–এ সমস্ত আকাশ ভরিয়ে তোলে। কিন্তু বিভার মতে, যাকে সে বন্ধু ভাবে সে তো পর নেই আর, পরকীয়া মানে তো পরের সাথে ঘটিত ক্রিয়াকে বোঝায়। বিভার তো নিজের স্বামীকে সে কবে থেকেই পর মনে হয়েছে। কই তখন তো কেউ বলেনি সে পরকীয়া করছে। বিভা জানে এই সমাজের মজ্জাতেই সংস্কৃতিটা এমন, বিদ্ঘুটে, অন্ধকারাচ্ছন্ন।
পত্রিকা পড়ার অভ্যাস প্রায় অনেকেরই গেছে। পত্রিকাতে আছেই বা কি? গুম, খুন, ধর্ষণ? সেদিনই দেখছিলাম বাংলাদেশের খুলনার এক ছোট্ট কিশোরী মেয়ে, পরীক্ষায় খারাপ করেছে, ভয়ে ঘর থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় তারই আপন খালা তাকে ভারতে পাচার করে দেয়। মাত্র ত্রিশ হাজার টাকার বিনিময়ে সেই ছোট্ট কিশোরীকে তিন মাসে ধর্ষণ করে ২২৩ জন পুরুষ। উন্নয়ন সংস্থার কর্মীরা যখন তাকে উদ্ধার করে সে বলে, আমি চাই ২২৩ জনের প্রত্যেকেই যেন শাস্তি পায় আর কিছু না। নারীর শরীর বৃত্তীয় ভাবনায় সকলেই হয়তো ভাবতে পারে বেশ্যার রূপ। এ রূপে ভাবাটা সহজ, এখানে নারীর ইচ্ছার কোনো ঝামেলা নিতে হয় না। নারীকে মানসিক এবং শারীরিকভাবে ভেঙ্গেচুরে চুরমার করা যায়। কারণ নারীর জরায়ুতেই সমাজ সংসারের সমস্ত সম্মান যেন জমা রাখা আছে।
স্বামী–পুরুষ এ দুই পক্ষের বাইনারি আলাপ থেকে বেরিয়ে অনেকেই চান ভিন্ন কোনো ন্যারেটিভ দাঁড় করাতে। মানুষের সমস্যার কথা বলতে, মানুষের জন্য মানুষের মতো বাঁচতে। কিন্তু এই বাঁচার লড়াই জটিল থেকে জটিল হয়ে যাচ্ছে কেবল পক্ষপাতমূলক কর্মকান্ডেই। নারী সমাজে মহিলা/ মেয়ে হয়েই থেকে গেলো। যখনই কোনো অন্ধকার রাস্তা দিয়ে যাই, প্রগতির গুষ্টির কেউ আর সহায় হয় না। ভয়ে হাত পা কাঁপতে থাকে। এই রাস্তা পার করে আলোর মুখ দেখলেই বাঁচি।
খুব সহজে সব ভুলে যাওয়া যায়, আদরে ভালোবাসায়। নিজের মতো সঙ্গী খুঁজে দু’পলক ভালোবাসার আদান–প্রদান প্রত্যেক মানুষের মৌলিক চাহিদা যেন। তবুও কি স্বপ্নের দেশ আমাদের? এখানে তো সংসার, ভালোবাসা, প্রেম দিনে–দিনে আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। পত্রিকা খুলেই দেখি গত সাত মাসে স্বামীর হাতে ১১৩ জন নারী খুন। অর্থাৎ প্রতি এক দিনে অন্তত একজন নারীর দাম্পত্য জীবনে মৃত্যু ঝুঁকি রয়েছে। এছাড়া নির্যাতনের ঘটনা নিশ্চয় আরো বেশি।
সাংবাদিকতার ভাষায় বলা হয়, কুকুর মানুষকে কামড়ালে সংবাদ হয় না কিন্তু মানুষ কুকুরকে কামড়ালে সংবাদ হয়। তাহলে কি নারীদের জীবনের এই যাচ্ছেতাই অবস্থা নিত্য? এখানে নিউজের কিছু নেই। গবেষণা কিংবা প্রতিরোধের কিছু নেই? নাকি পুরুষেরা সেই মানুষ যাদেরকে কিছু করলেই নিউজ হতে হবে? যেমন স্ত্রীর হাতে স্বামী খুন, পরকীয়া প্রেমিকের হাতে স্বামীর করুণ দশা, অর্থ–উপার্জনে অক্ষম তাই স্বামীকে বিষ খাইয়ে মারলেন স্ত্রী, প্রবাসে স্বামী, নোংরা কাজে লিপ্ত স্ত্রী ইত্যাদি শিরোনামে ভরপুর আমাদের নিউজফিড।
আমাদের সমাজে এধরনের কার্যক্রম চলতে থাকার পেছনে অন্যতম কারণ হলো আমাদের স্বাভাবিকতা। এই স্বাভাবিকতা কেবলই পক্ষপাতদুষ্ট কেননা কেউ ধর্ষণ হলে আমরা ধর্ষকের চাইতেও ধর্ষণের ভিডিও লিঙ্ক খুঁজতেই বেশি ব্যস্ত থাকি। এই উল্লাসই স্বাভাবিক। আমোদপ্রিয় আমরাই স্বাভাবিক। আমাদের কোনো অস্বস্তি নেই, নেই কোনো অনুযোগ। অনুভূতিশূন্য মানব যেন। বিনোদনের জন্যেই বেঁচে থাকা।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৭ মাসে দেশে ৩৬৩টি পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসবের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৩২২ জনের। ২০৮ জন নারী ও শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। আত্মহত্যা করেছেন ১১৪ জন।
সবচেয়ে বেশি হত্যাঘটনা ঘটেছে স্বামীর হাতে, ১১৩ জন নারী। স্বামীর পরিবারের সদস্যদের হাতে হত্যার শিকার হয়েছেন ৪২ জন, আর ৩৩ জন হত্যার শিকার হয়েছেন নিজ পরিবারের হাতে। এছাড়া মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, তাদের হেল্পলাইন ১০৯–এ সহায়তা চেয়েই ফোন এসেছে ৪৮ হাজার ৭৪৫ টি।
কেন এত এত নির্যাতন, হত্যার সংখ্যা? দোষীর দোষের কারণে হাজার অজুহাত থাকতেই পারে, কিন্তু নির্যাতন কিংবা হত্যার অধিকারকে আমরা বৈধ করে তুলছি। যেমন একজন স্বামী তার স্ত্রীকে খুনের কারণ হিসাবে বলেন, ছোট মাছ এনেছিলাম, রান্না করতে চায়নি তাই হামানদিস্তা দিয়ে মেরে খুন করেছি। এধরনের অদ্ভুত যুক্তি শুনে রাগ হতে পারে, মনে হবে মানসিক রোগী। কিন্ত সেই ১১৩ খুনের প্রত্যেক ঘটনাতেই দেখবেন এধরনের অদ্ভুত কারণ দর্শানো হয়েছে। আদতে খুনের কোনো কারণ থাকে না। খুনের জন্য একজন মানুষের প্রস্তুত হতে অনেক সময় লাগে। এই প্রস্তুতিটুকুর সময় দেয় আমাদের সমাজই।
ছোটবেলার শিক্ষা, সামাজিক শিক্ষা এবং সমাজে নারী–পুরুষের অবস্থানই একজন খুনীকে তার পূর্বপ্রস্তুতি নিতে সহায়তা করে। মনের ভেতর দানাবাঁধা নিম্ন চিন্তাই ধীরেধীরে খুনের দিকে ধাবিত করে। যে স্বামী স্ত্রীকে একবারের জন্যেও হাত তুলে, অপমান করে, নির্যাতন করে তার যদি তৎক্ষণাৎ বিচার হতো, শাস্তি হতো তাহলে নিশ্চয় খুনের জন্যে তার সময় হতো না হাতে।
মানুষ কি চায় এর উত্তর দেওয়া কঠিন। সমাজ শিখিয়েছে নারী কি চায় এর উত্তর দেওয়া নাকি আরো কঠিন। নারী নরম, নারীর মন দোলা দেয়, নারীর দুমুখী অজুহাত থাকে, নারীর মুডসুইং হয় ইত্যাদি নানাবিধ কিছুই তো আমরা জানি। কিন্তু আমরা জানি না, মানুষ আদতে মানুষের মতো বাঁচতে চায়। ঘৃণাকে জয় করা যায় ভালোবাসা দিয়ে। নারী তথা যে কোনো মানুষই চায়, ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে/ আমার মুখর পাখি– তোমার প্রাসাদপ্রাঙ্গণে।