ইংরেজিতে বলে seiche; উচ্চারণটা দুর্বোধ্য, জিহ্বা জড়িয়ে যায় সেই–ইশ্ (SAYSH )। বাংলায় কোনো সরাসরি অনুবাদ পেলাম না। উত্তাল ঢেউ বলতে পারেন; কিন্তু একটু বিশেষ ধরনের উত্তাল, বেশী উন্মত্ত, বেশীমাত্রায় প্রলয়ঙ্করী। ধরুন, আপনি কাপে বা গ্লাসের পানিতে একদিকে ফুঁ দিলেন সেদিকের পানি ঢেউ করে অন্যদিকে চলে যাবে। যেদিকে ফুঁ দিয়েছিলেন, অল্পক্ষণের জন্যে হলেও সেদিকের পানি একটু কমবে; আর স্বাভাবিকভাবেই উল্টাদিকে পানি বাড়বে। গ্লাসের বদলে, বাটি বা ডেকচী চিন্তা করতে পারেন। এবারে একটু জোরে ফুঁ দিতে হবে; তাহলে একই ব্যাপার হবে। বাথটাবেও চেষ্টা করতে পারেন, তবে এবারে আপনার একার ফুঁ–তে কাজ হবে না। খুব জোর পাওয়ারের ফ্যান বা ব্লোয়ার লাগবে। এই বারে পরিসর আরেকটু বড় করি, পুকুর বা লেইক। ওহাইহোতে আমরা থাকি বিশ্ববিখ্যাত গ্রেট–লেইকগুলোর একটা, লেইক ইরী (Lake Erie )-র পাশেই। বিশ্বের সবচেয়ে বড় মিষ্টি–সুপেয় পানির রিসার্ভার বলেই এই পাঁচটা গ্রেটলেইক বিখ্যাত। এগুলোর নাম মনে রাখার সহজ উপায় হলো HOMES (Huron, Ontario, Michigan, Erie, Superior )। আর একটা কথা জানাই এই লেইক ইরী থেকেই পানি গিয়ে লেইক ওন্টারিওতে পড়ার সময়ে নায়াগ্রা জলপ্রপাত সৃষ্টি হয়েছে।
লেইকের পানিকেও সেই গ্লাসের পানির মতই চিন্তা করি কারণ দুইটারই সীমানা আছে। নিজেদের মধ্যে সরু নদী দিয়ে যুক্ত থাকলেও, লেইকগুলো বিশাল সমুদ্রের সঙ্গে লাগোয়া নয়। তার মানে আপনি লেইকের একপাশে ফুঁ দিলে, সেই গ্লাসের মতই অবশ্যই পানি কমে যাবে; এবং অন্যপাশে সেই পানি বেড়ে যাবে। ওহ্, বুঝতে ভুল করেছি; আপনি তো দৈত্য নন, আপনার–আমার ফুঁ আর কত শক্তিশালী হবে? কিন্তু সত্যসত্যিই যদি এরকম দানবের মত ফুঁ দেওয়া যায়, তাহলে ফর্মুলা অনুযায়ী সেরকম হওয়া সম্ভব। এবং মাঝেমধ্যে সেটা হয়ও। সেটার অভিজ্ঞতা এতই ভয়ঙ্কর যে না হলেই ভালো হতো। বা, যখন হয়, তখন লেইকের ধারে কাছে না থাকাটাই নিরাপদ।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে, ক্রিস্টমাসের ছুটির সময়ে একটা খারাপ উইন্টার–স্টর্ম আমাদের এলাকার উপর দিয়ে সবকিছু তছনছ করে দিয়ে চলে গেলো। এখানে তুষারপাত ব্যাপারটা বেশী কিছু না আমরা অভ্যস্ত। আমাদের বাড়ি–গাড়ি, রাস্তাঘাট, অফিস, প্লেন–ট্রেন সবকিছুই ডিজাইন করার সময়ে মাত্রাতিরিক্ত শীত ও গরম হিসাব করেই বানানো হয়। স্নো হলে সবকিছুই নর্মাল চলে। তবে হ্যাঁ ব্যতিক্রমও আছে মাঝে মাঝে অল্পসময়ের মধ্যে হঠাৎ করে অনেক তুষারপাত (snowfall ) হলে, বা তুষারের বদলে eid (ice ) হলে, বা সঙ্গে প্রবল বাতাস থাকলে (blizzard ), তখন বেকায়দায় পড়তে হয়। কোনো কোনোদিন কাউন্টি কর্তৃপক্ষ স্নো–ইমার্জেন্সি দেয়
লেভেল ওয়ান নম্রভদ্র উপদেশ: বাছারা প্রয়োজন নাহলে বাসা থেকে বের হয়ো না।
লেভেল টু কড়া নিষেধ: শুধুমাত্র ইমার্জেন্সির কারণে জনসাধারণ বের হতে পারবে।
আর, লেভেল থ্রি সাধারণ মানুষ রাস্তায় বের হলেই, পুলিশের টিকিট খাবে। তখন শুধুমাত্র ইমার্জেন্সির মানুষজন বের হবে পুলিশ, ফায়ার, এম্বুলেন্স, ডাক্তার, নার্স, বরফ–পরিষ্কারের গাড়ি, গ্যাস–ইলেক্ট্রিক অফিসের লোকেরা।
স্নো ভালো, কিন্তু আইস হলে খবর আছে। আইস স্লিপারি, হাঁটতে পারবেন না। ধপাস করে পড়ে যাবেন। গাড়ির চাকা মাটির সঙ্গে কোনো ঘর্ষণ না করতে পেরে পিছলে কন্ট্রেলের বাইরে চলে যাবে। আরো ভয়ঙ্কর হলো উপরে ঝুলে থাকা আইসিক্যাল (icicle )। বাড়ি–বিল্ডিং–এর উপরের কার্নিশে, উঁচু গাছে, ইলেক্ট্রিকের তারে আইস জমে জমে সরু সূচালো আইসিক্যাল হয় সাক্ষাৎ ঝুলন্ত শুল। এগুলো ভেঙ্গে মাথায় পড়ে খুলি ভেদ করে ঢুকে যাবে। অনেকেরই তাৎক্ষনিক মৃত্যু হয়েছে, অনেকেই গুরুতর জখম হয়েছে।
যাক আবারো ফিরে আসি ২০২২ সালের ডিসেম্বরের ২৩/২৪ তারিখে। সপ্তাহখানেক ধরেই আবহাওয়ার পূর্বাভাসে জানিয়ে দিচ্ছিলো, একটা ভয়ঙ্কর ওয়েদার–সিস্টেম আসছে। প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ওয়েস্ট–কোস্টে সিয়াটল দিয়ে ঢুকে, অনেক স্টেট পার হয়ে, লন্ডভন্ড করে আমাদের উপর দিয়েও যাবে; তারপরে পেন্সিল্ভ্যানিয়া–নিউইয়র্ক হয়ে আটলান্টিকে পড়বে। আবহাওয়াবিদরা তুষারপাত নিয়ে বেশী চিন্তিত নয় কোনো কোনো জায়গায় ১৮–২৪ ইঞ্চির মত বরফ পড়বে, কিন্তু অধিকাংশ এলাকাতেই দুই থেকে ছয় ইঞ্চি। এটা আমাদের জন্যে কোন ব্যাপারই না। দুশ্চিন্তার বিষয় হলো প্রবল বাতাস। স্নো–ফলের সময়ে খুব জোরে বাতাস হলে ব্লিজার্ড হয়; খুবই মারাত্মক।
ব্লিজার্ড কীরকম, তার ধারণা দেই। আপনি হাঁটছেন সাধারণ তুষারপাত হলে, আপনি একটু কষ্ট করে হলেও হাঁটতে পারবেন। গরম জ্যাকেট, স্নো–বুট, গ্লাভ্স্ মাফলার, টুপি আপনাকে রক্ষা করবে। কিন্তু বাতাস বাড়তে থাকলে, ব্লিজার্ড শুরু হলে, আপনি না নিজেকে ঠিক রাখতে পারবেন, না আপনার পা ঠিকমত পড়বে। মাথা উদ্ভ্রান্ত হয়ে যাবে; নাক–চোখ–মুখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়ে জমে বরফ হবে। সুইয়ের মত তীক্ষ্ম বরফ ও বাতাস শরীরে বিঁধতে থাকবে, নিশানা হারিয়ে ফেলবেন। আর যদি গাড়ি চালান, তাহলে রাস্তাই দেখতে পাবেন না, গাড়ি নিজের ইচ্ছামত ঘুরপাক খাবে। ব্লিজার্ডের সময়ে যখন গাড়ি চালাই, আমার মনে হয়, ছুটন্ত এক সাপের পিঠে গাড়ি চালাচ্ছি। রাস্তার স্নোগুলো বাতাসে ঘূর্ণি খেতে থাকে, আর সাপের মত এঁকেবেঁকে চলে মাথা আউলে দেয়। ভীষণ বিপজ্জনক, ভয়ঙ্কর।
এবারে বলছে ৩০ থেকে ৬০ মাইল বেগে (ঘন্টায় ৫০–৯৫ কিমি) বাতাস ঝাপটা মারবে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে, কারেন্ট চলে যাবে, রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে যাবে ইত্যাদি। সব এয়ারলাইন্স্ যাত্রীদের নিরাপত্তা ও সতর্কতার জন্যে, সবাইকে ফ্লাইট বদলে নেওয়ার সুযোগ দিলো। আমাদের ছিলো পেরু যাওয়ার প্ল্যান; সেটা ক্যান্সেল করেছিলাম সেখানের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে। পেরুর বদলে মেক্সিকো যাবো ঠিক করলাম। তাই, আমরা আবহাওয়া বুঝে আগেভাগেই এয়ারপোর্টে চলে গেলাম। কিন্তু তারপরেও ধরা খেয়ে গেলাম। অনেক ডিলে করে করে শেষমেশ মেক্সিকোর ফ্লাইটও ক্যান্সেল করে দিলো। যা হোক, আল্লাহ্ যা করেন ভালোর জন্যেই করেন। প্লেনে উঠে যদি বিপদ হতো, সেটার চাইতে মাটিতে থাকাই ভালো। এর মাঝে দেখলাম এক অভূতপূর্ব, ভয়ঙ্কর রকমের ংবরপযব–এর বিস্ময়কর ছবি।
ম্যাপে দেখবেন, আমাদের শহর টলিডো হচ্ছে লেইক ইরী–র সবচেয়ে পশ্চিম তীরে। সামারে আমরা লেইকে ঘুরতে যাই, বোট চালাই, মাছ ধরি, সাঁতার কাটি, বীচে পিকনিক করি। পোর্ট ক্লিন্টন বলে একটা জায়গা থেকে ফেরি বা প্রাইভেট বোটে করে লেইকের মাঝের দ্বীপগুলোতে যাই কেলী’স আইল্যান্ড, কাটাওবা আইল্যান্ড, মিডল–ব্যাস আইল্যান্ড, সাউথ–ব্যাস আইল্যান্ড ইত্যাদি। সাউথ–ব্যাস আইল্যান্ডে পুট–ইন–বে খুবই পপুলার ট্যুরিস্ট স্পট; আর তার সংলগ্ন একটা ছোট্ট উপদ্বীপ জিব্রাল্টার আইল্যান্ড। বড় দ্বীপ আর ছোট দ্বীপের মাঝের দূরত্ব প্রায় আধা মাইল আর পানির গভীরতা প্রায় দশ থেকে বিশ ফুট।
এবারের ঝড়ে, আমাদের এলাকায় প্রচন্ড বাতাস এসেছিলো পশ্চিমে শিকাগোর দিক থেকে। সেইইশ্–এর কারণে, সেই প্রবল বাতাসের দাপটে আমাদের এলাকার পানি হুশ্শ্ করে সরে গিয়ে লেইকের অন্যপ্রান্তে (সবচাইতে পূর্বে), নিউ–ইয়র্ক স্টেটের বাফেলো শহরের দিকে চলে গিয়েছিলো। আমাদের দিকে লেইকের তলার মাটি (জিব্রাল্টার আইল্যান্ডে) দেখা গেছে সেইসমস্ত ছবি দেখে গা শিউরে উঠছিলো। মনে মনে হিসাব করা শুরু করলাম, কত হাজার হাজার গ্যালন পানিকে ফুঁ দিয়ে সরাতে পারলে এইরকম হওয়া সম্ভব! বাতাসের জোর কত প্রবল হতে হবে যে, সেটা পানিকে শুধুই দোল দিবে না বরং হাছড়ে পাছড়ে দুই–তিনশো মাইল নিয়ে যাবে! ইন্টারনেটে, পুট–ইন–বে’র ওয়েবসাইট থেকে ছবিগুলো নিয়ে সকলের সঙ্গে শেয়ার করলাম। জিনিসটা এমনই যে ছবি না দেখলে বিশ্বাসই হবে না। আর যারা এলাকাটা চিনে না, তাদেরকে বিফোর–এন্ড–আফটার ছবি দেখিয়ে বুঝাতে হবে সেইইশ্–এর কারণে বাতাস কীভাবে টলিডোর দিকের পানি সরিয়ে বাফেলোর দিকে নিয়ে গিয়েছিলো। দৈত্য–দানোর ফুঁ নয়, আসলে আল্লাহ অসীম ক্ষমতার পরিচয় এখানেও পাওয়া যায়। তিনি সবই করতে পারেন।
টলিডো, ওহাইও, ২০২২