বাংলাদেশের দ্বাবিংশতম রাষ্ট্রপতি হিসেবে ‘সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধানের’ শপথ নিলেন মো. সাহাবুদ্দিন।
আইন পেশা, বিচারালয় ও দুদকে দায়িত্ব পালনের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের পর তিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন হলেন। তিনি বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের উত্তরসূরি হলেন। গত সোমবার সকালে বঙ্গভবনের দরবার হলে তাকে শপথ পড়ান জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। এই শপথের মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্রপতি হিসেবে টানা দুই বারের মেয়াদ শেষ হল আবদুল হামিদের। তিনিই বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি দিন দায়িত্ব পালন করা রাষ্ট্রপ্রধান। সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে ৪১ দিনসহ টানা দুই মেয়াদে ১০ বছর ৪১ দিন রাষ্ট্রপতি হিসেবে অতিবাহিত করে বিদায় নিলেন তিনি। আমরা নতুন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে জানাই অভিনন্দন।
মো. সাহাবুদ্দিন ১৯৪৯ সালে পাবনা শহরের জুবিলি ট্যাঙ্কপাড়ায় (শিবরামপুর) জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শরফুদ্দিন আনছারী ও মাতা খায়রুন্নেসা। তিনি পাবনা শহরের পূর্বতন গান্ধি বালিকা বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করে রাধানগর মজুমদার একাডেমিতে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৬৬ সালে এসএসসি পাস করার পর পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে এইচএসসি ও ১৯৭১ সালে (অনুষ্ঠিত ১৯৭২ সালে) বিএসসি পাস করেন। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এবং পাবনা শহিদ অ্যাডভোকেট আমিনুদ্দিন আইন কলেজ থেকে ১৯৭৫ সালে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্রজীবনে পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ও সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মো. সাহাবুদ্দিন মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। পাবনা জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য হিসেবে মো.সাহাবুদ্দিন আইন–পেশায় যোগ দেন এবং ১৯৮২ সাল পর্যন্ত এই পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। পরে ১৯৮২ সালে বিসিএস (বিচার) ক্যাডার হিসেবে যোগ দেন মো. সাহাবুদ্দিন। বিচারকের বিভিন্ন পদে চাকরি শেষে ২৫ বছর পর ২০০৬ সালে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে অবসর নেন। ২০০১ সালে বিএনপি–জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পরপরই আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা হয়। যাতে হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটে। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে ওসব ঘটনার তদন্তে কমিশন গঠন করেন, যার প্রধান ছিলেন মো. সাহাবুদ্দিন। ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মো. সাহাবুদ্দিন দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের অন্যতম কাণ্ডারি হিসেবে পরিচিত মো. সাহাবুদ্দিন পাবনা ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের সভাপতিও। মো. সাহাবুদ্দিন ১৯৯৫ ও ১৯৯৬ সালে পরপর দুইবার বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির মহাসচিব নির্বাচিত হন। পেশাগত জীবনে প্রথম দিকে সাংবাদিকতাও করেছেন। তিনি পাবনা প্রেসক্লাব ও অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরির জীবন–সদস্য। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে মো. সাহাবুদ্দিনকে সামরিক আইন বলে গ্রেপ্তার করে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। কারাভোগের পর মুক্ত হলে তিনি পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। দুদকের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বিশ্বব্যাংকের কথিত পদ্মা সেতু সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করা মো. সাহাবুদ্দিন অভিযোগটি মিথ্যা ও অন্তঃসারশূন্যতা প্রমাণে সমর্থ হন। তার প্রেরিত তদন্ত প্রতিবেদন কানাডা কোর্ট কর্তৃক সমর্থিত হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, মো. সাহাবুদ্দিন এমন এক সময়ে দেশের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হলেন, যখন জাতি রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক দিক থেকে একটি সংকটকাল অতিক্রম করছে। আগামীতে আসছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানা রকম মেরুকরণ হবে বিভিন্ন দলের, আদর্শেরও মেলবন্ধন ঘটবে। এ নিয়ে এখন থেকে শুরু হয়েছে পক্ষ–বিপক্ষে কথা–বার্তা। রয়েছে মত–ভিন্নতা। এমন পরিস্থিতিতে জাতিকে সুস্থ ও সঠিক মতের প্রদর্শনের মাধ্যমে এগিয়ে নেওয়ার জন্য দরকার সুদৃঢ় ব্যক্তিত্ব। রাষ্ট্রপতি পদটা যেহেতু দলনিরপেক্ষ, সেহেতু তাঁর কাছে জাতির অনেক প্রত্যাশা। আমাদের সকলের প্রত্যাশা, তিনি জাতিকে এমন দিকনির্দেশনা দেবেন, যাতে জাতি সঠিক পথে অগ্রসর হতে পারবে। আমরা নতুন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের দীর্ঘ ক্যারিয়ার দেখে আশান্বিত যে, তিনি আমাদের সবার ঐক্যের প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হবেন। আমরা এটাও আশা করবো, একজন অভিভাবক হিসাবে জাতিকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা হবে সুন্দর ও মসৃণ।