ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের যাঁতাকালে পিষ্ট যখন পুরো জাতি। দাসত্বের শৃঙ্খলে জর্জরিত সমাজ ব্যবস্থা। নারীর ইজ্জত আব্রু, অশিক্ষা কু–শিক্ষার বেড়াজাল ও মোল্ল্লাতন্ত্রের ফতোয়ার তরবারীতে পুরো সমাজটাই ছিল রোগাক্রান্ত। এসব অবক্ষয় ও দাসত্ব হতে পুরো সমাজ ব্যবস্থাকে মুক্ত করার জন্য এবং পরাধীনতার শৃঙ্খল হতে জাতিকে স্বাধীনতার আলোয় উজ্জীবিত করার দৃপ্ত শপথ নিয়ে বিদ্রোহের গান গেয়ে ধুমকেতুর ন্যায় আবির্ভাব হয়েছিলেন আমাদের প্রাণের কবি, বিদ্রোহের কবি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সেসব অবক্ষয়, বিপর্যয় ও দাসত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে ছিলেন। সামপ্রদায়িকতার বিষবাষ্প হতে মুক্ত করার জন্য যুবকদেরকে যুদ্ধে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষ ও বর্তমান সময়ের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অবস্থান প্রেক্ষিতের চিত্র হুবহু একই। ঔপনিবেশিক শাসক ও শোষকদের বিরুদ্ধে নজরুলের বিদ্রোহের অগ্নি চেতনা আমাদের আজ বড় বেশি প্রয়োজন।
কবি নজরুল ইসলাম সর্বপ্রথম ১৯২৬ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রাম সফরে আসেন। তবে তারিখের বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও ভারতীয় জাতীয় নেত্রী সরোজিনী নাইডুকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। বিশিষ্ট সাহিত্য সাময়িকী বুলবুলের সম্পাদক পরবর্তীতে মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরীর বিশেষ উদ্যোগেই কবি নজরুল ও তার অগ্রজবন্ধু হেমন্ত সরকার সংবর্ধনা সভার আমন্ত্রণ গ্রহণ করে চট্টগ্রাম আসেন। কলকাতা হতে এসে কবি প্রথমে ডাকবাংলোয় উঠেন। পরে হাবিবুল্লাহ বাহার ও তার বোন বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ কবিকে তাদের মাতামহ খান বাহাদুর আব্দুল আজীজ বি,এ সাহেবের তামাকুমন্ডিস্থ (দারুল ফজল মাকের্টের দক্ষিণে) বাসভবনে নিয়ে যান। কলেজের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটিতে সভাপতিত্ব করেন কলেজ অধ্যক্ষ কামাল উদ্দিন। কবি ছিলেন প্রধান অতিথি। অধ্যাপক যোগেশ চন্দ্র সিংহ কবি প্রশস্তিমূলক ভাষণ দেন। ছাত্রদের দাবির মুখে কবি গান ও আবৃত্তি শুনিয়ে সকলকে মাতোয়ারা করে রাখেন। এ অনুষ্ঠানে কবি বিদ্রোহী ও নারী কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনান। এ সফরকালে ‘সাহিত্য পরিষদ’ ও কবিকে সংবর্ধনা দেয়। যাত্রামোহন সেন হল ও সীতাকুণ্ডেও কবিকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। ১৯২৯ সালের জানুয়ারি মাসে দ্বিতীয় বারের মত কবি চট্টগ্রাম সফরে আসেন। সে বারেও কবি হাবিবুল্লাহ বাহারের বাসভবনে অবস্থান করেন। এ সফরে কবি প্রথমে ভিক্টোরিয়া ইসলামিক হোস্টেল ও আন্দরকিল্লা মেটারনিটি হাসপাতাল সংলগ্ন খান বাহাদুর আব্দুল আজিজ বি,এ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মুসলিম এডুকেশন সোসাইটির ত্রিশতম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দেন। অনুষ্ঠানের পরদিন কমরেড মুজাফফর আহমেদের ভ্রাতুস্পুত্র তখনকার তরুণ সংস্কৃতি কর্মী আব্দুল মোকতাছির ও সলিমুল্লাহ চৌধুরী প্রমুখরা এসে কবিকে সন্দ্বীপ নিয়ে যান। সেখানে সন্দ্বীপের কার্গিল হাই স্কুল মাঠে কবিকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। এ সংবর্ধনায় বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ কবিকে মানপত্র প্রদান করেন। সভাশেষ করে কবি কবি বন্ধু কমরেড মোজাফফর আহমদের গ্রামের বাড়িতে চলে যান। সেখানে বন্ধুর সান্নিধ্যে দু’দিন ঘুরে বেড়ান কবি। পরে সেখান হতে ফিরে চট্টগ্রামে এসে অপর বন্ধু হাবিবুল্লাহ বাহারের বাড়িতেই উঠেন। জানুয়ারি মাসের ১১ তারিখ শুক্রবার কাট্টলী গ্রামে কবিকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন দারুল উলুম মাদ্রাসার সুপারিনটেন্ডেন্ট ও চট্টগ্রামের প্রথম মুসলমানদের ছাপাখানা ইসলামাবাদ প্রেসের প্রতিষ্ঠাতা মৌলানা তমিজুর রহমান। এসভায় সভার সভাপতি কর্তৃক একটি স্বরচিত কবিতার মাধ্যমে কবিকে অভিনন্দিত করেন। সভায় নজরুল একটি গান এবং শিক্ষা ও সভ্যতা সম্পর্কে প্রায় দু’ঘণ্টাব্যাপী বক্তৃতা প্রদান করেন।
মুসলিম এডুকেশন সোসাইটির ত্রিশতম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামের কতিপয় মৌলবাদী ও সামপ্রদায়িকতা সৃষ্টিকারী আলেম নামধারী ব্যক্তিদের বিরোধীতার মুখে পড়েন কবি। এ অনুষ্ঠানে কবিকে দেয়া মানপত্রের জবাবে কবি বলেন, ‘আপনাদের শক্তি আছে, অর্থ আছে, যদি পারেন মাতৃভাষায় আপনাদের সাহিত্য, জ্ঞান বিজ্ঞান, ইতিহাস সভ্যতার অনুবাদ ও অনুশীলনের কেন্দ্রভূমি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করুন। তা না পারলে অনর্থক ধর্ম ধর্ম বলে ইসলাম বলে চিৎকার করবেন না। ——– আমার বিদ্রোহী কার বিরুদ্ধে তা কিন্তু আলেম সমাজ বুঝতে পারেন নি। যারা বুঝেছেন তারা আমাকে এক বছরের জন্য জেলে অন্তরীন রেখেছেন। আমি কবি আমার মুখ হতে কবিতা ছাড়া আর কিছুই বের হয় না। কোকিলকে সারাদিন ঠেঙ্গালেও তার মুখ হতে ‘কু’ ছাড়া ‘ক’ বের হবে না”। এ অনুষ্ঠানে তিনি অনেক ইসলামী গজল ও ইসলামী সঙ্গীত গেয়ে শুনিয়েছিলেন। যা পরবর্তী আলেম সমাজ ইসলামী সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে ধারণ করে নিয়েছেন।
রাউজান থানা তরুণ কনফারেন্স ও শিক্ষা সম্মিলনী অনুষ্ঠানে কবিকে দাওয়াত দেয়ার জন্য রাউজানের মোহাম্মদপুর তরুণ সংঘের সভাপতি ও মোহাম্মদপুর হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা নুরুল আবছার চৌধুরী ও তার ভাই সংঘের সাধারণ সম্পাদক নুরুল হুদা শিক্ষাবিদ ড. মুহাম্মদ এনামুল হককে সাথে নিয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলামের শ্যামবাজারস্থ বাসায় যান। রাউজান থানা তরুণ কনফারেন্স ও শিক্ষা সম্মিলনী অধিবেশনের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার জন্য কবিকে তারা অনুরোধ জানালে কবি তাতে সম্মতি দেন।
সে অনুযায়ী ১৯৩২ এর মে মাসে কবি এ সম্মেলনে যোগদানের জন্য শেষ বারের ন্যায় চট্টগ্রাম সফরে আসেন। ৪ মে তিনি বন্ধু হাবিবুল্ল্লাহ বাহার, কবি দিদারুল আলম, সাহিত্যিক মাহবুব উল আলম প্রমুখ সাহিত্য সংস্কৃতিসেবীগণ সহ বন্ধু বাহারের শহরস্থ বাসভবন হতে ফতেয়াবাদ কবি দিদারুল আলমের গ্রামের বাড়িতে যান। সেখানে কবিকে এক সংবর্ধনাও দেয়া হয়। সে সংবর্ধনায় কবি নজরুলের সাথে কবি ওহিদুল আলমের পরিচয় ঘটে। সেদিন কবি আলম পরিবারের বাড়িতে রাত কাটান। আলম পরিবারের সাথে সখ্যতা দীর্ঘদিনের। যে মূল উদ্দেশ্যে কবির চট্টগ্রাম আগমন সে রাউজানের অনুষ্ঠানের স্থান নির্ধারণ করা হয় গ্রামের রায় মঙ্গলের দিঘির পূর্ব দিকের খোলা মাঠে। উপরে ছনের ছাউনিযুক্ত বিরাট প্যান্ডেল তৈরী করা হয়। দর্শকদের কাছ হতে চার আনা, আট আনা ও পাঁচ টাকা করে প্রবেশ পত্র বাবদ ফি নেয়া হয়। ৫ মে সভা শুরু হয় বেলা দুটোয়। চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার খান বাহাদুর আব্দুল মোমেন এ অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেন। এ অনুষ্ঠানে আবুল ফজল, কামাল উদ্দিন খান, হাবিবুল্লাহ বাহার, মাহবুব উল আলমও যোগদান করেন। অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী ভাষণ দেন ড. মুহাম্মদ এনামুল হক। প্রধান অতিথি কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদী পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক নজির আহমদ চৌধুরীর বক্তৃতার পর বক্তৃতা আরম্ভ করেন। কবি এ সভায় তার রচিত ‘সাম্যবাদী’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন। হারমোনিয়াম নিয়ে গান গেয়ে উপস্থিত সকলকে মাতিয়ে রাখেন। চল চল চল, গীতটি এবং ইসলামী গজল পরিবেশন করে প্রায় রাত বারোটা পর্যন্ত হাজার হাজার শ্রোতার হৃদয়ে আনন্দের বন্যা বয়ে দিয়েছিলেন কবি–গীতিকার ও সঙ্গীতজ্ঞ কাজী নজরুল ইসলাম।
৬ মে শিক্ষা সম্মিলনী অধিবেশন শুরু হয় দুপুরে। এ সভায় সাহিত্যবিশারদ মুন্সি আব্দুল করিম সভাপতিত্ব করেন। উদ্বোধনী ভাষণ দান করেন ড. মুহাম্মদ এনামুল হক। অতঃপর কবি নজরুল প্রধান অতিথির ভাষণ শুরু করেন। অগণিত শ্রোতার করতালির মধ্যদিয়ে কবি তার ভাষণ শেষ করেন। এসভায় সভাপতির ভাষণের পর কবি আবার মঞ্চে বসে হারমোনিয়াম নিয়ে গানের আসর জমান।
অনুষ্ঠান শেষে এখন কবিকে রাউজান হতে বিদায় দেয়ার পালা। কবিকে বিদায় দেয়ার জন্য শত শত লোক সমবেত হয়েছিল। চট্টগ্রাম শহরে ফিরে আসার পথে গহিরাবাসী যুবকেরা কবিকে গাড়ি হতে নামিয়ে গহিরা স্কুলে তাৎক্ষণিক সংবর্ধনা দেয়। কবি এ সংবর্ধনায় কাণ্ডারী হুশিয়ার সহ কয়েকটি গান গেয়ে শোনান। সর্তাঘাট হতে নৌকা করে কবি চট্টগ্রাম শহরে আসেন। সে রাতে কবিকে মাদারবাড়ি যুব সংঘ কর্তৃক সংবর্ধনা দেয়া হয়। সেখানেও সমবেতদের নিয়ে কবি গান ও আবৃত্তিতে মেতে উঠেন।
৮ মে কবি ‘চট্টগ্রাম সাহিত্য সম্মেলনে’ প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন। এ সম্মেলনেও সভাপতিত্ব করেন আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ। এ সম্মিলনের অভ্যর্থনা কমিটি সভাপতি ছিলেন ড. মুহাম্মদ এনামুল হক। কমিটির সদস্য হিসেবে অন্যদের মধ্যে ছিলেন নাজির আহমদ চৌধুরী, কবি আব্দুল কাদির, অধ্যাপক আবুল ফজল, সাহিত্যিক মাহবুব–উল–আলম, সাহিত্যিক হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী, কামাল উদ্দিন আহমদ খান ও কবি ওহীদুল আলম।
উপর্যুক্ত বিষয়াদি ছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের চট্টগ্রাম সফরের ইতিকথা। তিন দফায় চট্টগ্রাম সফরে কবি মোট ১১ টি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ সফরকালে কবি সিন্ধু, হিল্লোল, গোপন প্রিয়া, অনামিকা, বাতায়ন পাশে গুবাক তরুক সারি সহ অগনিত আলোচিত কবিতা রচনা করেন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদক– শিল্পশৈলী।