বাঙালির সমাজ ইতিহাস পর্যালোচনায় যে বৈশিষ্ট্যটি সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য; তাহলো নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা সুজলা–সুফলা শস্য–শ্যামলা সোনার বাংলার সবুজ অবগাহন। এই বাংলার রূপ দেখার জন্য গভীর উপলব্ধি প্রয়োজন। চিন্তা–চেতনা ও ভাবনার প্রকৃতি আবিষ্কারে যেমন বিকশিত অন্তর অপরিহার্য, তেমনি স্বজাত্যবোধ ধারণ করার জন্য মাতৃভাষার অবদানও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। মূলতঃ মাতৃভাষায় আবেগ, ভালবাসা, শ্রদ্ধা সকল কিছুর উপস্থাপন সে ভাষার জনগোষ্ঠীর মাঝে অনবদ্য আত্মপ্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাসের বিশাল অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করে। সকল কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক এবং সচেতন মহলে বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচর্যার প্রধান বাহন হচ্ছে মাতৃভাষা। কবি জীবনানন্দ দাশ যদি মাতৃভাষা বাংলায় ‘রূপসী বাংলা’ প্রকাশ না করতেন; তাহলে বাংলাকে এত সুন্দর করে দেখার তৃতীয় নয়ন কখনো কার্যকর হতো না। ‘তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও/আমি এই বাংলার পারে রয়ে যাব/দেখিব কাঁঠাল পাতা ঝরিতেছে/ভোরের বাতাসে/দেখিব খয়েরি ডানা শালিখের/সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে/ধবল লোমের নিচে তাহার হলুদ ঠ্যাং/ঘাসে অন্ধকারে নেচে চলে/একবার–দুইবার–তারপর/হঠাৎ তাহারে বনের হিজল গাছ/ডাক দিয়ে নিয়ে যায় হৃদয়ের পাশে ….’। এমন অপরূপ দ্যোতনা অন্য কোন ভাষায় প্রকাশ করা যায় কিনা আমার বোধগম্য নয়।
ভাষাকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট কোন জনগোষ্ঠীর সুদীর্ঘকালের ঐক্যের বন্ধন ও জাগতিক সকল অনুভূতির যে সামগ্রিক প্রকাশের সাধারণ, সার্বজনীন ও সৃজনশীলতার সমষ্টিগত রূপের আবর্তন ঘটে, এ বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই। তবে এটিও সত্য যে, ভাষার অনৈক্য সত্ত্বেও পৃথিবীতে বহুজাতি বিদ্যমান। যেমন সুইজারল্যান্ডের অধিবাসিরা তিনটি ভাষায় কথা বলেন। অন্যদিকে একই ইংরেজি ভাষাভাষী হওয়া সত্ত্বেও বৃটিশ ও মার্কিনরা ভিন্ন জাতি। সর্বজনস্বীকৃত বিষয় হচ্ছে এই, মানব সংস্কৃতির পার্থিব রূপ তথা বস্তুর সৃষ্টির পেছনে অপার্থিব ধ্যাণ–ধারণা বা জ্ঞান–বিজ্ঞানের ফসলই সভ্যতার সোপান নির্মাণ করেছে। এক কথায় অনেকের মতে মানুষের বিমূর্ত চিন্তার ফসলই হচ্ছে সভ্যতা।
বস্তুতপক্ষে অবস্তুগত সংস্কৃতির প্রধান উপকরণ হিসেবে ভাষা মানুষের মনো–জগতের ভাব–কল্পনা, সাহিত্য–শিল্পকলা ইত্যকার সকল অপার্থিব ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক রূপে চিহ্নিত হয়েছে। যেহেতু অন্য কোন প্রাণীর ভাষা নেই, তাদের সংস্কৃতিও নেই। একমাত্র ভাষার কারণে মানুষ সংস্কৃতিবান হতে পেরেছে। মনীষীদের মতে এ উপমহাদেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী ভাষা হচ্ছে বাংলা ভাষা এবং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় আসীন করার লক্ষ্যে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এ উপমহাদেশে দ্বিতীয় নবজাগৃতির সূচনা করেছে। পশ্চিমা সভ্যতার ইতিহাসে ১৩০০–১৬০০ খৃষ্টাব্দের পর্যায়কে যেমন জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, কলা প্রভৃতি ক্ষেত্রে এক অভূতপূর্ব নবজাগরণের বা মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে উন্নীত হওয়ার যুগ হিসেবে ধরা হয়, তেমনি বাংলাদেশেও মূলতঃ ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্র শহীদের মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে আত্মানুসন্ধানের যাত্রাকেও নবজাগরণের সূচনাকাল হিসাবে চিহ্নিত করা যায়।
আমরা সম্যক অবগত যে, বাঙালি জাতিসত্ত্বা প্রতিষ্ঠার দীর্ঘকালব্যাপী যে স্বাধীকার আন্দোলন বা মুক্তিসংগ্রাম ও এর চূড়ান্ত পরিণতিতে সংঘটিত মহান মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীন সার্বভোম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার গৌরবোজ্জ্বল পটভূমি হচ্ছে এ মহান ভাষা আন্দোলন। পৃথিবীতে বাঙালিই একমাত্র জাতি যাঁরা রক্তের বিনিময়ে তাঁদের ভাষার অধিকার নিশ্চিত করেছেন। এ জন্যেই একুশে ফেব্রুয়ারি সারাবিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি অর্জন করেছে। একুশের ফসল ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ অশ্রুতপূর্ব সুর, আবেগ ও বেদনা মিশ্রিত এ গানটিই ছিল ফরাসী বিপ্লবের অভূতপূর্ব সৃষ্ট স্বাধীনতা ও সাম্যের গানের মতোই আমাদের স্বাধীনতা–মুক্তি–চেতনার অনন্য প্রধান বাহন। এটি ছিল দেশ ও জাতির সকল দীপ্ত জাতীয়তার অহংকার এবং অন্যায়, অবিচার, নিপীড়ন, নির্যাতনের বিরুদ্ধে দ্রোহী চৈতন্যভরা প্রতিবাদের মূল শক্তি। সকল তুচ্ছ ভয়, যন্ত্রণা–কাতর জীবনবোধকে জয় করে আলোকিত অসমপ্রদায়িক ও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার তীব্র তাগিদ ও অঙ্গীকার একুশের ভাবমূর্তিকে করেছে সুস্পস্ট ও উজ্জ্বল।
আত্ম–পরিচয় ও প্রগতির পথে পদচারণার তাগিদে একুশের আগুনছোঁয়া স্মরণ বরাবরই এ জাতিকে করে উদ্বেলিত ও উজ্জীবিত। এরই আলোকে একুশ শুধুমাত্র বেদনার স্মৃতিগাঁথা না হয়ে মুক্তির গৌরবগাঁথা হিসাবে এ জাতির জীবন সংস্কৃতির প্রধান উপাদান হয়ে গেছে। একুশকে ঘিরে বইমেলা, সংগীত উৎসব, চিত্রাংকন, কবিতা, ছড়া, সাহিত্য ইত্যাদি নবরূপে আবির্ভুত হয় প্রতিটি বছর এ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে। নতুন চিন্তা–চেতনায়, মুক্তির নতুন ধারণায়, নির্যাতন নিপীড়নের বিরুদ্ধে নতুন রচনায় এসব কর্মকান্ড একুশ মেলা নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। সনাতন কোন বিনোদনমূলক ব্যবস্থা নয়, বরং মননশীল, সুস্থ, শাশ্বত ও সাবলীল সংস্কৃতির অবগাহনে স্নিগ্ধ করে সত্য, সুন্দর, কল্যাণ ও মানবিক জীবনবোধের উদ্দীপ্ত বাসনায় প্রাণীত করে একুশের মেলা সকল স্তর, বয়স, লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও অঞ্চল নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালি জাতিকে। যদিও একুশের বই মেলার শুরুটি ছিল বড়ো করুণ, বড়ো একা, কালক্রমে স্ফুলিঙ্গের মতো দিক–বিদিক ছড়িয়ে এর বহুমাত্রিকতা পেয়েছে এক অভিনব বিশালতা।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার যে আন্দোলন সূচিত হয়েছিল তার পিছনে প্রধান রাজনৈতিক যুক্তিটি ছিল যে তৎকালীন পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৪.৬% মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। যার বিপরীতে ৬.১% ছিল পাঞ্জাবিভাষী, ২৭.১% পশতুভাষী, ৪.৮% সিন্ধিভাষী, ১.৪% ইংরেজি ভাষী। তখন উত্তর ভারত থেকে পাকিস্তানে স্থানান্তরিত মাত্র ৬% জনগণের মাতৃভাষা ছিল উর্দু। বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি, ঐতিহ্যে ও সাংস্কৃতিক সকল উপাদানের যে মূলভিত্তি তথা বাংলা ভাষাকে চরম অবহেলা করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার যে উদ্যোগ সে সময়কার শাসকদের মধ্যে কাজ করছিল তা ছিল সূদুরপ্রসারী এবং গভীর ষড়যন্ত্রের অংশবিশেষ। প্রায় ৫৫% জনগণের সামগ্রিক উন্নয়ন যে ভাষাভিত্তিক শিক্ষাকার্যক্রমের উপর নির্ভরশীল এবং এটি যে এই অঞ্চলকে আর্থ–সামাজিক ক্ষেত্রে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যাবে এই উপলব্ধি থেকেই পশ্চিমা শাসকরা প্রথম থেকেই বাংলা ভাষাকে পদদলিত করার সকল প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল।
বাংলা ভাষাকে অবহেলা করার যে প্রবণতা তা যে শুধু ব্রিটিশ শাসিত ঔপনিবেশিক এবং পাকিস্তান শাসিত অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক যুগে সমপ্রসারিত হয়েছিল তা নয়। এর বহু আগে থেকে বিশেষ করে তুর্কি শাসনের সময় থেকেই বাংলা ভাষার প্রতি বিরূপ ধারণা স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছিল। সেজন্যে মধ্যযুগে বাংলাভাষার মর্যাদাকে স্ব–শাসনে প্রতিষ্ঠাকল্পে কবি আব্দুল হাকিম তার ‘বঙ্গবাণি’ শীর্ষক এক কবিতায় লিখেছেন– “সে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণি, সে সব কাহার জনম নির্ণয় ন জানি”। এটি যে শুধু একটি ব্যঙ্গার্থক কথপোকথন বা কোন রচনার পংক্তি ছিল তা নয়, তা ছিল এই অপশাসন এবং বাংলা ভাষা অবমূল্যায়ণের বিরুদ্ধে বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর ক্ষোভ, যন্ত্রণা ও প্রতিবাদের প্রকাশ।
ভারত উপমহাদেশে বঙ্গভঙ্গ এবং পরবর্তীতে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক আমলার রোষাণলে বাঙালির ঐতিহ্য–কৃষ্টি–সংস্কৃতির মৌলিক বাহন ভাষাকেই সর্বপ্রথম আঘাত করার অপচেষ্টা করা হয়েছে। জাতীয় কবি নজরুলের ভাষায় ‘অসত্যের কাছে কভু নত নাহি হবে শীর, ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ লড়ে যায় বীর’ অনুপম প্রাণশক্তিতে ঋদ্ধ বাঙালি পাকিস্তান সৃষ্টির ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করলেও নতুন করে বঞ্চনার বেড়াজালে আবদ্ধ হওয়ার বিষয়টি গোড়া থেকেই অনুভব করতে পেরেছিলেন। সকল শোষণ–বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ বাঙালি তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রচন্ড প্রতিবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পাশাপাশি মাতৃভাষা বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা আদায়ে মরণপণ ব্রত গ্রহণ করে। ফলশ্রুতিতে রক্তক্ষরণ–জীবন বিসর্জনের নতুন অধ্যায় রচিত হয় ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি। গভীর দুঃখের সাথে স্মরণ করতে হয় শহীদ বরকত–রফিক–জব্বার ও সালামের মতো বিপুল সংখ্যক শহীদানদের জীবনের বিনিময়। বিশ্বে বিরল ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অবিনাশী পটভূমি তৈরিতে এসব শহীদানদের অবদান অবিস্মরণীয়। মাতৃভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে মহান ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর অমর একুশে ফেব্রয়ারি। ফেব্রুয়ারি মাস এ কারণেই শোক ও শক্তির অভূতপূর্ব সম্মিলন ঘটিয়ে ঐতিহ্যিক দিক থেকে মহিমান্বিত। আজ এই গৌরবদীপ্ত ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিনেই বিনম্রচিত্তে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও একই সাথে জুলাই ২৪ এর সকল শহীদদের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।
লেখক
শিক্ষাবিদ, সমাজ–অপরাধবিজ্ঞানী