সপরিবারে সেই আন্ডারপাসের মুখে এসে দাঁড়াতেই দেখি, তার অন্দরে ঢুকতে হলে ভাঙতে হবে নিম্নগামী বেশ কয়েকটা সিঁড়ি। কিন্তু নামার দরকার আছে কি? আমাদের তো শুধু নিশ্চিত হওয়া দরকার যে, এটা আসলেই মেট্রোস্টেশন কি না। যদি হয় তবে ধরে নেব এর আশেপাশেই আছে অভ্রর প্রার্থিত পেটশপ। মুশকিল হল এখানে এখন পর্যন্ত কোনও সাইন বা সাইনবোর্ড চোখে পড়েনি? অবশ্য চায়নিজ ভাষায় স্টেশনের নাম লেখা সাইনবোর্ডের চেয়ে প্রাণপণে মনে মনে খুঁজছি এখন মেট্রোরেলের সাইন দেয়া কোনও একটা কিছু।
ফল হল তাতে। নজরে পড়লো নিম্নগমনের ঐ সিড়িটির ডানের দেয়ালে লাগানো ছোট্ট প্লেটটি। কিন্তু হা হতোম্মি সেই প্লেটেও কোন সাইন নেই ! আছে যা তাতে লেখা, তার সবই বরাবরের মতোই চায়নিজ ! অনুমান করছি ঐ চায়নিজে লেখা আছে স্টেশনের নামই। তাহলে তো এটা আসলেই সেই স্টেশনের পেটে ঢোকার মুখ। কারন ঢোকার মুখে এই সিঁড়ি থাকাতে প্রথমেই তো এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে এটা অবশ্যই কোন আন্ডারগ্রাউন্ড কারপার্ক নয়। কিন্তু এখানে আসার পর থেকেই যেহেতু পড়েছি নানান সময়ে নানান বিভ্রাট আর গোলমালে, অতএব ব্যাপারটি নিশ্চিত হয়ে নেয়াই ভালো।
এ কথা ভেবে সবাইকে সিঁড়ির উপরে অপেক্ষা করতে বলে, নিজে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলাম নিচে। নিচে নেমে সেই সুড়ঙ্গ ধরে কিছুটা এগুতেই চোখে পড়ল, সে সুড়ঙ্গ পথের ধারে স্টিলের ফ্রেমে লাগিয়ে রাখা বড়সড় সাইজের মানচিত্রটা। ঐ মানচিত্রের রেখাগুলো ছাড়া বাকি সবই চায়নিজ হলেও, রেখাগুলোর রং আর নানাদিকে ওগুলোর যে গতিবিধি দেখতে পেলাম, তাতে নিশ্চিত হওয়া গেল যে, হ্যাঁ আরো যদি যাই সামনের দিকে এই সুড়ঙ্গের গভীরে; পাওয়া যাবে তবে সেই স্টেশন খুঁজছিলাম যা এতক্ষণ। মনে মনে তাই আর্কিমিডিসের সেই বিখ্যাত ইউরেকা ইউরেকা বলতে বলতে দিলাম ফিরতি হাঁটা।
দলের কাছে ফিরে এসে জানালাম যে হ্যাঁ এটাই সেই স্টেশন। চল সকলে মিলে দশচোখে দশদিকে খুঁজে দেখি এখানাকার আশেপাশের যাবতীয় দোকানগুলো। হয়তো তাতেই পেয়ে যেতে পারি সেই পেটশপ। বিশেষত সাইনবোর্ডে কুকুর বিড়াল বা পাখির ছবি পেলেই চলবে। অবশ্য কোনও দোকান খোলা থাকলে বাইরে থেকেই তার সাজসজ্জা দেখেও বোঝা যাবে, ওটা কিসের দোকান।
কাজ হল বেশ দেখছি আমার এ কথায়। সামনের দিকে হাঁটতে এরই মধ্যে দেখছি সবাই গভীর মনোযোগে দেখতে শুরু করেছে রাস্তার ধারের যাবতীয় দালানগুলো। এতে খুব দ্রুতই স্টেশনসংলগ্ন এই ব্লকটা রেকি করা হয়ে গেল।
পাঁচজনের দশ চোখ এদিকটায় কোনও ধরনের সাইনবোর্ডের অস্তিত্ব ধরতে ব্যর্থ হওয়ায়, মনে হল আসলে এখানটায় কোন দোকানপাঠ নেই। যে অল্প ক’টা তিন চার পাঁচ বা ততধিক তলার দালান আছে এই স্টেশনের আশেপাশে, এতক্ষণ ওগুলোর নিচতলাগুলোই দেখেছি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবাই। কারণ পেটশপ তো কেউ আর দুই বা তিন তলায় করবে না। তদুপরি এই বিল্ডিংগুলোর ধরনে ওগুলোকে অফিসবিল্ডিং বা আবাসিক দালানই মনে হচ্ছে। ঢাকায় যেমন ঘোরতর আবাসিক দালানের নিচতলায়ও পাওয়া যায় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, বেইজিঙয়ের অন্য জায়গায় তেমন পাওয়া গেলেও এখানকার এই সৈয়দ বংশীয় এলাকায় ওরকমটা পাওয়ার সম্ভাবনা কমই মনে হচ্ছে। অনিবার্যভাবে তাই মন খারাপ হওয়ার কথা অভ্রর এতে।
ওকে চাঙ্গা করার জন্য তাই বললাম, বাবা নো চিন্তা। এখানে পাইনি তো কী হয়েছে? এখনকার আমাদের প্রথম ও একমাত্র কাজই হলো তোমার সেই পেট শপ খুঁজে বের করা। তারপর হবে অন্য কাজ। চল এখন ঐ যে গম্বুজওয়ালা চমৎকার দালানটি আছে ঐদিকে যাই। দেখি তো ভালো করে ওটা আসলে কী?
হ্যাঁ, সেই প্রথম দিন আমাদের হোটেল রুমের জানালা দিয়ে একাধিক ছোট ছোট গম্বুজবিশিষ্ট এই দালানটি দেখে আমাদের ষাট গম্বুজ মসজিদের কথা মনে পড়লেও এটি যে মসজিদ নয় সে ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছিলাম যুক্তিতে যুক্তিতে কাটাকুটি করে। তারপর এর সামনে দিয়ে বেশ ক’বার একাকি এবং সপরিবারে হেঁটে গেলেও, ছিলাম যেহেতু ঐসব সময় নানাবিধ তাড়ায়, এটি যে আসলে কি তা আর নিশ্চিত হওয়ার ফুরসৎ পাইনি। এখন সেই স্টেশন থেকে দশচোখ মেলে দশদিকে আঁতিপাঁতি করে পেটশপ খুঁজতে খুঁজতে এরই মধ্যে যখন এসেই পড়েছি এর কাছাকাছি এইবার এটির একটু খোঁজ খবর নেয়া দরকার। হালকা হলুদ রঙ্গয়ের ইউরোপীয় বিশেষত প্যারিস নগরীতে দেখা নানান প্রাচীন দালানের ডিজাইনের এই দালানটি হতেই পারে কোনও একটা বিশেষ স্থাপনা। বেইজিং শহরের এই ডাউন টাউন এলাকায় এরকম একটি ইউরোপীয় ধাঁচের দালানে কী যে আছে তার একটু খোঁজ নেয়া দরকার।
এরই মধ্যে সেই গম্বুজ দালানের চত্বরে ঢোকার রাস্তার মুখে এসে পড়েছি যেহেতু, বললাম সবাইকে, চল যাই ঐ পার্কিং লট পেরিয়ে এর ভেতরে ঢোকার সদর দরজার সামনে। কারণ আশেপাশে বা দালানটির গায়ে কোনও নাম লেখা নেই। যদিও নাম লেখা থাকলেও আমরা যে তা পড়তে পারতাম তা তো অবশ্যই নয়। আবার একদম সদর দরজায় গিয়েও যে কোনও ইংরেজি লেখা নাম ফলক পাবো তারও নিশ্চয়তা নেই, এরকম একটা ভাবনা যখন দোল খাচ্ছে মনে তখন
‘না না, কী জন্য যাবো ওইখানে। এমনিতেই তো বলেছ এখন হেঁটে হেঁটেই খুঁজবে পেটশপ। এখান থেকেই তো বুঝতে পারছি যে ঐ দালানে ওইরকম কিছু নাই। অতএব খালি খালি ঐ পর্যন্ত কষ্ট করে হেঁটে যাওয়ার কী দরকার?’
আমার প্রস্তাবের বিপরীতে লাজুর কাছ থেকে এরকম জোরালো ভেটো আসতেই বাধ্য হয়েই থামতে হলো। থেমে সবার চোখেমুখে তাকিয়ে যা পড়তে পারলাম, তাতে বুঝলাম এই ভেটোর প্রতি তুমুল সংখ্যাগরিষ্ঠ না শুধু, আছে এক্কেবারে সকলেরই শতভাগ সমর্থন! নিজের প্রস্তাব এভাবে গো হারা হেরে যাওয়ায়, একদিকে মেজাজ খারাপ হল যেমন, তেমনি চেপে গেল জেদও। কিন্তু নাহ, সকলের মতামতের প্রতি সম্মান জানিয়ে মেজাজ না দেখিয়ে, নিজ জেদ বজায় রাখার জন্য শান্তভাবে বললাম, ঠিক আছে অপেক্ষা করো সবাই তোমরা এখানে, আমিই গিয়ে দেখে আসি দ্রুত, যে দালানটিতে আসলে আছেটা কী?
একথা বলেই সবাইকে অপেক্ষায় রেখে ঐ চত্বরের প্রবেশ মুখের দিকে এগুতে এগুতে পিছু ফিরে দেখি, মত বদলেছে মনে হচ্ছে পুরো দল। নাহ, তারা ওই ফুটপাতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে না। এগুচ্ছে তারাও বরং এই দালানটির আঙিনার দিকেই ছবি তুলতে তুলতে, আমার পিছু পিছু। মনে হচ্ছে এরই মধ্যে যতই বেইজিং হিমের সাথে সকলে কিছুটা খাপ খাইয়ে ফেলতে সক্ষম হোক না কেন, এক জায়গায় স্থির থাকলে যেহেতু এই হিম শরীরে তীব্র কামড় বসানোর সুযোগ পায়, সে জন্যই তারা দাঁড়িয়ে না থেকে হাঁটাহাঁটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
নিজের বেশ দ্রুত গতির জন্য এরই মধ্যে সবাইকে অনেক পেছনে ফেলে, চলে এসেছি এক্কেবারে ইউরোপিয়ান ভঙ্গির তুমুল জাঁকের এই দালানের পিক আপ ড্রপ এলাকায়। কোনও গার্ড আছে কী না আশে পাশে তা বোঝার জন্য ডানে বাঁয়ে তাকাতেই পড়লো চোখে, দেয়ালে সাঁটা এন্টিক এন্টিক ভাবের মোটা একটা জাকালো সোনালি প্লেট। লেখা আছে ওতে, হোটেল লিজেন্ডেল বেইজিং। নীচে তার দেয়া আছে সোনালি পাঁচটা তারকা।
সেই পাঁচ তারকা একযোগে জানান দিলে যে, এটাও একটা সৈয়দবংশীয় হোটেলই। তবে এর বংশ মর্যাদা মনে হচ্ছে আমাদের রিজেন্টের চেয়ে একটু উপরের দিকেই হবে। পৃথিবীর নানান দেশে নানান সময়ে নানান হোটেল চেইনে থাকলেও এই নাম তো শুনেছি, বলে মনে হচ্ছে না। এটি কি তবে চায়নিজ কোনও হোটেল চেইনের হোটেল নাকি? এটি যদি চায়নিজ হোটেল চেইনই হবে, তবে এর ডিজাইন ইউরোপিয়ান ধাঁচের কেন? নাকি এটি ইউরোপিয়ান কোনও বুটিক হোটেল?
আর দূর এসেই পড়েছি যখন এক্কেবারে দরজার মুখে, বাইরে দাঁড়িয়ে এসব ভাবছি কেন? দেখিই না একটু ভেতরে উঁকি দিয়ে। একথা ভাবতে ভাবতে, এর স্বয়ংক্রিয় দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সেটি খুলে যেতেই, চোখে পড়লো জাঁকজমক পূর্ণ বিরাট লবিটি। বেশ একটা বনেদী ভাব চারদিকে। আমাদের রিজেন্ট হোটেলের তুলনায় এর লবির আকার ঢের বড়। তাতে বোঝা যাচ্ছে এর ধারণক্ষমতাও রিজেন্টের চেয়ে অনেক বেশি। আশে পাশে চোখ রেখে পায়ে পায়ে লবি ধরে সামনের দিকে এগুতে এগুতে এ সময় ডানে চোখ যেতেই নজরে পড়লো, দশাসই আকারে একটা থামের গায়ে লাগানো কালো মার্বেল পাথরের পোস্টার সাইজের ফলকটির দিকে। কপাল ভালো লেখা আছে যা তাতে, তার সবই ইংরেজি। এগিয়ে গেলাম তাই সেটির দিকে।
ফলকের লেখা পড়ে চক্ষুকর্ণমনের বিবাদভঞ্জন হলো অতপর। পরিষ্কার হলো এ সংবাদ যে এর ডিজাইনে প্রাচীন ইউরোপিয়ান ভাব, আর ভেতরের আসবাবপ্ত্র ও গোটা আবহে ইউরপিয়ান এন্টিক এন্টিক ভাব থাকলে জন্ম এর মাত্র ২০০৮ সালে। মানে যে বছর বেইজিং এ হয়েছিল শীতকালীন অলিম্পিক। অর্থাৎ বেইজিং এর বার্ডস নেস্টের মতো এটিরও উদ্বোধন হয়েছিল ঐ একই সালে, একই সময়ে। তদুপরি অলিম্পিক কমিটি নাকি এটিকে ভি আই পি হোটেল হিসাবে মর্যাদা দিয়েছিল। এর মালিকানা চায়নিজদের হাতে থাকলেও তারা মেইনল্যান্ড চাইনিজ কেউ নয়। এক সময়ের পর্তুগীজ কলোনি এখনাকার সময়ের নামকরা ক্যাসিনো দ্বীপ ম্যাকাওয়ের, লিজেন্ড ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি হল এই হোটেলের মালিক!
লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক