দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত একমাত্র জ্বালানি তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণ প্রকল্প বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এস আলম গ্রুপের সাথে সরকারের সম্পাদিত চুক্তি বাতিল করে দেয়া হয়েছে। গেলো বুধবার ঢাকায় উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠক থেকে ইস্টার্ণ রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণ প্রকল্পের সব কার্যক্রম বন্ধ রাখার এ নির্দেশনা দেয়া হয়। অপরদিকে প্রকল্পটির পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তির মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। এখন সবকিছু নতুন করে শুরু করার মাধ্যমেই কেবলমাত্র ইস্টার্ণ রিফাইনারির সেকেন্ড ইউনিট স্থাপন প্রকল্প আলোর মুখ দেখবে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দেশে বর্তমানে জ্বালানি তেলের চাহিদা ৭০ লাখ টনেরও বেশি। এই বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেলের খুব সামান্য অংশই দেশে পরিশোধন করার সুযোগ রয়েছে। ইস্টার্ণ রিফাইনারি বছরে সর্বসাকুল্যে ১৪ লাখ টনের মতো জ্বালানি তেল পরিশোধন করতে পারে। বাকি প্রায় সব তেলই বিদেশ থেকে পরিশোধিত অবস্থায় আমদানি করতে হয়। ক্রুড অয়েল থেকে রিফাইনড অয়েলের মূল্য বেশ চড়া। এতে দেশের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে। ক্রুড অয়েল আমদানি করে দেশে পরিশোধনের সক্ষমতা বাড়ানো গেলে জ্বালানি নিরাপত্তার পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা রক্ষা পেতো। কিন্তু ইস্টার্ণ রিফাইনারিতে পরিশোধন ক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব না হওয়ায় দেশে ক্রুড অয়েল আমদানি বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রায় বাড়তি অর্থ ব্যয় করে পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করতে হচ্ছে। ইস্টার্ণ রিফাইনারির সক্ষমতা বাড়ানো গেলে এই বাড়তি খরচ সাশ্রয় করা সম্ভব হতো বিশেষজ্ঞদের এমন পরামর্শের প্রেক্ষিতে ১৯৬৮ সালে নির্মিত দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত রিফাইনারিটির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২০১০ সালে গ্রহণ করা হয় ইস্টার্ণ রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণ প্রকল্প। বছরে ৩০ লাখ টন জ্বালানি তেল পরিশোধনের ক্ষমতাসম্পন্ন ইস্টার্ণ রিফাইনারি–২ নামে নতুন একটি রিফাইনারি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পটির ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৩ হাজার কোটি টাকা। পতেঙ্গায় ইস্টার্ণ রিফাইনারির ২শ’ একর জায়গার একপাশের ৭০ একর জায়গায় দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে ঢিমেতালে চলা প্রকল্পটির ব্যয় ইতোমধ্যে ২৩ হাজার ৫৯ কোটি টাকায় ঠেকেছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) নানাভাবে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করে সফল না হওয়ার পর সরকারের কাছে একটি প্রস্তাবনা দিয়েছিল। যাতে বিপিসি ৩০ শতাংশ অর্থ যোগান দেয়ার প্রস্তাব করে বাকি ৭০ শতাংশ অর্থ সরকারের তহবিল থেকে ঋণ হিসেবে নেয়ার প্রস্তাব দেয়। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাবটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে সরকার এতে অর্থায়নের সম্মতি জানিয়েছিল। প্রকল্পের সর্বমোট ২৩ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকার মধ্যে সরকার ১৬ হাজার ১৪২ কোটি টাকা এবং বিপিসি ৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা প্রদান করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। প্রকল্পের বাকি ৪৯৩ কোটি টাকার সংস্থান না হওয়ায় তা বিপিসি যোগান দেয়ার ব্যাপারেও সম্মত হয়েছিল।
সরকারি তহবিল থেকে নেয়া ১৬ হাজার ১৪২ কোটি টাকার ঋণ বিপিসি ২০ বছরের মধ্যে ৫ শতাংশ সুদসহ পরিশোধ করার কথা। বিষয়টি নিয়ে বেশ কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পরই উদয় হয় এস আলম গ্রুপ। তারা প্রকল্পটিতে অর্থায়নের প্রস্তাব দেয়। ‘ইনস্টলেশন অব ইআরএল ইউনিট–২’ শীর্ষক প্রকল্পটি ইআরএল এবং এস আলম গ্রুপের সাথে এমওইউ স্বাক্ষর করা হয়।
এস আলম গ্রুপের পক্ষ থেকে ৩০ লাখ টনের পরিবর্তে ৫০ লাখ টন শোধনের ধারণক্ষমতা করার প্রস্তাব দেয়া হয়। এতে প্রকল্প ব্যয় ২৩ হাজার কোটি থেকে বেড়ে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা হবে বলেও ঠিকঠাক করা হয়।
এস আলম গ্রুপের সাথে যৌথভাবে ইস্টার্ণ রিফাইনারি নির্মাণের ব্যাপারে নানা প্রক্রিয়া চালানো হয়। প্রকল্পের ডিপিপি প্রস্তুত করে দেয়া হয় মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয় থেকে ফাইল পাঠানো হয় প্রধানমন্ত্রীর দফতরে। ওখান থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসার আগেই কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে সৃষ্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতন হলে ইস্টার্ণ রিফাইনারি দ্বিতীয় ইউনিটের সব কার্যক্রমই মূলত থেমে যায়। ইতোমধ্যে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে এস আলম গ্রুপ দিশেহারা।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গত বুধবার ঢাকায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে এস আলমের সঙ্গে করা চুক্তি বাতিল করা হয়। বাতিল করা হয় পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের বিষয়টিও। মন্ত্রণালয়ে জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাউজুল কবির খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রকল্পটির ডিপিপি বৈদেশিক মুদ্রার হালনাগাদ রেট অনুযায়ী প্রাক্কলন এবং সব ধরনের ক্রয় পরিকল্পনা পিপিআর–২০০৮ অনুযায়ী প্রণয়ন করতে বলা হয়েছে। এরপর পুনর্গঠিত ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠাতে বিপিসিকে চিঠি দেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয় ওই বৈঠকে।
সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেছেন, প্রকল্পটির পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ছিল ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্ডিয়া লিমিটেড। ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানটির সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল বিপিসি। ইতোমধ্যে ওই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের চুক্তির মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। এখন নতুন করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করেই প্রকল্পটি শুরু করতে হবে বলেও ওই শীর্ষ কর্মকর্তা জানান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, আপাততঃ ইস্টার্ণ রিফাইনারির সেকেন্ড ইউনিট বাস্তবায়নের কার্যক্রম মূলতঃ আবার নতুন করে শুরু করতে হবে।
উল্লেখ্য, ইস্টার্ণ রিফাইনারি আমদানিকৃত ক্রুড অয়েল পরিশোধন করে পেট্রোল, অকটেন, ডিজেল, বিটুমিন, এলপিজি, জেট ফুয়েলসহ ১৭ ধরনের পেট্রোলিয়াম প্রোডাক্ট উৎপাদন করে।