স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ৫ আগস্টের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি হয়েছে। তবে হয়তো সেটা জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী খুব সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছেনি। এ ব্যাপারে আপনাদের সাহায্য এবং সহযোগিতা চাই। পরিস্থিতির অবশ্যই উন্নতি হবে। পুলিশের মনোবল আগের চেয়ে বেড়েছে। মনোবল দুইদিনে চেঞ্জ হয় না। একটু সময় লাগে। আপনারা সময় না দিলে এটা সম্ভব না। আমার কাছে জাদুর মতো কিছু নাই যে বললেই সব হয়ে যাবে। গত মঙ্গলবার দুপুরে নগরীর দামপাড়া পুলিশ লাইনের মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের সাথে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন।
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার প্রথম ১০০ দিনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গত ৫ই অগাস্ট পরবর্তী সময়ে পুলিশের অনুপস্থিতি এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ছিনতাই, ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ড জনমনে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে। ভুক্তভোগী এবং সাধারণ মানুষ সবাই বলছেন অপরাধ দমনে সরকারকে ‘আরো কঠোর‘ হতে হবে। এখানে উল্লেখ্য, গত ১০ নভেম্বর রোববার ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের সানাড়পাড় বাস স্ট্যান্ডে এক পুলিশ সদস্যকে ‘ভুয়া পুলিশ‘ আখ্যা দিয়ে গণপিটুনি দেয়া হয়েছে। সিদ্ধিরগঞ্জ থানার পুলিশ জানায়, আক্রান্ত ব্যক্তি ভুয়া পুলিশ নন বাংলাদেশ পুলিশের একজন সদস্য। পকেটমার ভুয়া পুলিশ গুজব রটিয়ে তাকে গনপিটুনি দেয়ার ব্যবস্থা করে। বিবিসির প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, রাজধানী ঢাকার মধ্যে মোহাম্মদপুর এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির বিষয়টি সবচেয়ে আলোচিত হয়েছে। সেখানে বিহারী ক্যাম্পে খুনোখুনি, প্রকাশ্যে ছিনতাই, ডাকাতি, সশস্ত্র মহড়ার ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি উন্নতির জন্য মোহাম্মদপুরে বিশেষ অভিযান হয়েছে। জেনেভা ক্যাম্পসহ বিভিন্ন স্থান থেকে শতাধিক সন্দেহভাজনক আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে। কিন্তু এখনো মানুষের আতঙ্ক কাটেনি বলেই জানান এলাকার বাসিন্দারা। তাদের ভাষায়, “এখন পরিস্থিতি ভয়াবহ। কেমন যেন একটা আতঙ্কে আছি আমরা। আগে রাতে বারোটা একটায় মানুষ যাইতে পারছে বাইরে। এখন তো মানুষ ভয়ের চোটে বাইরও হয় না।”
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসেবে গত তিন মাসে গণপিটুনিতে খুন হয়েছেন অন্তত ৬৮ জন। এসময়, ধর্ষনের ঘটনা ৭৮টি। একই সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুরাও হামলার শিকার হয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান জেড আই খান পান্না বলেন, “নরসিংদী কারাগার থেকে যে জঙ্গীরা বের হইছিল সেটার ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নিছে। সেখান থেকে যে আর্মসগুলো লুট হইছিল সেগুলো কতটা উদ্ধার হইছে। সেগুলো নিছিলো কে? তারপরে রাতারাতি আমরা দেখলাম যে সাজাপ্রাপ্ত দীর্ঘদিন যাবৎ চিহ্নিত সন্ত্রাসী মুক্তি পাইছে কারাগার থেকে। কী গ্রাউন্ডে পাইলো না পাইলো কিছুই জানি না। এইগুলাতো হতাশা আনে।”
আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতির এই নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যেই পুলিশবাহিনীকে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। পুলিশবাহিনী সংস্কারের এই উদ্যোগ ইতিবাচক হলেও এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় দৃশ্যমান অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার তিন মাস পরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নাজুক অবস্থা জনমনে ক্ষোভ ও হতাশার জন্ম দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য শক্তিশালী, কঠোর ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। দ্রুততম সময়ের মধ্যে অপরাধীকে শনাক্ত ও বিচারের আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে, কমিউনিটি পুলিশিংয়ের কার্যক্রমকে শক্তিশালী করে জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি এবং সামাজিক বন্ধন পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা অপরিহার্য। তৎক্ষণাৎ ও কার্যকর পদক্ষেপ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির এই ধারা বৃহত্তর সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট ডেকে আনতে পারে। তাই যেকোনো মূল্যেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে সমাজে শান্তি–শৃঙ্খলা ফেরাতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এলাকাভিত্তিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা না গেলে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এসব দুর্বৃত্তায়ন রোধ করা দুরূহ ব্যাপার বটে। মসজিদ–মন্দির ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে নিয়মিত নীতি নৈতিকতা ও মনুষ্যত্বের বক্তব্য প্রচার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে বিশেষ করে তরুণ–যুবকদের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে অপরাধ দমনের নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।