দ্বিতীয় সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার আনন্দ মুছে গেল প্রথম সন্তানকে হারিয়ে। নিখোঁজের দুদিন পর গতকাল ডোবায় মিলল ঢাকার ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম জুয়েলের প্রথম সন্তানের লাশ। নগরীর হালিশহর ‘এ’ ব্লক বাস স্ট্যান্ডের কাছে নির্মাণাধীন একটি ভবনের ডোবা থেকে মো. মেহেরাজ ইসলাম আরিয়ানের (৬) লাশটি উদ্ধার করা হয়। আরিয়ান পাহাড়তলী থানার শাপলা আবাসিক এলাকায় নানার বাসায় বেড়াতে এসেছিল। যেখান থেকে আরিয়ানের লাশ উদ্ধার করা হয় তার অদূরেই নানার বাসা। গত মঙ্গলবার বিকালে বাসা থেকে বের হয়ে সে নিখোঁজ হয়।
জানা যায়, ঢাকার ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম জুয়েলের দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হয় গত ৭ আগস্ট। সাইফুলের শ্বশুর মো. মঈনউদ্দীন তাঁর মেয়ে ও নাতি-নাতনিকে ১৮ আগস্ট শাপলা আবাসিক এলাকায় নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন। উদ্দেশ্য নবজাতক ও তার মায়ের দেখাশোনা করা। কিন্তু সাইফুল দম্পতির আনন্দ বিষাদে পরিণত হল বড় ছেলেকে হারিয়ে। আজাদীর কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে পুত্রশোকে কাতর সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ভাই, কী বলব? এসে আমার ছেলের ডেডবডি পাইছি। মেরে ফেলে গেছে আমার ছেলেটাকে।’
সাইফুল ইসলাম জুয়েল ঢাকার নাখালপাড়ায় সপরিবারে বসবাস করেন। আগামী সপ্তাহে পরিবার নিয়ে তাঁর ঢাকায় ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। আগামী জানুয়ারিতে শিশু আরিয়ান স্কুলে ভর্তি করার কথা। স্বজনদের দাবি, এটি সুস্পষ্ট হত্যাকাণ্ড। হালিশহর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, ‘আমরা ময়নাতদন্তের পর নিশ্চিত হতে পারব। ধারণার উপর ভিত্তি করে মন্তব্য করতে চাই না। সিআইডির ক্রাইমসিন ইউনিট বিভিন্ন আলামত জব্দ করেছে। মামলার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।’
হালিশহর ওসি রফিকুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, ‘গত ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যা ছয়টার দিকে আরিয়ান নানার বাসা থেকে কাউকে কিছু না বলে বের হয়ে আর ফিরে আসেনি। এ ঘটনায় তার মা মারজান আক্তার ওই রাতেই পাহাড়তলী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন। এছাড়া এলাকাতে মাইকিং করা হয়েছিল। আজ (গতকাল বৃহস্পতিবার) দুপুরে স্থানীয়রা আমাদের জানায়, শাপলা আবাসিকের বিপরীতে হালিশহর থানাধীন দারুল ফোরকান মাদ্রাসার পাশে নির্মাণাধীন একটি ভবনের ভেতর জমে থাকা পানিতে এক শিশুর লাশ ভাসছে। এর মধ্যে পাহাড়তলী থানার ওসির সাথে যোগাযোগ করা হলে জানতে পারি, সেখানে ছয় বছরের আরিয়ানের নিখোঁজ সংক্রান্ত জিডি করেছেন তার মা। শিশুটির পরনে একটি গেঞ্জি ও হাফ প্যান্ট ছিল। তা দেখে তার স্বজনরা শনাক্ত করেন যে এটি আরিয়ানের লাশ।
গতকাল দুপুরে সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, লাশটি যে প্লটে পাওয়া গেছে সেই প্লটে ভবন নির্মাণের জন্য পাইলিংয়ের কাজ হয়েছে। ভবন নির্মাণ বন্ধ থাকায় সেখানে দুই/আড়াই ফুট পানি জমে ক্ষুদে পানায় ভরে গেছে। সেই পানিতে উল্টো হয়ে ভাসছে শিশু আরিয়ান। ওসি হালিশহরের উপস্থিতিতে দু’জন পানিতে নেমে তুলে আনে আরিয়ানের লাশ। এসময় দেখা যায়, তার মৃতদেহ পচে ফুলে গেছে। হাত-পাগুলো ছড়ানো অবস্থায় শক্ত হয়ে আছে। তার পরিধেয় প্যান্টটি উল্টো করে পড়া। পারে তার স্যান্ডেলগুলোও পাওয়া গেছে। থানা পুলিশের পাশাপাশি সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে আলামত সংগ্রহ করে। লাশ ফুলে যাওয়ায় তার শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন আছে কিনা তাৎক্ষণিক ভাবে জানাতে পারেননি ওসি হালিশহর। আরিয়ানের লাশ পানি থেকে তুলে আনার পর উপস্থিত স্বজনদের মাঝে কান্নার রোল পড়ে যায়। এসময় ভিড় করা সাধারণ অনেক মানুষও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।
আরিয়ানের বাবা সাইফুল ইসলাম জুয়েল বলেন, আমার ছেলে খেলতো বাড়ির সামনেই। রাস্তা পার হয়ে সন্ধ্যার সময় এখানে এসে পানিতে নামবে, আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি না। তাছাড়া বাসা থেকে বের হয়ে একা একা এতদূর আসা তার পক্ষে সম্ভবও নয়। কারণ সেতো এই এলাকার কিছুই চিনে না। এখন পুলিশ, সিআইডির উপর ভরসা করে আছি। এটা হত্যাকাণ্ড ছাড়া কিছুই নয়। আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। আরিয়ানের মামা আবদুর রহমান বলেন, সুষ্ঠু বিচার চাই। কেন মাসুম বাচ্চাটাকে খুন করা হলো, বুঝতে পারছি না।
আরিয়ানের খালু ফরহাদ বলেন, ‘আগের দিনও সে আমার সাথে খেলছে। ২৭ তারিখ রাতে আমিসহ গিয়ে থানায় জিডি করেছি। মাইকিং করা হইছে। কিন্তু বাচ্চারেতো আর পাইলাম না।’ তিনি বলেন, ‘আমার বিয়ে হয়েছে আড়াই বছর। এই ক’বছরে আরিয়ানের বাবার পরিবার কিংবা আমার শ্বশুরের পরিবারের কারো সাথে কোনো পারিবারিক বিরোধ বা রাজনৈতিক বিরোধ আছে, এমনটি দেখিনি। এমনকি পাড়া প্রতিবেশীর সাথেও তাদের কোনো মনোমালিন্য ছিল না। আল্লাহর কাছে বিচার চাইছি, যেন এ জঘন্য ঘটনা যে বা যারা ঘটিয়েছে, তাদের যেন উপযুক্ত বিচার হয়। আইনশৃক্সখলা বাহিনীর উপরও ভরসা আছে। দেখি কী হয়।’