প্রতি বর্ষায় ভারী বর্ষণে ডুবে নগরের বেশিরভাগ এলাকা। জলাবদ্ধতায় কষ্ট পান নগরবাসী। এ জলাবদ্ধতার জন্য পরস্পরকে ‘দোষারোপ’ করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) ও সিডিএ। তবে এবার দোষারোপের এর সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করে নগরবাসীকে আসছে বর্ষায় জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে চান দুই সংস্থা প্রধান। বর্ষাকে সামনে রেখে গতকাল বুধবার সকালে নগরের মোগলটুলী এলাকায় খাল পরিষ্কার কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন এবং সিডিএ চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নুরুল করিম এমন ইঙ্গিতই দিয়েছেন। এসময় মেয়র বলেন, সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। সিডিএ চেয়ারম্যান বলেন, সিডিএ ও সিটি কর্পোরেশন এখন একটি টিম হিসেবে কাজ করছে।
জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান মেগা প্রকল্পের আওতায় মোগলটুলী খাল পরিষ্কার কর্মসূচি গ্রহণ করে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। কর্মসূচির উদ্বোধনকালে উপস্থিত ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল মো. ফেরদৌস আহমেদ ও প্রকল্প কর্মকর্তা মেজর কামরুল আল মাসুদ। মোগলটুলী খাল খনন কর্মসূচি শেষে মেয়র চসিকের উদ্যোগে পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ড বড় কবরস্থান সংলগ্ন কৃষিখাল খনন কাজের উদ্বোধন করেন। এসময় উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন।
মোগলটুলী খাল খনন কর্মসূচি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, জলাবদ্ধতা মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। আমরা যদি সচেতন না হয়, এই মানবসৃষ্ট দুর্যোগ আমাদের বহন করে যেতে হবে। জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য আমরা যতই কাজ করি না কেন গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে না পারলে এ প্রকল্প সম্পূর্ণভাবে সফল হবে না। তিনি বলেন, গত বছর এই খালটি (মোগলটুলী) পরিষ্কার করা হয়েছিল, কিন্তু আবার এটা ময়লারস্তূপে পরিণত করা হয়েছে। জামাল খানের পিছনে একটি খাল পরিষ্কার করেছি কিছুদিন আগে সেটিও ময়লায় ভরাট হয়ে গেছে। এই যে একটা গণসচেতনতার অভাব রয়ে গেছে, যত্রতত্র আমরা পলিথিন, প্লাস্টিক ও ককশিট ফেলছি। এগুলো পচনশীল না হওয়ায় খাল ভরাট হয়ে যাচ্ছে। মানুষকে গণসচেতনতার আওতায় আনার জন্য আমরা কাজ করছি।
সিডিএ চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নুরুল করিম বলেন, শুধুমাত্র চট্টগ্রাম না, সারা বাংলাদেশের মধ্যে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প হচ্ছে একটি টপ প্রায়োরিটি প্রকল্প। প্রধান উপদেষ্টা ছাড়াও আর চার উপদেষ্টা জলাবদ্ধতা প্রকল্প সরাসরি মনিটরিং করছেন। সিডিএ, সিটি কর্পোরেশনসহ অনেকগুলো সংস্থা এখন সমন্বিতভাবে কাজ করছে। চট্টগ্রামবাসীর জন্য সুসংবাদ হচ্ছে সিডিএ ও সিটি কর্পোরেশন এখন একটি টিম হিসেবে কাজ করছে। তিনি বলেন, মূল এবং শাখা ড্রেন পরিষ্কার রাখতে হবে।
লে. কর্নেল মো. ফেরদৌস আহমেদ বলেন, ৩৬টি খাল যদি দখলমুক্ত করে আমরা নির্মাণ করি তাহলে জলাবদ্ধতা চলে যাবে বিষয়টি এমন না। খালগুলোতে পানি ধারণের জন্য বহনযোগ্য নেটওয়ার্কের প্রয়োজন রয়েছে। খালের প্রতি মানুষের সামাজিক যে দায়বদ্ধতা সেখানে কিছুটা হয়তো কমতি রয়েছে। আজ আপনাদের সবাইকে নিয়ে আমাদের খাল খনন কার্যক্রম শুরু করলাম।
কৃষিখাল খননকালে যা বললেন মেয়র : কৃষিখাল খনন কাজের উদ্বোধনকালে ডা. শাহাদাত বলেন, আমি মেয়র হওয়ার তিন–চারদিনের মধ্যেই কৃষিখাল পরিষ্কার করার উদ্যোগ নিই। কিন্তু আজ এখানে এসে দেখছি আবারও খাল ময়লায় ভরে গেছে। ৯০০ ফুটের এই খালটি আবার পরিষ্কার করব। এই খাল পরিষ্কার থাকলে বাকলিয়া, বহদ্দারহাট, চান্দগাঁও এলাকার পানি চাকতাই খালে নামবে এবং চাকতাই খাল থেকে কর্ণফুলী নদীতে চলে যাবে।
মেয়র বলেন, এই খাল দিয়ে একসময় পণ্য পরিবহন করতো, সাঁতার কাটত। এই খাল পুনর্খনন করে আমরা খালের স্বাভাবিক জলপ্রবাহ ফিরিয়ে দিতে চাই। কৃষি খালের অবস্থা হল, একসময় এটার প্রশস্ততা ছিল প্রায় ২১ ফুট। এখন ৬–৮ ফুটের বেশি হবে না। আশেপাশের বাড়িগুলো দখল করে ফেলেছে। যেসব বাড়ি পড়েছে সেগুলো ছেড়ে দিতে হবে। ২১ ফুটে ফিরিয়ে নিতে চাই। অন্তত ১৫–১৬ ফুট হতে হবে।
শাহাদাত বলেন, কৃষিখাল ছাড়াও সিডিএর প্রকল্পের বাইরে থাকা ২১ খালও কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে পরিষ্কার করব। বিএস সিট অনুযায়ী যেখানেই কেউ জোর করে খালের ভূমি দখল করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করা হবে। তিনি বলেন, শুরু থেকে ৫৭টি খালকে অ্যাড্রেস করে যদি আমরা কাজ করতে পারতাম তাহলে শতভাগ না হলেও ৯০ ভাগ জলাবদ্ধতা নিরসন হত। কিন্তু ৩৬টি খাল করার কারণে ৫০–৬০ ভাগ জলাবদ্ধতা নিরসন হবে কিনা সেটা সন্দেহ আছে। আগে যে কর্মসূচিগুলো ছিল জনগণকে সম্পৃক্ত করতে তারা পারেনি। ৩৬টি খাল যখন তারা করছিল যদি এলাকাবাসীর সাথে পরামর্শ করে সেগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করতে পারত, তাহলে আজ এত সমন্বয় সভারও দরকার ছিল না। এসময় মেয়র ২১টা খাল যদি চসিককে দেওয়া হয় তাহলে তারা ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানের সাথে সমন্বয় করে কাজ করবেন বলেও জানান।
এ সময় বর্ষার আগে জলাবদ্ধতা নিরসনে চসিকের উদ্যোগ বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে মেয়র বলেন, স্থানীয় সরকার বিভাগে আমরা দুটো প্রকল্প দিয়েছি। একটা হচ্ছে থোক বরাদ্দের মাধ্যমে ড্রেন ও খাল পরিষ্কার করা। ওই জন্য ১০০ কোটি টাকা চেয়েছি। কারণ আমাদের তো ওই পরিমাণ বাজেট নেই। আরেকটা হচ্ছে, যন্ত্রপাতি কেনার জন্য ১৯৮ কোটি টাকার প্রকল্প। সামান্য ৩০০ কোটি টাকার বাজেট চেয়েছি। সেগুলোতে এত বেশি ধীরগতি, এত বেশি প্রবলেম হচ্ছে সেটা আমাদের জন্য অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। তিনি বলেন, নিজস্ব অর্থায়নে আমরা খাল নালা পরিষ্কার করছি। যে টাকা হোল্ডিং ট্যাঙ হিসেবে পাচ্ছি, সেখান থেকে। হোল্ডিং ট্যাঙগুলোও ঠিকমত দেওয়া হচ্ছে না।
তিনি বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড যে ৩০–৩২টা স্লুইচ গেট করেছে, সেগুলোর যে প্রশস্ততা থাকার কথা ছিল সেটা রাখতে পারেনি। সরু করে ফেলেছে। এই বাধা দূর করতে না পারলে সমস্যা হবে। স্থানীয় জনসাধারণের পরামর্শ নেওয়া হলে সবাই সুফল পেত। নগরবাসীর উদ্দেশে মেয়র বলেন, আজ পরিষ্কার করছি। কাল যেন গারবেজ স্টেশন না হয়। এখানে পলিথিন প্লাস্টিক তো আছেই, লেপ তোষক বালিশ পর্যন্ত পেয়েছি।
চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন বলেন, আমরা চাই না যে এইবার বর্ষা মৌসুমে আপনারা সেই কষ্টটা পান যে কষ্টটা কয়েক বছর ধরে আপনারা পেয়ে আসছেন। আমরা জানতে পারলাম যে আসলে খাল অবৈধ দখলের শিকার হচ্ছে সেজন্য আমাদের জন জীবনটাই পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে এবং আমরা খারাপ অবস্থার দিকে চলে যাচ্ছি, আমাদের জীবনযাত্রাটাই হয়তো সেইভাবে যাপন করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই আমরা সরকারের প্রশাসন হিসেবে যেটা সিদ্ধান্ত পেয়েছি সেটা হচ্ছে যে আমরা সকলে মিলে সিডিএ, ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ আরো যে কয়টা সংস্থা রয়েছে আমরা এখন নিয়মিত বসছি এবং আমরা আমাদের মধ্যে সমন্বয়ের ক্ষেত্র সৃষ্টি করে সিটি কর্পোরেশনকে সহায়তা করছি। যেন সিটি কর্পোরেশন আপনাদেরকে একটা সুন্দর শহর উপহার দিতে পারে। যদি কেউ আমাদেরকে প্রতিহত করতে চায় তাহলে খাল দখলকারীদের বিরুদ্ধে আমরা আইনানুগ প্রয়োজনীয় শক্তি প্রয়োগে পিছপা হব না।